Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শাহজালাল বিমানবন্দরে লাগেজ বিড়ম্বনা

প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উমর ফারুক আলহাদী : হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ পেতে বিড়ম্বনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আকাশ পথে দীর্ঘ ভ্রমণের পর বিমানবন্দরে এসে লাগেজ পেতে প্রতিদিনই যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। যাত্রীদের সীমাহীন ভোগান্তি এখন যেন অনেকটা নিয়মে পরিণত হচ্ছে। এ নিয়ে অন্তহীন অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন থেকেই। তারপরেও সমস্যা সমাধানের কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেই বলে যাত্রীরা অভিযোগ করছেন। তাঁরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ, বিমানমন্ত্রীর নির্দেশ, সংসদীয় কমিটির বৈঠক এবং বিমান পরিচালনা বোর্ডের আশ্বাস, কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও স্থায়ীভাবে এর কোন সমাধান হচ্ছে না। গত কয়েকদিন বিমানবন্দরে সরেজমিনে পরিদর্শন করে যাত্রীদের দুর্ভোগ ও লাগেজ বিড়ম্বনার ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। বিমানবন্দরে ভুক্তভোগী যাত্রীরা নানা সমস্যা ও ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ জন্য জনবলের অভাব ও অদক্ষ জনবলকে দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, যাত্রী বাড়লেও বিমানবন্দরে বাড়েনি লাগেজ বেল্ট ও কাউন্টার।
মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ। বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি। গতকাল তার সাথে কথা হয় শাহজালাল বিমানবন্দরে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ভোর সাড়ে ৫টার দিকে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে বিমানবন্দরে অবতরণ করি। তারপর ইমিগ্রেশনসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সকাল ৮টা পর্যন্ত লাগেজের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, লাগেজ না পেয়ে এ সম্পর্কে জানার জন্য বা অভিযোগ করার মতোও কাউকে পাওয়া যায়নি। এটা কোন ধরনের আচরণ বা যাত্রীসেবা ! ”
এসময় দুবাই প্রবাসী এবং মুন্সীগঞ্জের অধিবাসী আবুল মিয়া বলেন, দীর্ঘ ২ বছর পর দুবাই থেকে দেশে ফিরেছি। ভাবছিলাম বিমানবন্দরে লাগেজ বিড়ম্বনা কমেছে। কিন্তু না, এখন দেখছি আরো বেড়েছে। তিনি বলেন, প্রবাসে থেকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও অনলাইন নিইজে দেখেছি, বিমানবন্দরের যাত্রী সেবার মান বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী দফায় দফায় নির্দেশ দিচ্ছেন। টিভিতে দেখলাম, বিমান মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বিমানবন্দরে গিয়ে সরাসরি যাত্রীদের সমস্যা দেখছেন এবং তা সমাধানের জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরো জটিল হচ্ছে। আগে লাগেজ পেতে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা সময় অপেক্ষা করতে হতো, এখন সেখানে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। আবুল মিয়া আরো জানান, তিনি প্রায় তিন ঘণ্টা পর তার একটি লাগেজ পেলেও অপর একটি লাগেজ পাননি। পরে লাগেজ ছাড়াই তিনি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসেন।
শুধু আবুল মিয়া কিংবা মামুনুর রশীদই নয়, এ ধরনের শত শত অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর দুই দিন আগে কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাপুরে কুয়েত প্রবাসী শাজাহান জানান, তিনি তার লাগেজের জন্য প্রায় দুই ঘণ্টা লাগেজ বেল্টের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাজাহান জানান, লাগেজ না পেয়ে অনেকেই হতাশ হয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে যান। এ নিয়ে অভিযোগ করার পর কর্মকর্তারা হাতে একটি কাগজের সিøপ ধরিয়ে দিয়ে পরে যোগাযোগ করতে বলেন। এধরনের ঘটনা অহরহই ঘটছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, লাগেজ পেতে আগে কিছুটা সময় লাগলেও, এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। তিনি বলেন, কয়েক মাস আগে সউদি এয়ার লাইন্সের যাত্রীদের বেশ কিছু লাগেজ আনতে সময়ক্ষেপণ হয়েছিল। যাত্রী আসলেও সেই সাথে লাগেজ আসত না। পরে আমরা আলোচনা করে এ সমস্যা সমাধান করেছি। মন্ত্রী বলেন, লাগেজ সমস্যা নিরসনের জন্য আমরা বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডিলিং নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করছি। জয়েন্ট ভেঞ্চারে দেয়ার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি জনবলও বাড়ানো হবে।
বিমানবন্দরে কর্মরত একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দরে যাত্রী সেবার মান বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। যাত্রীদের লাগেজ পেতে যেন হয়রানি ও ভোগান্তি না হয় সে জন্য বিমানবন্দর পরিদর্শন কালে মন্ত্রী একাধিকবার সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করেছেন এবং দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক মাস মন্ত্রী বিমানবন্দরে অফিস করেছেন এবং যাত্রীদের লাগেজ দ্রুত সরবরাহ করার জন্য নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই এ সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। তিনি বলেন, বিমানের একটি দুর্নীতিবাজ অসাধু চক্রের কাছে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডিলিং জিম্মি হয়ে আছে।
অপর একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বিমানের সিবিএ নেতা নামধারী মাস্তানদের রাহুগ্রাস থেকে বিমানকে রক্ষা করতে হলে সিবিএকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডিলিং ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন ধরে ওই অসাধু চক্রের কাছে জিম্মি রয়েছে। ফলে লাগেজ সমস্যা নিরসনের জন্য সংসদীয় কমিটি, বিমানমন্ত্রী কিংবা বিমান বোর্ড পরিচালনা পরিষদ কোন ধরনের কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডিলিং-এর কাজ বিদেশী কোম্পানীকে দেয়ার জন্য দরপত্র আহবানে করা হয়েছে কয়েক দফায়। সর্বশেষ এ দরপত্রে সাড়া দিয়ে দুবাইয়ের ডানাটা, টার্কিশ এয়ারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সেলিভি, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সিটা, মিসরের ইজিপ্ট এয়ার, ইউরোপের সুইসপোর্ট ও ভারতের দুটো প্রতিষ্ঠান টেন্ডারের কাগজপত্র জমা দেয়। এর আগে গত বছর বিমান কর্তৃপক্ষ শাহজালালের কার্গো ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডিলিং জয়েন্ট ভেনচারে করার জন্য সরাসরি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছিল। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সুইসপোর্টসহ বিশ্বের পাঁচটি গ্রাউন্ড হ্যান্ডিলিং কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়। কিন্তু বিমানের দরপত্র যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে মাত্র তিনটি দরপত্র গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। সেগুলো ছিল সুইসপোর্ট, দুবাইভিত্তিক ডানাটা ও তুরস্কভিত্তিক কোম্পানি সিভেলি। কিন্তু বিমানে এ ধরনের জয়েন্ট ভেনচারভিত্তিক কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার মতো বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারী না থাকায় ওই দরপত্র বাতিল করা হয়। এরপরই বিমান পরিচালনা পর্ষদ একটি আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্ট নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে বিমান জয়েন্ট ভেনচারের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করার পর দুবাইভিত্তিক ডানাটার সঙ্গে সম্প্রতি লাইসেন্স খোয়ানো একটি দেশী এয়ারলাইন্স একীভূত হয়ে গ্রাউন্ড ও কার্গো হ্যান্ডিলিংয়ের কাজ পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২৩ বিদেশী এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করছে, কার্গো ফ্লাইট চলছে ৮টি। সপ্তাহে বিমান ১৬৮ ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো করে ২০০টি। কার্গো ফ্লাইট ১৫টি। বিমান বছরে এই খাত থেকে সাড়ে চার শত কোটি টাকা আয় করে থাকে। ২০১১ সালে আর্নেস্ট এ্যান্ড ইয়াং নামে একটি ভারতীয় কোম্পানি বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডিলিং বিভাগে কত লোকবল প্রয়োজন তার ওপর একটি প্রতিবেদন দেয়। এজন্য আর্নেস্টকে এক কোটি ২০ লাখ টাকা দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রাউন্ড হ্যান্ডিলিং বিভাগের গ্রাউন্ড সার্ভিসের জন্য বিদ্যমান লোকবলের চেয়ে অনেক কর্মীর কথা বলে। বিমান অবশ্য এজন্য ২৫৪০ লোক চেয়েছে। অথচ এই শাখায় হেলপারসহ লোক রয়েছে মাত্র ৭২২ জন। কার্গো শাখায় বর্তমানে লোক রয়েছে হেলপারসহ মাত্র ২৮০ জন। বিমান এই শাখায় লোক চেয়েছে ৬৭৯ জন। আর আর্নেস্ট শুধু সুপারভাইজার পদেই লোক চেয়েছে ২৯৫ জন।
গ্রাউন্ড সার্ভিস ইক্যুইপমেন্ট শাখায় বর্তমানে লোক রয়েছে মাত্র ২২৫। বিমান এজন্য লোক চেয়েছে ৪৪১ আর আর্নেস্ট চেয়েছে ২৮৮। প্রতি শিফটে ৩৫০ লোক প্রয়োজন। অথচ সেখানে লোক রয়েছে মাত্র ৬০। বড় ধরনের উড়োজাহাজে ৩০ লোক প্রয়োজন হয়। ছোট উড়োজাহাজে ১৯। অথচ বিমান এখানে মাত্র অর্ধেক লোকবল দিতে পারছে। জনবলের অভাবেই এ সমস্যা দিন দিন বাড়ছে বলে কর্মকর্তারা দাবী করছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শাহজালাল বিমানবন্দরে লাগেজ বিড়ম্বনা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ