Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিরলস কাজ ৫৫ হাজার কর্মীর

প্রকাশের সময় : ২৮ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম : ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দেশের বিশাল উপকূলীয় এলাকার ১৩টি জেলার ৪০টি উপজেলার সাড়ে ৩শ ইউনিয়নের প্রায় কোটি মানুষের জানমালের হেফাজতে ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি’র (সিপিপি) প্রায় ৫৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। গত ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ আঘাতের আগেও সিপিপি’র বিশাল কর্মী বাহিনী উপকূলের কোটি মানুষকে আগাম সতর্কতা প্রদানের পাশাপাশি ৫ লাখ নারী-শিশু বয়স্কদের আশ্রয় কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে সহায়তা করে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের সহযোগিতায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত সিপিপি’র এ কার্যক্রম দেশের উপকূলীয় মানুষের কাছে এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৭০ পরবর্তি সবগুলো ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সিপিপি’র কর্মীরা উপকূলবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮৫, ১৯৮৮,১৯৯১ ও ২০০৭-এর সিডরের মত ভয়াল প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় উপকূলবাসীকে উদ্ধার করতে গিয়ে সিপিপি’র অন্তত ১৫জন স্বেচ্ছাসেবক জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়ে জীবন দিয়েছে। যার মধ্যে তিনজন মহিলা কর্মীও ছিলেন।
দেশের দক্ষিণ উপকূলজুড়ে বিস্তীর্ণ জলরাশির সঞ্চালন সুনীল ঢেউয়ের মাথায় যে রূপালী উর্মিমালা আলিঙ্গন করছে, বিশ্ব মানচিত্রে তাই বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর অন্য সব সাগরের মতই প্রকৃতির সব লীলার সঙ্গিনী হয়ে মেতে আছে আমাদের বঙ্গোপসাগরও। প্রকৃতির সাথে সাগরের বিচিত্র লীলার যে ভয়ঙ্কর রূপ, তার অস্তিত্ব অনুভব করতে গিয়ে উপকূলবাসীকে বারবারই চরম মূল্য দিতে হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপ পরবর্তী পর্যায়ে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ ধরে ছোবল দেয়। প্রকৃতির তা-ব এদেশের উপকূলবাসীকে বারবারই বিপন্ন করে দিয়েছে। এমনকি প্রকৃতির এ রুদ্র লীলায় আজ পর্যন্ত দেশের উপকূলভাগের কত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে তার কোনো সঠিক হিসাবও কারো জানা নেই। একইভাবে প্রকৃতির তা-বে উপকূলবাসীর সম্পদের ক্ষতিও অপরিসীম। বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তির কারণ ও এর গতিপথ নির্ণয় করা সম্ভব হলেও এর নিয়ন্ত্রণ আজও মানুষের সাধ্যের বাইরে। তবে দুর্যোগ মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করলে জানমালের ক্ষতির পরিমাণ যে হ্রাস করা সম্ভব, তা ’৭০-এর হারিকেনের তা-বের অনুরূপ ২০০৭-এর ‘সিডর’-এ প্রমাণিত হয়েছে। সিডরের ভয়াবহতা ’৭০-এর সমপর্যায়ের হলেও প্রাণহানির পরিমাণ ছিল অতি নগণ্য। যা সম্ভব হয়েছে উপকূলবাসীকে আগাম সতর্ক করার পাশাপাশি তাদের নিরপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাবার মতো কাজটি দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করার কারণেই।
’৭০-এর হারিকেনের তীব্রতায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতির নিদারুণ অভিজ্ঞতার অলোকেই আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সহযোগিতায় বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি’ (সিপিপি) জন্মলাভ করে।
১৯৬৬ সালে লিগ অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ এবং সুইডিস রেড ক্রস সোসাইটি তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান রেড ক্রস সোসাইটির সহযোগিতায়  নিরীক্ষামূলকভাবে  দেশের উপকূলীয়  অঞ্চলে ‘প্রাক-দুর্যোগ  প্রস্তুতিমূলক  কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। ঘূর্ণিঝড়ের আগে উপকূলীয় মানুষকে সতর্ক করাসহ ঝড় পরবর্তী সময়ে দুর্গত এলাকায় জরুরি উদ্ধার ও সাহায্য পরিচালনা করাই ঐ কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল। তৎকালীন বৃহত্তর বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী ৫০ লক্ষাধিক মানুষকে তখন ওই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়।
উল্লেখিত এলাকার ২৯৯টি সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ৪৭৩ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাংকেতিক যন্ত্রাদী সজ্জিত টিম লিডার বা আনসার দ্বারা কর্মসূচিটি পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ’৬৬ সালের ওই পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও গ্রামভিত্তিক সংগঠনের অভাবসহ নিয়মিত প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও কেন্দ্রের সাথে নিবিড় যোগাযোগের অভাবে তার মাঠ পর্যায়ের কার্যকারিতা সীমিত ছিল। ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল ও নোয়াখালী উপকূলে ৫ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানিসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষতি বিষয়টির বাস্তবতা অনুধাবনে সকলকে আরো সচেতন করে তোলে। ’৭০-এর ওই ভয়াল বিপর্যয়ের পরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অনুরোধে ‘লিগ অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ’ সুষ্ঠুভাবে ‘প্রাক-দুর্যোগ মোকাবেলা কর্মসূচি’  প্রণয়নে উদ্যোগী হয়।
আর এরই আলোকে মি. হেগস্ট্রম নামে একজন বিশষজ্ঞকে বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়। হেগস্ট্রম ১৯৭১-এর শেষ দিকে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তার সঙ্গীদের নিয়ে দেশের দুর্গম উপকূলীয় এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন। তারই উপস্থাপিত সুপারিশের আলোকে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি-সিপিপি’ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ১৯৭৩ সালের জুন পর্যন্ত লিগ অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ এ কর্মসূচির আর্থিক ব্যায়ভার বহন করলেও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার এ কর্মসূচির দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে থেকে বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রস যৌথভাবে কর্মসূচিটি পরিচালনা করে আসছে।
শুরুতে কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনস থেকে বরগুনার পাথরঘাটা পর্যন্ত উপকূলের ২৪টি উপজেলার ২০৪টি ইউনিয়নের ২হাজার ৩১টি ইউনিটের মাধ্যমে একর্মসূচি পরিচালতি হলেও আজ তার পরিধি আরো ব্যাপক। বর্তমানে কর্মসূচিটি খুলনার সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। ইতোমধ্যে দেশের ১৩টি উপকূলীয় জেলার ৪০টি উপজেলার সাড়ে ৩শ ইউনিয়নের ৩ হাজার ৬৮৪টি ইউনিটের মাধ্যমে ৫৫ হাজার ২৬০ জন স্বেচ্ছাসেবক এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। যার আওতায় এখন  এক কোটি  উপকূলীয় মানুষ ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও সুনামীর মত ভয়াল প্রকৃতিক দুর্যোগের আগাম সতর্ক বার্তা লাভ করে জানমাল রক্ষায় প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এমনকি দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার ও জরুরী ত্রাণ তৎপড়তায়ও অংশ নিচ্ছেন সিপিপি’র সেচ্ছাসেবকগণ।
তবে সিপিপি’র কার্যক্রমের পাশাপাশি ১৯৭০ ও ১৯৯১-এর ঝড়গুলোর সময় উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যাও ছিল অতি সীমিত। ১৯৯১এর ঝড়ের পরে আন্তর্জতিক রেড ক্রস সহ বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থার  সহায়তায় উপকূলীয় এলাকায় বিপুল সংখ্যক আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে ওঠে। বর্তমানে দেশের উপকূলভাগে সাড়ে ৫হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৫লাখ মানুষ আশ্রয় গ্রহনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। যদিও উপকূলের কোটি মানুষের  স্থলে আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা এখনো যথেষ্ট অপ্রতুল। তবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারী স্কুল কলেজগুলোতেও আরো অন্তত ৫০ হাজার মানুষ আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। তবে উপকূলবাসীর জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে আরো আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
সিপিপি’র সেচ্ছাসেবকগণ উপকূলবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থে আবহাওয়া বিভাগ থেকে ১Ñ৩নম্বর সতর্ক সংকেত প্রদানের সাথে ১টি ও ৪ নম্বর থেকে ৭ নম্বর পর্যন্ত দুটি ও এবং  ৮ থেকে ১১নম্বর পর্যন্ত ৩টি করে বিপজ্জনক পতাকা উত্তোলেন করে থাকেন। এসব পাতাকা ও তার সংকেত এখন উপকূলের বেশিরভাগ মানুষের কাছ পরিচিত। পাশাপাশি উপকূলীয় বিভিন্ন মাছের মোকামেও এসব পাতাকা উত্তোলনের ফলে জেলেরাও নিরাপদে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারছেন।
উপকূলের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেয়া ছাড়াও সব প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইউনিয়ন পরিষদ ভবনগুলোও সার্বক্ষণিকভাবে খোলা রাখার ব্যবস্থা করছে সিপিপি’র সেচ্ছাসেবকগণ। পাশাপাশি স্থানীয় ও অদূরবর্তী বিচ্ছিন্ন দ্বীপসমূহের নারী ও শিশুদেরকে উদ্ধারসহ আশ্রয় কেন্দ্রে দ্রুত পৌঁছে দিচ্ছে। সকলকে দ্রুত নিরাপদে আশ্রয় গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে মাইকিংসহ সাইরেন বাজিয়েও সতর্ক করে থাকেন সেচ্ছাসেবকগণ। গত ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’র আঘাতের আগেই উপকূলের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে প্রায় ৫ লাখ নারী-শিশু ও বয়স্কদের আশ্রয় প্রদানে সহায়তা করেন সিপিপি’র কর্মীরা। এমনকি দুর্যোগের আগে গবাদিপশু ও মূল্যবান সামগ্রী সংরক্ষণসহ দুর্যোগ-পরিবর্তী সময়ে উদ্ধার তৎপড়তায় অংশে নিয়ে থাকেন এসব স্বেচ্ছাসেবকগণ।
সিপিপি’র এ কার্যক্রম ঢাকায় সদর দপ্তরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাধ্যমে বরিশাল সহ ৭টি আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে উপকূলের ১০৫টি ভিএইচএফ স্টেশন ও ৪০টি হাই ফ্রিকোয়েন্সী ওয়ারলেস স্টেশনের মাধ্যমে বরিশাল, বরগুনা, বাগেরহাট, বরগুনা, খুলনা, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর থেকে কক্সবাজার উপকূল হয়ে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। এমনকি ১৯৯১-এর ঝড়ের পরে দুবলার চরেও একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র সহ সিপিপি’র কার্যক্রম সম্প্রসারন করা হয়েছে। ফলে প্রতি বছর মে এবং অক্টোবর-নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড়ের মওশুমে দুবলার চরে সিপিপি’র কর্মীরা জেলেদের ঝড় জলোচ্ছ্বাসের আগাম সতর্কতা প্রদানসহ নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণে সহায়তা করছে। ইতোমধ্যে বাগেরহাট হয়ে খুলনার সুন্দরবন উপকূলীয় ৫টি উপজেলাতেও সিপিপি’র কার্যক্রম সম্প্রসারন করা হয়েছে।
জাপান সহ বিভিন্ন দেশ সিপিপি’র টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কে আর্থক ও কারিগরি সহায়তাও প্রদন করে আসছে। সুইডিস রেডক্রসও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।
দেশের বিশাল উপকূলের কোটি মানুষের কাছে সিপিপি আজ একটি জনপ্রিয় নাম। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি দেশে কোনো পুরস্কার না পেলেও ইতোমধ্যে থাইল্যান্ডের ‘স্মিথ টুম মেমোরি ফান্ড পুরস্কার’ লাভ করেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিরলস কাজ ৫৫ হাজার কর্মীর
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ