Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ব্যবসায়ীরা নয়া আতঙ্কে

প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪২ পিএম, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৬

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : নয়া আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের জন্য হুমকি হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা এনবিআর’র হয়রানি কোনটাই নয়; নতুন সমস্যার নাম করফাঁকি রোধে র‌্যাবের সম্পৃক্ততার প্রস্তাব। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ফাঁকি রোধে অভিযানে নামার প্রস্তাব দিয়েছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব)। র‌্যাবের এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করেছে শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তারা এটিকে ‘নয়া আতঙ্ক’ হিসেবে দেখছেন। একই সঙ্গে এটাকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে র‌্যাবের এ  প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একই সঙ্গে র‌্যাবের প্রস্তাব বিবেচনায় না নেয়ার পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে এনবিআরকে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। ভ্যাট আদায়ে এনবিআরের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে র‌্যাবের আগ্রহ নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ হলে তা অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অর্থসচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের মতে, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ের দায়িত্ব র‌্যাবকে দেয়া হলে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাদের মতে, হরতাল-অবরোধসহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, ভ্যাট আদায়ে র‌্যাব নামানো হলে তারচেয়েও ক্ষতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, এমন উদ্যোগ অপ্রয়োজনীয়। তাঁরা বলছেন, এটা একটা বিশেষায়িত কাজ। কেবল এনবিআরের সেই অভিজ্ঞতা আছে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলি খান বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাজ তাদেরই করতে দিতে হবে। এটা র‌্যাবের কাজের মধ্যে পড়ে না। এ প্রস্তাব মেনে নিলে ব্যবসায়ীদের প্রতি অবিচার হতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, জনবল ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা সক্ষম করে এনবিআরকেই এই দায়িত্ব পালন করা উচিত।
বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, র‌্যাবের দায়িত্ব ভ্যাট আদায় নয়; যার যা দায়িত্ব তারই পালন করা উচিত বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, মুখের কাজ নাক দিয়ে করলে যেমন হবে না। তেমনি র‌্যাবের কাজ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, তাদেরকে দিয়ে ভ্যাট আদায়ও সম্ভব নয়।      
এফবিসিসিআইয়ের উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ বলেন, নতুন ভ্যাট আইন পাস হয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে তা কার্যকর হবে বলে বাজেট বক্তব্যে ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মাঝপথে এ ধরনের উদ্যোগ স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নের জন্ম দেবে। ভ্যাট নিয়ে যে কোনো দেশের আইনি পরিবর্তনের তথ্য সরাসরি পান উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে ভ্যাট আদায়ের নজির বিশ্বের কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেছেন, সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের ভ্যাট ফাঁকি ধরতে এনবিআরকে র‌্যাব যে প্রস্তাব দিয়েছে তা অযৌক্তিক। এটা একটা নতুন আতঙ্ক। আমরা ভ্যাট দিতে চাই, হয়রানি চাই না। এক টাকার ভ্যাট দিতে ৩ টাকার হয়রানি হতে হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। মাতলুব আহমাদ বলেন, সরকার, এনবিআর এবং আমরা (ব্যবসায়ীরা) সবাই বন্ধু। তাই এরকম  কোনো নীতি হওয়া উচিত নয়। যেখানে আমরা আতঙ্কিত হই। একই সঙ্গে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের সমন্বয় অনেক বেড়েছে। যেসব সমস্যা আছে সেগুলো দূর করার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের গভীর আলোচনা হচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অনেক বেড়েছে। ভারতের আদানি ও রিলায়েন্সের মতো বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে আসার আগ্রহ দেখাচ্ছে।
র‌্যাবের এ প্রস্তাবের বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রেসিডেন্ট ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা তপন চৌধুরী বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই অভিযান পরিচালনা কেন করবে, তা ঠিক বোধগম্য নয়। এ জন্য এনবিআরের নির্দিষ্ট লোক আছে, যারা এই কাজে অভিজ্ঞ। যার কাজ তাকে দিয়ে করাতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসডেন্ট এ কে আজাদ বলেছেন, ভ্যাট ফাঁকি রোধে র‌্যাব মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করলে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রাজস্ব আদায় ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।
গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ভ্যাট আদায় এনবিআর’র কাজ। তারা সঠিকভাবে করলেই হয়। ভ্যাট আদায়ে র‌্যাবের আগ্রহ সম্পর্কে তিনি বলেন, র‌্যাবকে দিয়ে ভ্যাট আদায় করা ঠিক হবে কিনা তা সরকার নির্ধারণ করবে। তবে এটা এনবিআর’র নিজস্ব ভাবমর্যাদার বিষয়।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এস এ কাদের কিরণ বলেছেন, খাদ্যে ভেজালসহ অন্যান্য আইনের আওতায় র‌্যাব অভিযান চালালে আপত্তি নেই। তিনি বলেন, এমনিতেই ভ্যাট অফিসারদের হুমকি-ধমকিতে ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ। তারপর আবার নতুন করে ভ্যাট ফাঁকি রোধে র‌্যাবকে দিয়ে অভিযান চালানো হলে তা প্রতিহত করা হবে।
এনবিআরের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ব্যবসায়ীরা এমনিতেই ভ্যাট কর্মকর্তাদের দোষারোপ করে থাকেন, হয়রানির অভিযোগ করেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানোর অনুমোদন দিলে তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তাও ভেবে দেখতে হবে। সবকিছু পর্যালোচনা করেই র‌্যাবের প্রস্তাবের জবাব দিতে হবে।
অবশ্য র‌্যাবের এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে র‌্যাবের বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সহযোগিতা করতেই এ প্রস্তাব দিয়েছি। বর্তমানে আমরা স্বাস্থ্য, বিএসটিআইসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করছি। আমাদের বেশির ভাগ অভিযানই সফল ও প্রশংসিত। তিনি বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, দোকানগুলো থেকে ঠিকমতো ভ্যাট আদায় হচ্ছে না। সারা বিশ্বেই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক জরিমানা করা হচ্ছে। আমাদের দায়িত্ব দিলে আমরা সেটাই করব।
উল্লেখ্য, ব্যবসায়ীদের ভ্যাট ফাঁকি ধরতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানোর ক্ষমতা চেয়েছে র‌্যাব। সম্প্রতি রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দিয়ে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এর তফসিলে ভ্যাট আইনকেও অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানিয়েছে দেশের আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি। বর্তমান আইনে এনবিআর ভ্যাট আদায় ও ভ্যাট ফাঁকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। ভ্যাট ফাঁকি রোধে ভ্যাট গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করে। আর ভ্যাট আইনের ২৪ ধারায় বলা রয়েছে, চাইলে এনবিআর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নিতে পারবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যবসায়ীরা নয়া আতঙ্কে

২৯ জানুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ