Inqilab Logo

বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্ডারওয়ার্ল্ডে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি

চট্টগ্রামে অক্ষত চোরাচালান নেটওয়ার্ক

প্রকাশের সময় : ২৭ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে এখন অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। বাড়ছে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। তুচ্ছ ঘটনায়ও ব্যবহার হচ্ছে ভারী অস্ত্র। র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে মাঝে মধ্যে অবৈধ কিছু অস্ত্র ধরা পড়ছে। তবে মামলা তদন্তে দুর্বলতাসহ নানা কারণে এসব কালো অস্ত্রের নেপথ্যে যারা তারা থেকে যাচ্ছে আড়ালে। অক্ষতই থেকে যাচ্ছে অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান নেটওয়ার্ক। চোরাচালানি সিন্ডিকেটের হাত হয়ে এসব অস্ত্র চলে যাচ্ছে অপরাধীদের হাতে। আন্ডারওয়ার্ল্ড বা পাতাল জগতের বাসিন্দাদের ভা-ার দিনে দিনে সমৃদ্ধ হচ্ছে।
র‌্যাব-পুলিশের হাতে দেশে তৈরি অস্ত্রের সাথে হরেক রকমের বিদেশী অস্ত্রও ধরা পড়ছে। হালকা বা ছোট অস্ত্রের পাশাপাশি ভারী যুদ্ধাস্ত্রও উদ্ধার হচ্ছে। মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে চারটি স্বয়ংক্রিয় বিদেশী পিস্তল। দুই মাসে নগরীতে ধরা পড়েছে এ ধরনের ৬টি পিস্তল। গত দেড় বছরে র‌্যাব-পুলিশের হাতে অন্তত ১৫টি ভয়ঙ্কর যুদ্ধাস্ত্র একে-২২ রাইফেলসহ বেশ কিছু ভারী অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।
অস্ত্রের ব্যবহারও বেড়েছে। ছিনতাই, ডাকাতি, দস্যুতা, দখল-বেদখল, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সহিংসতায়ও ব্যবহার হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও অস্ত্রবাজি থেমে নেই। শাসক দলের উপদলীয় কোন্দলকে ঘিরে সহিংস ঘটনায়ও গুলির শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে বিশেষ বিশেষ এলাকা। এ অঞ্চলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের তা-ব বেড়ে যাওয়ায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক বাড়ছে।
একসময় চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর ভা-ার অস্ত্র গোলাবারুদের বিশাল মজুদ ছিল। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের হাতে মানুষ ছিল জিম্মি। এলিট বাহিনী র‌্যাবের অপারেশন শুরু হওয়ার পর অপরাধীদের সা¤্রাজ্যের পতন হতে শুরু করে। একের পর এক অভিযানে ধরা পড়ে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ। অপরাধীরা তাদের গোপন অস্ত্রের ভা-ার ফেলে পালাতে থাকে। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের অনেকেই গ্রেফতার হয়। দেশ ছেড়ে পালায় অনেকে। ক্রসফায়ার আর এনকাউন্টারে বেঘোরে মারা যায় অসংখ্য শীর্ষ সন্ত্রাসী। জনমনে ফিরে আসে স্বস্তি। বিশেষ করে সন্ত্রাসের ভয়াল জনপদ হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও রাউজানের আন্ডারওয়ার্ল্ড ল-ভ- হয়ে পড়ে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সন্ত্রাসকবলিত এলাকার বাসিন্দারা।
তবে সে অবস্থা এখন আর নেই। এসব এলাকায় ফের সংগঠিত হচ্ছে অপরাধীরা। চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি এলাকায় এখন নানা নামে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠছে। তাদের ভা-ারে জমা হচ্ছে হরেক রকম দেশী-বিদেশী অস্ত্র। র‌্যাবের অভিযানে ভেঙে পড়া অস্ত্র পাচারকারী সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্কও সচল হয়ে ওঠে। সীমান্ত পথে আসা অস্ত্রের চালান এসব চোরাকারবারিদের হাত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে। মহানগরী ও জেলার পাতাল জগতের বাসিন্দাদের হাতে এখন অস্ত্রের ছড়াছড়ি।
রোববার সকালে নগরীর চান্দগাঁও থানার এক কিলোমিটার এলাকায় সৌদিয়া পরিবহনের একটি বাসে অভিযান চালিয়ে দু’টি বিদেশী পিস্তলসহ দুইজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। তাদের কাছ থেকে ৬টি ম্যাগজিন ও এক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। দুই মাস আগে নগরীর সিটি গেট থেকে একটি বিদেশী পিস্তল ও চার রাউন্ড গুলিসহ শুভাশীষ আচার্য টিটু নামে এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে আটক করে পুলিশ। আকবর শাহ থানা ও খুলশী থানা পুলিশের অভিযানেও বেশ কয়েকটি পিস্তলসহ ছোট অস্ত্র উদ্ধার হয়। গত ৭ মে হাটহাজারীর মির্জাপুরের একটি ভোটকেন্দ্রের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয় নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম রনিকে। তার কাছ থেকে একটি নাইন এমএম বিদেশী পিস্তল ও ১৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। ভোটকেন্দ্র দখলের দায়ে তাকে দুই বছরের সাজা দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে নিয়মিত মামলা হয়।
হালকা অস্ত্রের পাশাপাশি অপরাধীদের কাছ থেকে ভারী অস্ত্রও উদ্ধার হচ্ছে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে নগরীর অদূরে হাটহাজারীর আমান বাজার থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির কমান্ডার ফারদিনের কাছ থেকে আমেরিকার তৈরি একটি সেমি অটো ¯œাইপার রাইফেল উদ্ধার করে ডিবি। ওই রাতেই ডিবির সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় ফারদিন। ফলে ওই অস্ত্রের রহস্য জানা যায়নি।
তার আগে নগরীর সদরঘাট থানা এলাকায় ছিনতাই করতে গিয়ে নিজেদের বোমায় নিহত হয় কথিত দুই জঙ্গি। মাঝিরঘাটে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে ৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় তারা। এসময় জনতা এগিয়ে এলে ছিনতাইকারীরা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। তবে ককটেলের আঘাতে তারা নিজেরাই আহত হয়। পরে দুই ছিনতাইকারী মারা যায়। তিন দিন পর মারা যান গুলিবিদ্ধ ব্যবসায়ী সত্য গোপাল। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ছিনতাইকারীদের ২টি একে-২২ রাইফেলসহ কিছু অস্ত্র, গুলি ও ছিনতাইকৃত টাকা উদ্ধার করে। পরে জানা যায় নিহত দুই ছিনতাইকারী ছিল জেএমবি জঙ্গি। এর আগে নগরীর হালিশহর ও পাঁচলাইশ থানা এলাকা এবং বাঁশখালীতে অভিযান চালিয়ে কথিত জঙ্গি সংগঠন হামজা ব্রিগেড সদস্যদের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি একে-২২ রাইফেলসহ ভারী অস্ত্র উদ্ধার করে র‌্যাব।
জঙ্গিদের মতো রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের ভা-ারেও মিলছে একে-২২ রাইফেলের মতো যুদ্ধাস্ত্র। গত ১৮ আগস্ট সাতকানিয়ায় হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ইউপি সদস্য ও যুবলীগ নেতার ডোবা থেকে উদ্ধার করা হয় স্বয়ংক্রিয় একে-২২ রাইফেল, ৬টি গুলি, ২টি ম্যাগজিন, ৩টি এলজি, ৩ রাউন্ড ৭.৬৫ বোরের গুলি এবং ৭ রাউন্ড কার্তুজ। সাতকানিয়ার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা গ্রামে হত্যা মামলার আসামি যুবলীগ নেতা মাহফুজুল হকের ডোবা থেকে এসব অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি। মাহফুজুল হক সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের এক নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এবং ইউনিট যুবলীগের সহ-সভাপতি।
তার আগে চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে এক যুবলীগ নেতার বাড়িতেই পাওয়া যায় ২৩টি দেশী-বিদেশী অস্ত্র। যুবলীগ নেতা মো: শাহেদ উল্লাহকে একটি অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়। পরে তার দেখানো মতে তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আরো ২২টি দেশী-বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে র‌্যাব ও কোস্টগার্ড। উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি একে-২২ রাইফেল, ২টি বিদেশী পিস্তল, ২টি বিদেশী রিভলবার, ৪টি ওয়ান শুটারগান।
পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালানি চক্রের নেটওয়ার্ক হয়ে কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলার সীমান্ত পথে এসব বিদেশী অস্ত্র আসছে। চোরাচালানি চক্রের স্থানীয় এজেন্টদের হাত হয়ে তা চট্টগ্রামসহ সারা দেশে অপরাধীদের হাতে চলে যাচ্ছে। সীমান্তে তৎপর বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীও এসব অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত। জঙ্গি ফারদিনের কাছ থেকে উদ্ধার করা ¯œাইপার রাইফেলটি বান্দরবানের একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছ থেকে জোগাড় করা হয়েছিল বলে ডিবির কাছে তথ্য আসে। জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ছাড়াও পেশাদার ও রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররাও ওই সব বাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র কিনে আনছে।
চট্টগ্রাম থেকে অস্ত্র নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার পথে প্রায়ই অস্ত্রসহ পাচারকারী চক্রের সদস্য ধরা পড়ছে। তবে এসব অস্ত্র বহনকারীদের কাছ থেকে পরবর্তীতে তেমন কোনো তথ্য বের করতে পারছে না মামলার তদন্তকারী সংস্থাগুলো। ফলে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা অধরা থেকে যাচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অস্ত্র চোরাচালানের সাথে জড়িতরা কখনো সামনে আসে না। তারা এসব পরিবহনের জন্য টাকার বিনিময়ে কিছু বাহককে ব্যবহার করে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আন্ডারওয়ার্ল্ডে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ