Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধরলা এখন মরা গাঙ

গ্রীধারি নদীর ওপর ভারতের বাঁধ : একতরফা পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশের তীব্র আপত্তি

প্রকাশের সময় : ২৭ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:১৯ পিএম, ২৬ মে, ২০১৬

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : ভারতের একতরফা পানি আগ্রাসনের ফলে তিস্তা, গঙ্গা ও পদ্মাসহ বাংলাদেশের অনেক নদী এখন মৃত প্রায়। এবার সে আগ্রাসনে ধরলা নদী পরিণত হলো মরা গাঙে। বাংলাদেশের তীব্র আপত্তিকে উপেক্ষা করে ভারত গ্রীধারি নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করেছে। ভারত থেকে নেমে আসা গ্রীধারি নদী ধরলার সাথে মিলিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ফলে এই বাঁধের বিরূপ প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে ধরলা নদীতে ভয়াবহ নাব্যতা সঙ্কট দেখা দেয়। ধরলা পরিণত হয় মরা গাঙে। আর বর্ষায় এই নদীতে দেখা দেয় ব্যাপক ভাঙন। স্থানীয় অধিবাসীরা জানায়, এই বাঁধ নির্মাণের ফলে আসন্ন বর্ষায় ধরলা নদীর ভাঙন আরও প্রকট হবে। এই বাঁধের বিরূপ প্রভাবে গেল বর্ষাতেও ধরলা নদীর ভাঙন তীব্র হয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসনের ভাষ্যমতে, গেল বর্ষায় ধরলা নদীর ভাঙনে অসংখ্য ঘরবাড়ী, আবাদি জমি, স্থাপনাসহ কমপক্ষে ২ শতাধিক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
গ্রীধারি নদীতে বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনে (জেআরসি) বৈঠকে উত্থাপন করেছিল। বাংলাদেশের আপত্তিকে পাশ কাটিয়ে ভারত এই নদীর ওপর বাঁধের নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় লিখিতভাবে বিষয়টি ভারতকে অবহিত করে। একইভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভারতকে জানানো হয়, গ্রীধারি নদীর ওপর দেয়া বাঁধ বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে কীনা-উভয় দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ সংক্রান্ত যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব দেয়। ভারত এই প্রস্তাব আমলে না নিয়ে বাঁধের নির্মাণ কাজ চালিয়ে যায়। সেইসাথে জানিয়ে দেয়, গ্রীধারি নদীর ওপর দেয়া বাঁধ বাংলাদেশের কোন ক্ষতি করবে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে যৌথনদী কমিশনের বিদায়ী সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেন গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, গ্রীধারি নদীর ওপর ভারতের দেয়া বাঁধের কারণে বাংলাদেশ কী ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে তা জানতে চেয়ে আমরা চিঠি দিয়েছিলাম। এই বাঁধ নির্মাণ না করার জন্য আমরা ভারতকে অনুরোধও করেছি। প্রয়োজনে যৌথ সমীক্ষার কথাও বলেছি। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে আমাদের আহ্বানে কোন সাড়া দেয়া হয়নি।
অপরদিকে, যৌথ নদী কমিশনের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত গত ৯ মে’র চিঠি থেকে জানা যায়, সীমান্ত পিলার ৯২৫/৯-এস হতে আনুমানিক ৬৫০ মিটার অভ্যন্তরে গ্রীধারি নদীর ওপর ভারত ক্রস বাঁধ নির্মাণ করেছে। এই বাঁধের মাধ্যমে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় গ্রীধারি এবং ধরলা নদী (বাংলাদেশ অংশ) শুষ্ক মৌসুমে মরে যায়। আর এই বাঁধ নির্মাণ করায় বর্ষা মৌসুমে গ্রীধারি নদীর পানি ধরলা নদীর মূল ধারায় ফেরত যেতে না পারায় বাংলাদেশ অংশে বন্যা দেখা দেয়। এতে করে এলাকার কৃষি জমি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জনসাধারণের অর্থনৈতিক ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
যৌথ নদী কমিশনের পরিচালকের চিঠিতে আরও বলা হয়, এই বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরুর সাথে সাথেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১২৪ বিএসএফ ব্যাটালিয়নকে প্রতিবাদলিপি দেয়া হয়েছিল। এছাড়াও ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠকেও জোর প্রতিবাদ জানানো হয়। চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি কোলকাতায় ভারত-বাংলাদেশ জেআরসি কারিগরী পর্যায়ের বৈঠকে গ্রীধারি নদীর ওপর ক্রস বাঁধ নির্মাণের ব্যপারে আলোচনা হয় এবং উভয় দেশের প্রধান প্রকৌশলী পর্যায়ে যৌথভাবে বাঁধ এলাকা পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত হয়। চিঠিতে মৃতপ্রায় ধরলা নদীকে রক্ষায় উভয় দেশের জেআরসি কারিগরী কমিটিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আতিকুর রহমান জানান, উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী থাকাকালে আমি গ্রীধারি বাঁধ নিয়ে ভারতের সাথে বৈঠক করেছি। তারা আমাদের জানিয়েছেÑ এই বাঁধ বাংলাদেশের কোন ক্ষতি করবে না। তবে বাঁধ এলাকা আমাদের সরজমিনে দেখানো হয়নি। তাই বাঁধের প্রকৃত অবস্থা না দেখা বলা কঠিন যে, এই বাঁধ আমাদের জন্য কতটা বিপদ ডেকে আনবে।
জানা যায়, গ্রীধারি নদী ভারতের উৎপত্তি হয়ে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারি উপজেলার দুর্ঘাপুর ইউনিয়নের নামমাটারি এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। নদীটি আনুমানিক সাড়ে ৪ কিলোমিটার বাংলাদেশের ভূখ- দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লালমনিরহাট জেলার কুঠিবাড়ির দিয়ে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে। প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে এটি ধরলা নদীর সাথে মিলিত হয়। অতীতে শতবর্ষের এই ধরলা নদী পানিপ্রবাহ কখনো শুকিয়ে না গেলেও গত দুই বছর ধরে এই নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।
যৌথ নদী কমিশন ও পাউবো সূত্র জানায়, ধরলা নদীতে এই শুষ্ক মৌসুমে কোন নাব্যতা ছিল না। ছিল শুধু ধূধূ বালুর চর। এই নদীর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণের আগে নদীটি ছিল নিয়ন্ত্রিত ও খুবই খরস্রোতা। এটি লালমনিরহাটবাসীর জন্য এক সময় আর্শীবাদ ছিল। এই নদীর পানি সেচসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হতো। গ্রীধারি নদীতে বাঁধের কারণে ধরলার বাংলাদেশ অংশে পানি না থাকলেও ভারতীয় অংশ শুষ্ক মৌসুমে থাকে পানিতে টইটুম্বর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান ইনকিলাবকে বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের অভিন্ন ৫৪টি নদী রয়েছে। বাংলাদেশ এসব অভিন্ন নদীর পানির নায্য হিস্যা নিয়ে ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা গঙ্গা নদীর পানি নিয়ে ভারতের সাথে ত্রিশ বছর মেয়াদি চুক্তি করেছি। আশা করি, তিস্তা নিয়েও ভারতের সাথে চুক্তিতে উপনীত হতে পারবো। আর ধরলাসহ আরও ৬টি নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সাথে আমাদের আলোচনা চলছে।
জাফর আহমেদ খান বলেন, গ্রীধারি নদীর ওপরে বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশ কী ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে তা যৌথভাবে খতিয়ে দেখার প্রস্তাব দিয়েছি ভারতকে। ভারত আমাদের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমেই আমরা সকল সমস্যার সমাধান করতে চাই।



 

Show all comments
  • ইব্রাহিম খলিল ২৭ মে, ২০১৬, ৪:০৮ পিএম says : 0
    পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া উচিত।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধরলা এখন মরা গাঙ

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ