Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষা আইন-২০১৬ : কতিপয় পরামর্শ

প্রকাশের সময় : ২৬ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ ইয়াছিন মজুমদার

সরকার শিক্ষা আইন-২০১৬ -এর খসড়া প্রকাশ করেছে এবং পরামর্শ আহ্বান করেছে। শিক্ষা আইনের কয়েকটি ধারা শিক্ষার উন্নয়নে অন্তরায় হবে মনে করে এ বিষয়ে কিছু পরামর্শ প্রদান করছি।
১) ধারা ৬০ উপধারা ২ -এ বর্ণিত স্থগিত বেতন-ভাতার সরকারি অংশের কোনো বকেয়া প্রদান করা হবে না। পরামর্শ : একজন শিক্ষক অথবা একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাথে অনৈতিক সুবিধা না পেয়ে বা বিভিন্ন কারণে পরিচালনা কমিটির কোনো সদস্যের বিরোধ হতে পারে, প্রতিহিংসার শিকার হতে পারে, রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হতে পারে। এমতাবস্থায় অধিকাংশ সময় দেখা যায়, কমিটি একটি মিটিং করে কারণ দর্শানোর পরই কোনো তদন্ত ছাড়া সাময়িক বরখাস্ত করে বেতন-ভাতা স্থগিত রাখে বা অর্ধেক প্রদান করে। পরবর্তীতে তদন্তে বা আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে তিনি যদি নির্দোষ প্রমাণিত হন তবে স্থগিত সময়ের বেতন না পাওয়া সম্পূর্ণ অমানবিক। তাই কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনীত ব্যবস্থায় তিনি যদি নির্দোষ প্রমাণিত হন তবে তার বকেয়া বেতন-ভাতা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ছাড়া বেতন-ভাতা স্থগিত রাখা বা সাময়িক বরখাস্ত করা যাবে না, এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ২) ধারা ৩১ উপধারা ১ এ-তে বর্ণিত বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার ব্যবহার অব্যাহত থাকবে। পরামর্শ : আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম হওয়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। ইউরোপে ইংরেজির ব্যবহার থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে আরবি ভাষা ব্যবহারিত হয়। শিক্ষা বিভাগের একদল লোক ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার মাদ্রাসা পরিদর্শনে গিয়ে অবাক হন, সেখানে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে আরবি শিখছে কারণ আরবি শিখে মধ্যপ্রাচ্যে গেলে যে বেতনে চাকরি পাওয়া যায়, ভাষা শেখা ছাড়া গেলে তার অর্ধেক বেতন পাওয়া যায়। বাংলাদেশিরা ভাষা শিখতে শিখতেই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা দেশের রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই শিক্ষার সব স্তরে বাংলা ইংরেজির পাশাপাশি ১০০ নম্বর আরবি সাহিত্য বাধ্যতামূলক করা হোক।
৩) ধারা ২১ উপধারা ৫ -এর বর্ণনা মতে, কোনো ধরনের গাইড বই, নোট বই প্রকাশ করা যাবে না। পরামর্শ : বর্তমানে শ্রেণী কক্ষে ৭০-৮০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে ৩৫-৪০ মিনিটের একটি পিরিয়ডে কোনোভাবেই তাদের যথাযথ পাঠদান সম্ভব হয় না। এ বিষয়টি তখনই বাস্তবায়ন করা যাবে যখন একটি শ্রেণী কক্ষে ছাত্র সংখ্যা ২০-২৫ জনে সীমিত হবে এবং প্রতি পিরিয়ড কমপক্ষে ৫০ মিনিটে হবে। গাইড বই নিষিদ্ধ করা হলেও নোট বই কখনই নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না। আমি একজন শিক্ষক, শিক্ষা নিয়ে চিন্তা গবেষণাও করি। আমি আমার সন্তানকে নোট বই কিনে দিয়েছি কারণ এতে প্রতিটি শব্দের শাব্দিক অর্থ দেয়া আছে। বিশেষ করে ইংরেজি, আরবি বিষয়সমূহে নোট বইয়ে প্রতিটি শব্দের শাব্দিক অর্থ দেয়া হয়েছে। যদি নোট বই না থাকত তবে তাকে অভিধান খুঁজে খুঁজে শব্দার্থ বের করতে হতো। এতে তার প্রচুর সময় অপচয় হতো। তাছাড়া ছাত্রদের সবাই সমান মেধাবী নয়। ক্লাস থেকে পড়া বুঝে আয়ত্ত করে আসা সব ছাত্রের পক্ষে সম্ভব হয় না। নোট বই তাদের সে অসম্পূর্ণতা পূরণ করে দেয়। না বুঝে মুখস্থ বিদ্যা অর্জন থেকে বিরত রাখতে গাইড বই নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, তবে নোট বই নয়। এতে প্রকাশনা সংস্থার সাথে জড়িত শত শত লোকের আয় রোজগারের ব্যবস্থা যেমনি বন্ধ হবে না, ছাত্রদেরও ক্ষতি হবে না। তবে কোন নোটটি কত পৃষ্ঠার এর মূল্য সঠিক কত হতে পারে তা সরকার নির্ধারণ করে দিলে প্রতিষ্ঠানে ডোনেশান দিয়ে বইয়ের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করার প্রবণতা কমবে।
৪) ধারা ২৬ উপধারা ২ -এ এনটিআরসিএর পরিবর্তে এনটিএসসির মাধ্যমে সরাসরি শিক্ষক নিয়োগ করা হবে (এতে পরিচালনা কমিটির কর্তৃত্ব থাকবে না)। পরামর্শ : ইতোপূর্বে নিবন্ধনের মাধ্যমে শিক্ষকতার যোগ্য ঘোষিত ব্যক্তিকে পরিচালনা কমিটি বাছাই করে নিয়োগ দিত। এতে একবার নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ বাছাই করত দ্বিতীয়বার পরিচালনা কমিটি বাছাই করত। ফলে কোনো এক স্তরে দুর্নীতি হলেও অন্য স্তরের বাছাইয়ের কারণে মেধাবীরাই শিক্ষক হতো। শিক্ষা আইন মোতাবেক একবার বাছাই হবে। যদি কোনোভাবে এ স্তরে দুর্নীতি হয় তবে মেধাহীন শিক্ষক নিয়োগ পেলে মেধাহীন শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের জন্য বোঝা হবে। তাই শিক্ষক নিয়োগে কোনোভাবে যেন দুর্নীতি না হয় সে বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
৫) ধারা ২০ (খ) মাদ্রাসা শিক্ষা, উপধারা ২ অনুযায়ী, বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ গণিত, বাংলাদেশ স্টাডিজ, জলবায়ু পরির্বতন, পরিবেশ পরিচিতি, বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক হবে। পরামর্শ : সাধারণ শিক্ষার সব বিষয় এবং সেই সাথে আরবি ও ধর্মীয় বিষয়সমূহ মিলে মাদ্রাসার সিলেবাস অনেক বেশি, বিষয় বেশি কিন্তু সে হিসেবে শিক্ষক বেশি দেয়া হয় না। ফলে যথাযথ পাঠদান ব্যাহত হয়। একজন ডাক্তারকে কেউ প্রশ্ন করে না তুমি প্রকৌশল বিদ্যা জান কিনা আবার প্রকৌশলীকে প্রশ্ন করা হয় না তুমি ডাক্তারি জান কিনা। দেশে স্কুল-কলেজের অভাব নেই। অধিকাংশ অভিভাবক ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য সন্তানকে মাদ্রাসায় ভর্তি করায় না। ভর্তি করায় যোগ্য আলেম হওয়ার জন্য। সাধারণ শিক্ষার আধিক্য ভালো আলেম হওয়ার পথে অন্তরায়। যতটুকু সাধারণ শিক্ষা হলে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা যায় তার অধিক সাধারণ শিক্ষার বোঝা মাদ্রাসা থেকে কমিয়ে দিতে হবে এবং বিষয়ের আধিক্য হেতু শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
৬) ধারা ২০ (গ) এর উপধারা ৩ মতে, সরকার কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন ও যুগোপযুগী করার প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেবে। পরামর্শ : কওমি মাদ্রাসায় এখনো ভালো আলেম হওয়ার মতো সিলেবাস আছে। যুগোপযুগী করার নামে সাধারণ বিষয়ের আধিক্য মৌলিক শিক্ষাকে যেন বিনষ্ট না করে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
৭) ধারা ১৫ (ঘ) উপধারা ৪ মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও অন্যান্য সদস্যের যোগ্যতা নির্ধারিত হবে। পরামর্শ : সভাপতি সমপর্যায়ের প্রতিষ্ঠান প্রধান বা অবসরপ্রাপ্ত প্রধানকে করা প্রয়োজন। কেননা তিনি নিজে প্রতিষ্ঠান প্রধান হওয়ায় আইনকানুন বুঝবেন ও ফাঁকফোকর সম্পর্কে জানবেন বিধায় সদিচ্ছা থাকলে অন্যায় দূর করা সম্ভব হবে।
৮) ধারা ১০ (ঙ) উপধারা ১ অনুযায়ী, সকল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। পরামর্শ : জনসংখ্যার তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম হওয়ায় বেসরকারিভাবে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানসমূহ শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। নিবন্ধনের ঝামেলা পোহানোর ভয়ে এরূপ প্রতিষ্ঠান স্থাপন কমে যাবে। ফলে ভর্তি সমস্যা ইত্যাদি বৃদ্ধি পাবে।
৯) প্রথম অধ্যায় ৫ এর ১ অনুযায়ী, সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক হবে। পরামর্শ : স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং মাদ্রাসা যেগুলোতে প্রথম শ্রেণী থেকে একাদশ, দ্বাদশ বা ¯œাতক পর্যন্ত আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বেসরকারি শিক্ষকদের ইনক্রিমেন্ট, বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, স্টেশনারি, আসবাবপত্র, ভবন তৈরি ও অন্যান্য সুবিধা সরকার দেয় না বললেই চলে। ফলে প্রতিষ্ঠান থেকে এগুলো মিটাতে হয়। এতে সব শ্রেণীর শিক্ষার্থী থেকে বেতন গ্রহণ করতে হয়। তাই প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্রদের জন্য টিউশন ফি বা ভর্তুকী প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রাইমারি স্কুলের সব শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পেলেও মাদ্রাসার প্রাইমারি শাখার ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তি দেয়া হয় না। অতিসত্বর মাদ্রাসার ইবতেদায়ী শাখায় উপবৃত্তি চালু করা দরকার।
১০) ধারা ৫৭ উপধারা ১ মতে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। পরামর্শ : প্রশাসন ক্যাডার যেমন উপজেলা পর্যায়ের অফিসারগণ বদলি হয়ে যে উপজেলায় যাবেন সেখানে তাদের আবাসিক ব্যবস্থা আছে। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের একজন শিক্ষক বদলিকে আতঙ্ক মনে করেন। কারণ তার জন্য কোনো বাসা বরাদ্দ নেই, তিনি কোথায় উঠবেন, কোথায় থাকবেন, চিন্তিত থাকেন। সে ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া না দিয়ে বদলি অমানবিক হবে। বাড়ি ভাড়া দিয়ে বদলি করা হলেও তা যেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো উপজেলার ভিতরে করা হয়।
১১) অতিরিক্ত পরামর্শ : পূর্বে কেজি স্কুলগুলোতে যে পরিমাণ পাঠ্যবই ছিল, বর্তমানে সরকারি সিলেবাসে তার চেয়ে বেশি বই পাঠ্য হয়েছে। কোমলমতি শিশু কিশোরদের জন্য যা পাঠভীতি সৃষ্টি করছে ও ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি হচ্ছে। পাঠ্যবইয়ের বোঝা কমাতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিক্ষা আইন-২০১৬ : কতিপয় পরামর্শ
আরও পড়ুন