পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ও উপমহাদেশের প্রথম নারী বিষয়ক সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সোমবার সকালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তার স্বামী ছিলেন প্রখ্যাত শিশু-সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই)। তিনি দুই কন্যাসহ তার অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
বার্ধক্যজনিত জটিলতা ও শ্বাসকষ্টের কারণে গত ৫ মে নূরজাহান বেগমকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
গত ৮ মে শনিবার অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। নূরজাহান বেগম অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর তার খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যয় ভার নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নূরজাহান বেগমের লাশ রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল থেকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খাতুন কুটিরে নিয়ে আসা হয়। প্রথম নামাজে জানাজা তার পুরান ঢাকার বাসভবন খাতুন কুটিরের আঙিনায় বিকেল পৌনে ৩টার দিকে সম্পন্ন হয়। এতে অংশ নেন মরহুমার স্বজন, শুভানুধ্যায়ী ও প্রতিবেশীরা। পরে বিকেল পৌনে ৪টার দিকে তার লাশ শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। সেখানে ৫টা পর্যন্ত স্বজন-শুভানুধ্যায়ী-সহকর্মীরা ফুলেল শ্রদ্ধা জানায়। এরপর নেওয়া হয় গুলশান আজাদ মসজিদে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে গতকাল রাতে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
নূরজাহান বেগমের মৃত্যুতে সমাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ঐতিহ্যবাহী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ সম্পাদক নূরজাহান বেগমের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোক বাণীতে তিনি নূরজাহান বেগমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার বর্গের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে বলেন, নারী শিক্ষা ও নারী উন্নয়নে নূরজাহান বেগমের অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তার মৃত্যু জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নূরজাহান বেগমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোকবাণীতে তিনি বলেন, তার মৃত্যুতে জাতি আজ এক মহীয়সী নারীকে হারাল। উপমহাদেশের নারী জাগরণে যিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমার শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নূরজাহান বেগমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় খালেদা জিয়া বলেন, মেয়েদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষায় সম্পৃক্ত করার মহান ব্রত নিয়েই বেগম পত্রিকা তার পথচলা শুরু করে। নূরজাহান বেগম ছিলেন এই পথচলার অগ্রদূত। খালেদা জিয়া নূরজাহান বেগম-এর রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকাহত পরিবারবর্গ, আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়াও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি শোক জানিয়েছেন।
সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমের মৃত্যুর পর পত্রিকাটি চালানোর দায়ভার নিয়েছেন তার বড় মেয়ে ফ্লোরা নাসরিন খান। জানাজা শেষে সাংবাদিকদের একথা জানান সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী ও বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর। তিনি বলেন, বেগমের সংরক্ষণ প্রয়োজন। বেগম যাতে চলমান থাকে, জনপ্রিয় থাকে সেদিকে নজর রাখতে হবে। তাই তার বড় মেয়ে এর দায়িত্ব নিয়েছেন। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
সাহিত্য ক্ষেত্রে মেয়েদের এগিয়ে আনার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতা থেকে বেগম পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে এটি ঢাকায় চলে আসে। বেগম পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক ও নূরজাহান বেগমের বাবা মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন। বেগম-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। তবে চার মাস পর থেকেই পত্রিকাটির সম্পাদনা শুরু করেন নূরজাহান বেগম। বেগম-এর প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিল ৫০০ কপি। মূল্য ছিল চার আনা। ছয় দশক ধরে বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই পত্রিকাটির মাধ্যমে নারী সমাজের বিভিন্ন স্তরে অকল্পনীয় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আর সেই পরিবর্তনের ফলেই এখন আর অবহেলিত নয় তারা। নারীদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের পৌঁছিয়ে দিয়ে সমাজের উন্নতর পর্যায়ে।
নূরজাহান বেগম চাঁদপুরের চালিতাতলীতে ১৯২৫ সালের ৪ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। মায়ের নাম ফাতেমা বেগম। নূরজাহান বেগমের স্বামী ছিলেন রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই)। তিনি পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান ছিলেন। তার পরিবার ১৯২৯ সালে গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে আসে। ‘সওগাত’ পত্রিকার দফতর ১১ নম্বর ওয়েলসলি স্ট্রিটের দোতলা বাড়িতেই তারা থাকতেন। এই অফিসেই নিয়মিত সাহিত্য মজলিস বসত। যেখানে কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হাবীবুল্লাহ বাহার, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেনসহ বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব অংশ নিতেন। এই সাহিত্য মজলিসের নিয়মিত শ্রোতা হয়ে ওঠেন নূরজাহান বেগম নূরী। তারা তাকে নূরী বলেই ডাকতেন। এই ব্যক্তিবর্গ নূরীর মানস গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন বলে পরিণত নূরজাহান বেগম বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করেন।
নূরজাহান বেগম ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে তিনি আইএ এবং ১৯৪৬ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৫২ সালে কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৯৯ সালে তার স্বামীর মৃত্যু হয়।
১৯৯৬ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্রের সন্মাননা লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে রোকেয়া পদক, ১৯৯৯ সালে গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি থেকে শুভেচ্ছা ক্রেস্ট, ২০০২ সালে অন্যান্য সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৩ ও ২০০৫ সালে নারীপক্ষ দুর্বার নেটওয়ার্ক ও কন্যা শিশু দিবস উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে তিনি সংবর্ধনা লাভ করেন। এছাড়াও তাকে সংর্বধনা জানিয়েছেন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, চট্টগ্রাম লেডিজ ক্লাব, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠী, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠন। স্বর্ণপদক পেয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, লেখিকা সংঘ, কাজী জেবুনন্নেসা মাহাবুবুল্লাহ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ সাংবাদিক ফোরাম, রোটারি ক্লাব প্রভৃতি সংগঠন থেকে। ২০১০ সালে পত্রিকা শিল্পে তার অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট-৩২৮ সম্মাননা পান তিনি।
শোকের ছায়া
উপমহাদেশে নারীদের প্রথম সাপ্তাহিত ‘বেগম’ এর সম্পাদক নূরহাজান বেগমের ইন্তেকালে দেশব্যাপী নেমে আসে শোকের ছায়া। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লেই দেশের বিশিষ্ট গুণিজন, সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গসহ, নানান সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয়।
গতকাল (সোমবার) সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ-নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। সকালে তার বড় মেয়ে ফ্লোরা নাসরিন খান গণমাধ্যমকে বলেন, সকাল সাড়ে ৮টায় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে তিনি মারা যান। ডাক্তাররা চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু এর মধ্যে দ্বিতীয়বার উনার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়।
বেগমের ইন্তেকালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা, এলজিআরডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যরাও শোক জানান।
নূরজাহান বেগমের মৃত্যুতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরউি), বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সাংস্কৃতিক ধারাসহ অসংখ্যা সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক জানানো হয়।
এছাড়াও হাজার হাজার শোকাহত মানুষ হাসপাতাল থেকে লাশ বের করা ও দাফন কার্যক্রমে অংশ নেয়। অন্যদিকে, গতকাল মানুষের মুখে মুখে ছিল নূরজাহান বেগমের মৃত্যুর খবর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।