Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফের আন্দোলনে নামছে শ্রমিকরা

সরকারি পাটকল শ্রমিকদের ধর্মঘটে নতুন মোড়

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

সরকারি পাটকলে আন্দোলন নিয়ে মন্ত্রীর সাথে শ্রমিক নেতাদের দফায় দফায় বৈঠকের পরও সমাধান হয়নি। বরং ধর্মঘট নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য বহিষ্কৃত শ্রমিকরা সরকারি পাটকলে শ্রমিক আন্দোলনের নেপথ্যে কাজ করছেন বলে সরকারের একাধিক সংস্থার তদন্তে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ইনকিলাবকে বলেন, বহিষ্কৃত শ্রমিকরা সরকারি পাটকলে শ্রমিক আন্দোলনের নেপথ্যে কাজ করছেন। আমাদের কাছে অনেক তথ্য রয়েছে শ্রমিক আন্দোলনের নামে কোনও অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের ছাড় নাই এবং নাশকতাকারীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিজেএমসিকে আর কোনও ভর্তূকী দেওয়া হবে না। সরকার আর কতো ভর্তুকি দেবে?।
সরকারি পাটকল শ্রমিকেদের বকেয়া মজুরি, মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, বরখাস্ত শ্রমিকদের পুনর্বহাল, মৌসুমে পাট ক্রয়ে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দসহ ৯ দফা দাবিতে ৭২ ঘণ্টার ধর্মঘট গত ৫ এপ্রিল শেষ হয়। এর পরে নতুন করে আন্দোলনের ঘোষনা করে সরকারি পাটকলে শ্রমিকরা। গত বৃহস্পতিবার পাট সচিবালয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এবং যশোরের এমপি কাজী নাবিল আহমদসহ শ্রমিক নেতারা বৈঠক করেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জান গেছে।
বৈঠকে বহিষ্কৃত এসব নেতারা শ্রমিকদের ৯ দফা দাবির কথা বললেও আসলে তারা আন্দোলন করছেন এক দফার ভিত্তিতে। আর তা হলে ইতোপূর্বে টার্মিনেশন ও বরখাস্ত করা শ্রমিকদের কাজে পুনর্বহাল করা। সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী ওইসব বহিষ্কৃত শ্রমিক নেতাদের পুনরায় কাজে যোগদানের আবদার নিয়ে বেশ কয়েকবার পাটমন্ত্রীর দফতরে এসেছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বিষয়টি বিব্রতকর বলে মুখ খুলছেন না কেউ। তবে শ্রমিক নেতাদের দাবি, বহিষ্কৃত বা টার্মিনেটেড শ্রমিকদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার শ্রশ্নই আসে না। কারণ তারা সংখ্যায় মাত্র পাঁচ থেকে সাত জন। আর টার্মিনেশনের শিকার শ্রমিকদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি বাদে মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন ও পাটকল গুলোর আধুনি কীকরণের অন্য দাবিগুলো মেনে নিলেই তারা আন্দোলন থেকে সরে যাবেন।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ নাছিম বলেন, আর্থিক সংগতি না থাকাসহ কয়েকটি কারণে জাতীয় মজুরি স্কেল এত দিন বাস্তবায়ন করা যায়নি। আশা করছি,শ্রমিকেরা কাজে ফিরে যাবেন। অবশ্য নতুন কাঠামোতে শ্রমিকের মজুরি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
সিবিএ সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, ৯ দফার একটি টার্মিনেশন করা শ্রমিদের চাকরিতে পুনর্বহাল। তবে আমাদের মূল দাবি হলো মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, সাপ্তাহিক বকেয়া মজুরি পাওয়া, ৫০ দশকের মেশিন গুলো আধুনিকীকরণ করা, মৌসুমে পাট কেনায় অর্থ বরাদ্দ পাওয়া, বদলি শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ। কিছু শ্রমিক নেতাকে টার্মিনেশন করা হয়েছে, তাদের সংখ্যা পাঁচ থেকে সাত জন। ওই সাত জনের জন্য এই আন্দোলন না। ওদের পুনর্নিয়োগ দিলে এই আন্দোলন প্রত্যাহারের শ্রশ্নই আসে না। আন্দোলন চলমান রয়েছে এবং চলবে।
জানা গেছে, সাধারণ শ্রমিকদের সংগঠিত করতে ৯ দফা দাবি কথা বলেছেন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শ্রমিকরা। নিয়মিত সাপ্তাহিক মজুরি ও বেতন প্রদান, সরকার ঘোষিত জাতীয় মজুরি, উৎপাদন শীলতা কমিশন-২০১৫ বাস্তবায়ন, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের পিএফ-গ্র্যাচুইটি ও মৃত শ্রমিকদের বীমার বকেয়া প্রদান, সেটআপ অনুযায়ী শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়োগ ও স্থায়ী করা, পাট মৌসুমে পাট কেনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিলগুলোকে পর্যায়ক্রমে বিএমআরই করা। কোনও রকমে সরকারকে যদি টার্মিনেশন ও বরখাস্ত শ্রমিকদের কাজে পুনর্বহাল করার দাবি বাস্তবায়নে রাজি করানো যায় তাহলে অন্য দাবি পূরণ না হলেও পাটকলে শ্রমিক আন্দোলন থেমে যাবে বলে মনে করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সরকারের নীতিনির্ধারকরা চলমান পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলনে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে জানা গেছে।
বহিষ্কৃত শ্রমিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশনের এক শ্রেণির কর্মকর্তারাও যুক্ত রয়েছেন। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ইন্ধন দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকর্তারা পাটকল শ্রমিকদের পাওনা মেটাতে সরকারের কাছে থোক বরাদ্দ চেয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বিজেএমসিকে আর ভর্তূকি বাবদ কোনও টাকা দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের আওতায় পাটকলগুলোর পাওনা মেটানোর জন্য বিজেএমসিকেই এই টাকার যোগান দিতে হবে। পাটকলগুলোকেই এই টাকার সংস্থান করতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, নিরীহ শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে চাইলেও আন্দোলনের নামে তাদের কাজে যোগ দিতে দিচ্ছে না তারা। এর জন্য দেওয়া হয় হুমকি-ধামকি। যদিও বর্তমানে ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের। অর্থ মন্ত্রণালয়ে সূত্রে জানা গেছে, সরকার বিজেএমসিকে ২০১২ সালে ১০৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা, ২০১৩ সালে ১৩৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ৬১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ৮০ কোটি ০৬ লাখ টাকা, ২০১৬ সালে ৪৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ২০১৭ সালে ৬৯ কোটি ২১ লাখ টাকা (সাময়িক) , ২০১৮ সালে ১০৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা (সংশোধিত) ভর্তুকি বাবদ দিয়েছে।
গত ৬ এপ্রিল ঢাকায় বিজেএমসির নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন পাটকল শ্রমিকদের নেতারা। ওই বৈঠকে সরকারি পাটকলে কর্মরত শ্রমিকদের দাবি পূরণের সুব্যবস্থা না হওয়ায় তারা আবারও আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন। গত ১ এপ্রিল থেকে রেলপথ ও রাজপথ অবরোধ করে শ্রমিক আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে খুলনাসহ পাটকল অধ্যুষিত শিল্পাঞ্চল। ৯ দফা দাবিতে ধর্মঘট পালনসহ রাজপথ- রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে খুলনা ও যশোরের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের শ্রমিকরা। গত ২ এপ্রিল মঙ্গলবার সকাল থেকে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলে টানা ৭২ ঘণ্টার শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়। অবরোধের ফলে খুলনা-যশোর মহাসড়ক, নতুন রাস্তা মোড় থেকে সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড সড়ক, বিআইডিসি সড়কে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়েছে। রেল চলাচলও বন্ধ ছিল। এ সময় শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল, টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করছে। শ্রমিকদের আন্দোলনে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ থাকায় মহাসড়কের যাত্রীরা পড়েছিলেন চরম দুর্ভোগে। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সরকারি পাটকল শ্রমিকদের সড়ক, রেলপথ অবরোধ, পুলিশ বক্স ও পুলিশের অ্যাম্বুলেন্সে হামলা, অজ্ঞাতপরিচয় ২০০-২৫০ শ্রমিককে আসামি করে মামলা , ট্রেনে ভাঙচুর ও পাথরের আঘাতে অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে গত সকাল ৬ টায় সরকারি ২৬টি পাটকলের শ্রমিকদের ৭২ ঘন্টার ধর্মঘট শেষ হয়েছে। আন্দোলনরত শ্রমিক নেতারা জানান, খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, স্টার, আলিম, ইস্টার্ন এবং যশোরের কার্পেটিং ও জেজেআই জুট মিলে বর্তমানে ১৩ হাজার ২৭১ শ্রমিক কাজ করছেন। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) সূত্র জানায়, খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি জুটমিলের শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ৬৪টি সপ্তাহের বেতন ও মজুরি ৪৪ কোটি ২০ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে শুধু শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া রয়েছে ৩১ কোটি ১৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে ১২ কোটি ৩৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
খুলনার প্লাটিনাম জুটমিলের শ্রমিক খন্দকার আশরাফ ইনকিলাবকে বলেন,আমাদের দাবি ৯ দফা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছিলেন বিজেএমসির কর্মকর্তারা। কিন্তু দাবিগুলো এখনও বাস্তবায়ন না হওয়ায় আন্দোলনে নেমেছি। ক্রিসেন্ট জুট মিলের শ্রমিক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিজেএমসির চেয়ারম্যান এ বছরের ২৮ মার্চের মধ্যে মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন করার আশ্বাস দিয়েছে কিন্তু হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ