Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জীর উত্থান

প্রকাশের সময় : ২২ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এই টার্মে তার প্রধান এজেন্ডা হবে দিল্লির কাছ থেকে পশ্চিমবঙ্গের ন্যায্যহিস্যা আদায়
মোবায়েদুর রহমান : তিনি একজন অতি সহজ-সরল মহিলা। অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন-যাপন করেন। তার বর্তমান বয়স ৬১ বছর। তিনি সারা জীবন তাঁতের শাড়ি পরেছেন। কোনো দিন গহনা-গাটি পরেননি, কোনো প্রসাধন সামগ্রীও ব্যবহার করেননি। কাঁধে সব সময়েই থাকে সুতি কাপড়ের একটি ঝোলা ব্যাগ। হাল ফ্যাশনের ভ্যানিটি ব্যাগ তার কাঁধে কোনোদিন শোভা পেয়েছে বলে শোনা যায়নি। তিনি আজীবন কুমারী। এর আগে এক ইন্টারভিউতে বলেছেন যে, রাজনীতির সঙ্গেই তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এই মহিয়সী নারীর নাম মমতা ব্যানার্জী, যিনি এবারের নির্বাচনে পাহাড় ডিঙ্গিয়েছেন। এই নির্বাচনে তিনি পশ্চিমবঙ্গের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে উত্থিত হয়েছেন। অনেকের জানা নাও থাকতে পারে যে, মমতা ব্যানার্জী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেছেন। তারপর তিনি শ্রী শিক্ষায়তন থেকে শিক্ষায় ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া কলকাতার যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী ল’ কলেজ থেকে তিনি আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন।
পাহাড় ডিঙ্গিয়েছেন
সেদিনের বিধান সভার নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জী অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। সর্বভারতীয় সবচেয়ে বড় দুটি দল এবং সবচেয়ে বড় প্রাদেশিক দলÑ এই ত্রি-শক্তিকে পরাজিত করে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন লাভ করে পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জননেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। যে তিনটি দলকে তিনি পরাভূত করেছেন সেই তিনটি দল হলোÑ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, যারা নির্বাচনের মাধ্যমে ইতিহাসে দীর্ঘ কয়েক বছর ভারত শাসন করেছে। এই দল অর্থাৎ কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে ২৫ বছর। আরেকটি বড় দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। এই মুহূর্তে তারা ভারত শাসন করছে। মমতা কুপোকাৎ করেছেন আরেকটি দলকে, সেটি হলো পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিএম। এই দলটি একটানা ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে। কংগ্রেস এবং সিপিএম, যারা পশ্চিমবঙ্গকে ৫৯ বছর শাসন করেছে, তারা মমতাকে ধরাশায়ী করার জন্য এবার ইলেকশনে একাট্টা হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও তারা সম্মিলিতভাবে ৭৬টির বেশি আসন পায়নি (কংগ্রেস ৪৪ + সিপিএম ৩২)। আর বর্তমান দিল্লির শাসক দল বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচনে পেয়েছে মাত্র ৩টি আসন। পক্ষান্তরে মমতা ব্যানার্জী লাভ করেছেন ২১১টি আসন। বিধান সভার আসন সংখ্যা ২৯৪টি।
অবিসংবাদিত নেতা
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১১ সালের বিধান সভার নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জী পেয়েছিলেন ১৮৪টি আসন। এবার পেয়েছেন ২১১টি আসন। অর্থাৎ বিগত ৫ বছরে তার জনপ্রিয়তা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, একটি দুটি নয়, ২৭টি আসন বেশি পেয়ে তার জয়জয়কার হয়েছে। অন্যদিকে সিপিএম আরো ডুবে গেছে। গত বারে তারা পেয়েছিল ৪০টি আসন। এবার ৮টি আসন হারিয়ে তারা পেয়েছে ৩২টি আসন। কংগ্রেসের বেড়েছে ২টি আসন। গতবার তারা পেয়েছিল ৪০টি আসন, এবার তারা পেয়েছে ৪২টি আসন। সুতরাং এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মমতা ব্যানার্জী সন্দেহাতীতভাবে এখন পশ্চিমবঙ্গের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। তবে বিজেপির জন্য অত্যন্ত ক্ষুদ্র হলেও একটি সুসংবাদ আছে। সেটি হলো, গতবারে তারা পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় একটি আসনও পায়নি। কিন্তু এবার পেয়েছে ৩টি আসন। অর্থাৎ তারা পশ্চিমবঙ্গে পা রাখার একটি জায়গা পেল। তাই বলা যায় যে, এবারের নির্বাচনে একপ্রান্তে যেমন চরম উত্থান ঘটেছে মমতা ব্যানার্জীর, অন্যপ্রান্তে তেমনি পা রাখার জায়গা পেয়েছে বিজেপি। মাঝখানে দিনে দিনে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে কংগ্রেস। আর এই ল্যান্ডস্ল্যাইড (ভূমিধস) বিজয়ের মাধ্যমে মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গের অবিসংবাদিত নেত্রী রূপে জনগণ কর্তৃক বরিত হয়েছেন।
ফোরকাস্ট ভুল প্রমাণিত
ইলেকশনের আগে ভারতের বড় বড় সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে নির্বাচনী ফলাফল সম্পর্কে একাধিক ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। এসব ভবিষ্যদ্বাণীতে মমতা ব্যানার্জীর বিগত ৫ বছরের শাসনামলের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে বলা হয়েছিল যে, এসব ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য জনগণ তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতির মধ্যে খুব বেশি করে হাইলাইট করা হয়েছিল সারদা কেলেঙ্কারী এবং নারদা কেলেঙ্কারী। এই দুটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে বারবার। বলা হয়েছে এই দুটি ঘটনায় তৃণমূল নেতারা শত শত কোটি টাকা ঘুষ খেয়েছেন। সুতরাং এবার আর মমতা ভোট পাবেন না। এসব কথা প্রচারিত হয়েছে ভারতের বড় বড় মিডিয়ায় যাদের মালিকানা রয়েছে কর্পোরেট হাউজে। আরও প্রচার করেছে বাংলাদেশের এক শ্রেণির মিডিয়া যারা পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসপন্থী বলে পরিচিত। আরও প্রচার করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের এক শ্রেণির ইসলামী জঙ্গিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জী। অতএব এই সমস্ত কারণে মমতা নির্ঘাত কুপোকাৎ হবেন।
৬টি পর্বে যখন ভোটাভুটি হচ্ছিল তখনও এই ধরনের প্রচারণা চলেছে। কিন্তু ইলেকশন যখন শেষ হলো তখন শুরু হলো এক্সিট পোল, যেটির বাংলা করা হয়েছে বুথ ফেরৎ জরিপ। এই এক্সিট পোলে রাজনৈতিক গনক সাহেবদের সুর পাল্টাতে শুরু করে। প্রথমে বলা হলো যে, মমতা অনেকগুলো আসনে জিতবেন, তবে সরকার গঠন করার মতো মেজরিটি পাবেন না। তারপর বলা হলো তাকে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। কিন্তু ১৯ তারিখের নির্বাচনী ফলাফল এসব মতলবী গণৎকারদের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে। এখন তারা মুখ লুকাবেন কোথায়?
পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষায়
মমতা ব্যানার্জী
কেন মমতার এই বিশাল জনপ্রিয়তা? এই নিয়ে নানান জন নানান রকম বিশ্লেষণ দেন। কোনোটাই মিথ্যা বা ভিত্তিহীন বলব না। আমার মতে সেগুলো অর্ধ সত্য, পূর্ণ সত্য নয়। মমতা ব্যানার্জীকে বিচার করতে হলে মমতা ব্যানার্জীর অবস্থান থেকে তাকে বিচার করতে হবে, কংগ্রেস বা বিজেপি অথবা বাংলাদেশের কোনো কংগ্রেসপন্থী দল বা মিডিয়ার চোখ দিয়ে তাকে বিবেচনা করা যাবে না। মমতা ব্যানার্জী যতদিন কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন ততদিন তিনি এক ধরনের কথা বলেছেন। কিন্তু যখন তিনি বাংলার রাজনীতিতে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন তখন তার চিন্তাধারা এবং বক্তব্য সম্পূর্ণ বদলে যায়। তার বক্তব্য-বিবৃতি পড়ে স্পষ্ট মনে হয় যে, তার বর্তমান রাজনীতি হলো বাংলার অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। তার স্ট্র্যাটেজি হলো, পশ্চিমবাংলার অর্থনৈতিক স্বার্থসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আদায় করার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে যাওয়া। পশ্চিমবঙ্গের ন্যায্য দাবি-দাওয়া দিল্লির কাছ থেকে কড়ায়-গ-ায় আদায় করাই তার বর্তমান রাজনীতির সেন্ট্রাল পয়েন্ট বলে মনে হয়। তার এই বিশাল বিজয়ে এটিই সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জীর উত্থান
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ