Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আবারও শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় বিব্রত সরকার

প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কল্যাণদীর পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ‘সরকারবান্ধব’ বিরোধীদলের সংসদ সদস্য দ্বারা লাঞ্ছিতের ঘটনায় সরকার বিব্রতবোধ করছে। ঘটনার পর থেকেই দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে ছাত্র ও শিক্ষক সমাজের মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। প্রথমে ছাত্ররা এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ‘অভিনব’ পদ্ধতিতে নিজেদের কান ধরে রাজপথে তাদের প্রতিবাদ প্রকাশ করে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুকে হ্যাসট্যাগ দিয়ে # সরিস্যার বলেও এ নিন্দনীয় ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। এরপর দেশের শিক্ষক সমাজও এ ঘটনার প্রতিবাদে দেশব্যাপী একযোগে মানব বন্ধনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়। একই সঙ্গে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও এ ঘটনাকে সমর্থন না করে নিজেদের নিন্দার কথা প্রকাশ করেন।
বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছেন শিক্ষকরা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, জাতীয় অবক্ষয়, আদর্শ ছেড়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবান্বিত শিক্ষক, দেশের রাজনীতিতে পেশিশক্তির প্রভাব বৃদ্ধি ও সুষ্ঠু কাঠামোগত ব্যবস্থার অভাবেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আর এই ঘটনাগুলো অনেকটাই বিব্রতকর পরিস্থিতি ফেলছে সরকারকে।
শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন বলছে, জাতীয় অবক্ষয়ের পেছনে শিক্ষক ও রাজনীতিবিদরা জড়িত। নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্যের এই আচরণের মধ্যদিয়ে প্রকৃতপক্ষে এই সমাজে জ্ঞান-শিক্ষার চেয়ে পেশিশক্তির মহড়া বৃদ্ধি পেয়েছে তা প্রমাণ হয়েছে। রাজনীতিতে পেশিশক্তির মহড়া যখন থেকে মূখ্য হয়ে গেছে তখন থেকে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। আজকে শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হচ্ছে ভবিষ্যতে অন্যরাও এই ধরনের ঘটনার শিকার হবে।
গত ১৩ মে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কল্যাণদীর পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি। এর আগে স্থানীয় সংসদ সদস্য ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এবং শিক্ষার্থীকে প্রহার করায় জনগণের রোষানলের শিকার স্কুলের প্রধান শিক্ষককে জনসম্মুখে কান ধরে মুচলেকা দেয়ার পর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, বিষয়টি তদন্ত চলছে। তদন্ত চলাকালীন কোনো মন্তব্য করা ঠিক নয়।
এ বিষয়ে বুধবার সচিবালয়ে এক সভা শেষে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, যে কোনো বিষয়ে নিয়মনীতি, বিধি-বিধান না মেনে পদক্ষেপ নিলে আপনারা কোর্টে চ্যালেঞ্জ করবেন। নানা কিছু আছে, বুঝে নিয়েন। এটা অতি নিন্দনীয়, সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। সকলের জন্য এটা কলঙ্কজনক ঘটনা। একজন শিক্ষকের প্রতি এমন আচরণ কখনও হতে পারে না।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, সংসদ সদস্য-যার উপস্থিতিতে ও নেতৃত্বে ঘটনা ঘটেছে সেই সংসদ সদস্যের নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবের বাইরে তদন্ত করা যাবে কিনা সে বিষয়ে বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে। এই সংসদ সদস্যকে এই ধরনের ঘটনা ঘটানোর অধিকার সংবিধান বা জনগণ দেয়নি। মানবিক মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি সংসদ সদস্যের আচরণে। ছাত্রদের সামনে শিক্ষককে এই ধরনের অপমান করার মাধ্যমে ছাত্রদের কাছে শিক্ষকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এই আচরণের মধ্যদিয়ে প্রকৃতপক্ষে এই সমাজে জ্ঞান-শিক্ষার চেয়ে পেশিশক্তির মহড়া বৃদ্ধি পেয়েছে তা প্রমাণ হয়েছে।
তিনি বলেন, শিক্ষকদের প্রতি সমাজের রাষ্ট্রের সম্মান ছিলো। রাজনীতিতে পেশিশক্তির মহড়া যখন থেকে মূখ্য হয়ে গেছে তখন থেকে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। সেই জন্য ক্রমাগতভাবে এই ধরনের ঘটছে। আজকে শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হচ্ছে ভবিষ্যতে অন্যরাও এই ধরণের ঘটনার স্বীকার হবে। জাতীয়ভাবে অবক্ষয়ের সঙ্গে শিক্ষকরা জড়িত, রাজনীতিবিদরাও জড়িত আছে। সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও একটি সুষ্ঠু কাঠামোর অভাবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের বদলে এই ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে। শিক্ষকরা দায়িত্বশীল না হলে ভবিষ্যতে জাতীয় জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে।
এই ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল বৃহস্পতিবার ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি এক বিবৃতিতে নারায়ণগঞ্জে পিয়ার সাত্তার লতিফ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে মারধর, কান ধরে উঠবস করানো এবং সর্বোপরি বরখাস্তের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সমিতি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
সমিতি মনে করে, এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা সমাজের যতই ক্ষমতাবান হোক না কেনো যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কেননা এ ঘটনা সমাজে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়কেই নির্দেশ করে।
সমিতি লক্ষ্য করছে, এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা যেকোনোভাবে পার পেয়ে যায় বলে ফের তারা এসব ঘটানোর দুঃসাহস দেখায়। তারা এতটাই লাগামহীন যে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানোর পরে সারাদেশে এমন আন্দোলন-প্রতিবাদের মুখেও আবার তারা প্রধান শিক্ষককে বরখাস্ত করেছে। এর আগেও ভান্ডারিয়ায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা-শিক্ষক জুনিয়র কর্মকর্তা এসি ল্যান্ড দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন।
সচিবালয়ে এক সভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় গত বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক শিক্ষক লাঞ্ছনার বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা একটা জঘন্য ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তদন্ত করা ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। এজন্য হয়তো কিছুটা সময় লাগতে পারে। সময় বড় কথা নয়, যথাযথ শাস্তি যাতে হয় সেটা দেখতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চাকরি থেকে বরখাস্ত করা আরও বড় অপরাধ। কেন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হল? এ জন্য কী তদন্ত হয়েছে? এ কারণগুলো আমাদের জানা দরকার। আশা করি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’
২০১৩ সালের ২২ জুলাই সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের ভেতর জাতীয় পার্টির স্থানীয় সংসদ সদস্য এইচএম গোলাম রেজার হাতে পিটুনি খেয়েছিলেন গাবুরা ইউনিয়নের ৬৮ নং খলিসাবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রবিউল ইসলাম নামের এক শিক্ষক।
২০১৪ সালের ২২ জুন ময়মনসিংহ-৩ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবুর রহমান ফকিরের সমালোচনা করায় গৌরীপুর উপজেলার কলতাপাড়া এলাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ময়মনসিংহ মুমিনুন্নিছা সরকারি মহিলা কলেজের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে মারধর ও দিগম্বর করে রাস্তায় ঘুরিয়ে লাঞ্ছিত করে মুজিবুর রহমান সমর্থকরা।
২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দফতরে ঢুকে টেবিল চাপড়িয়ে হুমকি দেন। একইভাবে ১৬ এপ্রিল রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার ১৫/২০ নেতাকর্মী নিয়ে অনুমতি ছাড়াই উপাচার্যের দফতরে ঢুকে উপাচার্যসহ অন্যদের লাঞ্ছিত করেন।
২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিএম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিতে আসা অধ্যাপক শঙ্কর চন্দ্র দত্তকে কলেজ সংলগ্ন পেট্রোলপাম্প এলাকায় চড়-থাপ্পড়, ঘুষি-লাথি দেয়ার ঘটনা ঘটে। দৌড়ে পালিয়ে ওইদিন নিজেকে রক্ষা করেন অধ্যক্ষ শঙ্কর চন্দ্র। ওই ঘটনায় মামলা দায়েরের তিন বছর পর ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল মেট্রোপলিটন আদালত ৪ আসামিকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দেন।
২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির সমালোচনা করে মন্তব্য করার অভিযোগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলমকে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
২০১৩ সালের ১৫ মে অর্থ নিয়ে চাকরি না দেয়ার অভিযোগে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার শাজাহান আলী মন্ডলকে লাঞ্ছিত করেছিল কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল কুমিল্লায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্রে আসন পরিবর্তন ও নকলে বাধা দেয়ায় ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন কলেজ শিক্ষক ইনামুল হক।
২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আমিনুল হক ভুঁইয়ার অপসারণের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর হামলা চালায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছাত্রলীগ নেতাদের উস্কানি দেয় বলে অভিযোগ ওঠে।
২০১২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন শিক্ষক ও ৮৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভিসি, প্রো-ভিসি ছাত্রলীগের তালিকা অনুযায়ী চাকরি না দিতে চাইলে তারা ভিসি প্রফেসর ড. এম আলাউদ্দিন ও প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিনকে ভিসির বাংলোয় একঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আবারও শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় বিব্রত সরকার
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ