Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমিই এখন তোমার মা ও বাবা

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২০ মার্চ, ২০১৯, ৬:৫৩ পিএম

১৯ বছর বয়সে বাংলাদেশ থেকে নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমান হুসনা আহমেদ। ওইদিন বিমানবন্দরে তার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন ফরিদ নামের এক যুবক। পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিউজিল্যান্ডে পৌঁছানোর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ফরিদ ও হুসনা আহমেদ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সুখে-শান্তিতে কাটছিল তাদের সংসার জীবন। একে একে কেটে যায় ২৫টি বছর। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত শুক্রবার এ দম্পতির সে মধুর সময়ের ইতি ঘটেছে। ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে বন্দুকধারী ব্রেন্টন টেরেন্ট নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৫০ জন মুসল্লীকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন হুসনা আহমেদও।
ঘাতক টেরেন্ট যখন মসজিদে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখনই হুসনার মুখোমুখি হয় সে। এসময় হুসনা মসজিদে প্রবেশ করছিল। খুনের নেশায় উন্মত্ত টেরেন্ট সেখানেই গুলি চালায় হুসনার ওপর। পর পর ৩টি গুলি চালিয়ে হুসনার মৃত্যু নিশ্চিত করে সে। মসজিদের বাইরে ফুটপাতে পড়ে থাকে হুসনার নিথর দেহ।
তার স্বামী ফরিদ হুইল চেয়ারে চড়ে চলাফেরা করেন। একটি দুর্ঘটনায় তাকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। শুক্রবার হুসনার সঙ্গে তারও মসজিদে জুম্মার নামায পড়তে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ফরিদের। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই মসজিদে পৌঁছাতে বিলম্ব হয় তার। আর এতেই প্রাণে বেঁচে যান তিনি। সাধারণত ফরিদ মসজিদের সামনে একটি নির্ধারিত স্থানে নামায আদায় করেন। বন্ধুর সঙ্গে আলাপ শেষে নামাযের জন্য তিনি ওই নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন। এসময় গুলির শব্দ পেয়ে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বন্দুকধারী চলে যাওয়ার পর মসজিদে ফিরে নিজের বন্ধু ও কমিউনিটির সদস্যদেরকে মৃত বা মৃতপ্রায় অবস্থায় দেখতে পান।
অন্যান্যদের সঙ্গে তিনি মসজিদের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় ফরিদের জানাশোনা এক গোয়েন্দা সদস্য তার ভাগ্নিকে ফোন দেন। সে ফোনটি ফরিদের হাতে দিয়ে কথা বলতে বলে। ওই গোয়েন্দা সদস্য তাকে বলেন- আমি তোমাকে সারারাত অপেক্ষায় রাখতে চাই না ফরিদ। তুমি বাড়ি যাও, সে (ফরিদের স্ত্রী) আর আসবে না। তখনকার অনুভূতির বিষয়ে ফরিদ বলেন, এ খবর শোনার পরে আমি চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলি। আমি কান্না করি, কিন্তু ভেঙে পড়িনি।
বন্দুকাধারী ওই মসজিদে হত্যাযজ্ঞ শেষে আরেকটি মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। শুক্রবারের এ হামলায় মোট ৫০জন নিহত হয়। আহত হয় আরো অনেক মানুষ। হতাহতদের বেশিরভাগই পাকিস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, তুরস্ক, সোমালিয়া ও আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থী বা অভিবাসী। নিউজিল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের দূত শফিকুর রহমান ভুঁইয়া জানিয়েছেন, শুক্রবারের হামলায় বাংলাদেশী কমিউনিটির মোট ৫ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন আরো ৪ জন। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। এদিন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলও ওই শহরে উপস্থিত ছিল। হামলা শুরুর পরপরই মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন তারা। পরে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন তারা। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা ফরিদকে জানিয়েছেন, তার স্ত্রী হুসনা মসজিদের ভেতরে নারী ও শিশুদেরকে সাহায্য করেছেন। পরে দৌড়ে ভবনের সামনে চলে আসেন। সেখানেই তাকে গুলি করে ঘাতক। ফরিদ বলেন, সে এমন একজন মানুষ, যে সবসময় অন্যদের অগ্রাধিকার দিতো। এমনকি অন্যকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবন দিতেও ভয় পায়নি সে।
শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ব্রেন্টন টেরেন্টকে এ হত্যাযজ্ঞের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আদালতে সে আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলেনি। পুলিশ জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ আনা হবে। শুক্রবারের হত্যাকান্ড গোটা নিউজিল্যান্ডে নাড়া দিয়েছে। ক্রাইস্টচার্চ শহর এখন গুমোট বেদনার শহরে রূপ নিয়েছে।
ফরিদ জানান, স্ত্রীর হত্যাকারীকে মাফ করে দিয়েছেন তিনি। বলেন, যে এই কাজ করেছে বা এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে যদি ওই ব্যক্তির কোন বন্ধুর সম্পৃক্ততা থাকে, তাদের উদ্দেশ্যে আমি এ বার্তা দিতে চাই যে, আমি এখনো তোমাদের ভালোবাসি। আমি তোমাদের আলিঙ্গন করতে চাই। সামনাসামনি তাদের বলতে চাই যে, আমি মন থেকেই এ কথা বলছি। তোমাদের প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ নেই। কখনোই আমি তোমাদের ঘৃণা করিনি, ভবিষ্যতেও কখনো করবো না।
ক্রাইস্টচার্চের উপকন্ঠে ফরিদের বাড়ী। বাইরের দিকের কক্ষে তিনি হোমিওপ্যাথি ব্যবসার কাজে ব্যবহার করে থাকেন। হামলার দিন বিকালে, ওই কক্ষে শুভাকাঙ্খীদের ভীড় জমে। তারা এমন একজন নারীর প্রতি বেদনা প্রকাশ করতে থাকেন, যিনি তাদের কাছে ছিলেন মায়ের মতো।
হুসনা আহমেদ ১৯৭৪ সালের ১২ই অক্টোবর সিলেটে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমান। পরিবারের সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনায় আক্রান্ত হুসনাকে যখন তার হবু স্বামী অকল্যান্ড এয়ারপোর্টে স্বাগত জানান, হুসনা তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন। দীর্ঘপথ গাড়ি চালিয়ে আবাসস্থল নেলসন শহরে ফেরার পথে হুসনাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন ফরিদ। খুব অল্প সময়েই সেখানে খাপ খাইয়ে নেন হুসনা। সে সময় নেলসন শহরে কোন বাংলাদেশী ছিল না বললেই চলে। এর পরেও হুসনা ছয় মাসের মধ্যে ইংরেজী ভাষা শিখে নেন। ইংরেজী ভাষা-ভাষী বেশ কিছু বন্ধুও হয় তার। ফরিদ বলেন, নিউজিল্যান্ডের মতো করে ইংরেজী বলতেন হুসনা। এমনকি এক সময় ইংরেজী বলার ক্ষেত্রে ফরিদের চেয়েও সাবলীল হয়ে যান হুসনা। ফরিদ বলেন, আমাদের শখ ছিল পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা। প্রচুর কথা বলতাম আমরা। এবং কখনোই বিরক্ত হইনি।
ক্রাইস্টচার্চ পুনর্গঠন: ২০১১ সালে প্রাণঘাতি ভূমিকম্পে যখন ক্রাইস্টচার্চ বিধ্বস্ত হয়, তখন হুসনা অনেক বাংলাদেশী অভিবাসীকে এখানে বসতি গড়তে সাহায্য করেন। এরা বিধ্বস্ত ক্রাইস্টচার্চ শহর পুনর্গঠনের কাজে সহায়তা করে। ক্রাইস্টচার্চে নতুন বসতি স্থাপনকারীদের একজন ওমর ফারুক। তিনি সিঙ্গাপুরে ঢালাই শ্রমিকের কাজ করতেন। নিউজিল্যান্ডে স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেনি। কেননা সেখানে কাজের পরিবেশ তুলনামূলক ভালো। এছাড়া, স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়ার সুযোগও রয়েছে। আল নুর মসজিদের হত্যাযজ্ঞে ফারুকও নিহত হয়েছে। তার নিয়োগকর্তা রব ভ্যান পির বলেন, দুপুরের আগেই কাজ শেষ করায় গত শুক্রবার তিনি কর্মচারীদেরকে আগে বের হওয়ার সুযোগ দেন। পরে ফারুক মসজিদে জুম্মার নামাযে যোগ দেয়। ভ্যান পির বলেন, বিশ্বস্ততা ও বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের কারণে সহকর্মীরা ফারুককে ভালোবাসতো। শুক্রবারের হামলায় জাকারিয়া ভুঁইয়া নামের আরেক ঢালাইশ্রমিক মারা যান। কয়েক দিন আগেই বিয়ে করেছিল সে। দ্রুতই তার স্ত্রীর বাংলাদেশ থেকে নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার কথা ছিল। ভিজিটর ভিসা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল সে। আরেক বাংলাদেশী মোজাম্মেল হক নিউজিল্যান্ডে উচ্চতর চিকিৎসা বিদ্যা অর্জনের জন্য পড়ালেখা করতেন। বাংলাদেশে তিনি দাঁতের ডাক্তার ছিলেন। শুক্রবার তিনিও নির্মমভাবে খুন হন।
ফারুকের সহকর্মী মজিবুর রহমান নামের এক ঢালাইশ্রমিক জানান, ওপরের তিন জনই হুসনা আহমেদকে চিনতেন। তিনি বলেন, এটা খুবই কঠিন পরিস্থিতি। কেননা আমরা একটি ছোট কমিউনিটি হলেও সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে বাস করি। আমরা পরস্পরকে চিনতাম। পরস্পরের সঙ্গে সবকিছু ভাগাভাগি করে নিতাম। জানি না, এখন কি হবে, আমরা কিভাবে স্বাভাবিক হবো। নিহত পঞ্চম বাংলাদেশী হলেন ড. আব্দুস সামাদ। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। নিউজিল্যান্ডে লিংকন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন।
ক্রাইস্টচার্চের নতুন আগমণকারী অনেক শ্রমিক সেখানে পরিবার গড়ে তুলেছেন। হুসনা এসব পরিবারের নারীদের গর্ভবস্থাসহ বিভিন্ন সময়ে আন্তরিকভাবে যতœ নিতেন। জাহাঙ্গীর আল বলেন, আমরা তাকে মায়ের মতো মনে করতাম। কোন কিছু দরকার হলে আমরা হুসনার কাছে যেতাম। হুসনার স্বামী ফরিদ জানান, তার স্ত্রী যে কাজ করতেন, এখন তিনি তা অব্যাহত রাখতে চান। নিজের ১৫ বছরের মেয়েকে তিনি মায়ের মতোই দেখভাল করতে চান।
শুক্রবার হামলার দিন মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে মাকে খুঁজে না পেয়ে বাবার কাছে মায়ের বিষয়ে জানতে চায়। ফরিদ বলেন, আমি এক সেকেন্ডও দেরি না করে বলি, সে আল্লাহর কাছে। তখন মেয়ে বলে তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি কি বলছো আমার মা আর নেই? ফরিদ বলেন, আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমিই এখন তোমার মা এবং বাবা।’ -রয়টার্স অবলম্বনে

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ক্রাইস্টচার্চ হামলা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ