পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে। প্রকল্পটি বন্ধে সরকার তার দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরতে না পারলে গোটা দেশ মরুভূমিতে পরিণত হবে বলে দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ভারত এই প্রকল্পের কাজ জোরালোভাবে এগিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়ায় এ নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকেও ভারতের এমন উদ্যোগে আপত্তি তোলা হয়েছে। চলছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ব্যাখ্যা চাওয়ার প্রস্তুতি।
এদিকে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, বীরপ্রতীক গতকাল বুধবার ইনকিলাবকে বলেছেন, ভারতের পানি সম্পদমন্ত্রী উমা ভারতীর বক্তব্য আমাদের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ চায় বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়টির সন্তোষজনক সমাধান। যদি না হয়, প্রয়োজনে আমরা বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলব।
উল্লেখ্য, গত ১৬ মে বিবিসি জানায়, ভয়াবহ খরা সামাল দিতে ভারত সরকার তাদের বিতর্কিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, যে প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে বাংলাদেশে। ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতীকে উদ্ধৃত করে এই প্রতিবেদনে বলা হয়, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহার করে খরাকবলিত এলাকায় সরবরাহ করার ওপর এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত সরকার।
১৯৯৮ সালে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোট সরকার গঠনের পর প্রথম আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নেয় ভারত। পরে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের আমলে পরিবেশবাদীদের বিরোধিতার কারণে তা এগোয়নি। ২০১২ সালে ভারতের উচ্চ আদালত এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্মতি দেয়। এরপর ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নর্মদা ও শিপ্রা নদীকে খালের মাধ্যমে যুক্ত করার কাজের মধ্য দিয়ে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
ভারতের এমন সর্বনাশা প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন দেশটির পরিবেশবাদীরাও। তারা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে বলছেন, এভাবে নদীর পানি প্রত্যাহার করা হলে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশই শুধু নয়, ভারতের জন্যও তা বিপর্যয় ডেকে আনবে।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, ভারত সরকার পরিবেশের ওপর এ প্রকল্পের প্রভাব সঠিকভাবে যাচাই না করেই ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। আর সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভার ও পিপল-এর সদস্য হিমাংশু ঠাক্কারকে উদ্ধৃত করে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদী সংযোগ প্রকল্পের মূল ধারণা হলোÑযেখানে পানির প্রবাহ উদ্বৃত্ত, সেখান থেকেই খরা প্রবণ এলাকাগুলোতে পানি নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের যে ধারা চলছে, তাতে ভবিষ্যতে কোন নদীর কী অবস্থা হবে তা বোঝা সম্ভব নয়। আর কোন নদীতে কী পরিমাণ পানি উদ্বৃত্ত আছে, কোথায় ঘটতিÑসে বিষয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাও নেই। এ রকম অবস্থায় প্রকল্পটি চালু করা হলে ভবিষ্যতে তা ভারতের জন্যও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ভারতের পরিবেশবাদী কর্মীদের এমন বিরোধিতা সত্ত্বেও উমা ভারতী বিবিসিকে বলেন, ‘নদী সংযোগ প্রকল্প আমাদের প্রাইম এজেন্ডা এবং এ বিষয়ে জনগণ আমাদের পক্ষে। দ্রুত এই প্রকল্প এগিয়ে নিতে আমরা বদ্ধপরিকর।’ তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পাঁচটি খাল খননের কাজ এগিয়ে চলেছে এবং এর মধ্যে উত্তর ও মধ্য প্রদেশের কেন-বেতওয়া সংযোগ দিয়ে যে কোনো সময় পানিপ্রবাহ চালু করা সম্ভব হবে। ‘এরপর আমরা দামান গঙ্গা-পিঞ্জল সংযোগ চালু করতে পারব, সেক্ষেত্রে মুম্বাইয়ের সুপেয় জলের অভাব পূরণ করা সম্ভব হবে।’
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই ভারতের মিডিয়ায় ফলাও করে সংবাদ প্রচার হলে ওই সময় বাংলাদেশ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ওই সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছিল, ভারতের এ ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশকে গভীর উদ্বেগের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে এ ব্যপারে একটি ‘নোট ভারবাল’ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে পাঠানোর পরই প্রকল্পটি নিয়ে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে ওই সময় লিখিতভাবে জানতে চাওয়া হয়েছিল।
আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনা নিয়ে ভারতের এমন আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশ্বস্ত করেছিলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো প্রকল্প তারা নেবেন না। বিশেষ করে ‘বরাক নদীর উজানে টিপাইমুখ ড্যাম প্রকল্প’ এবং ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ করার আগে তারা বাংলাদেশের অনুমতি নেবে। কিন্ত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প শুরু করা নিয়ে যে সংবাদ বিবিসিতে প্রচার হয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন বীরবিক্রম বলেছেন, ভারতের এমন সর্বনাশা প্রকল্প বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করবে। তিনি বলেন, সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে এ ধরনের প্রকল্প বন্ধে ভারত সরকারকে চাপে রাখা।
জানা যায়, ভারতের ন্যাশনাল ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি প্রায় ২০ বছরের পর্যবেক্ষণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৩৮টি নদীসহ বিভিন্ন নদীর মধ্যে ৩০টি সংযোগ খাল স্থাপনের পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার বিশেষ দিক হচ্ছে নদীর এক অববাহিকার উদ্বৃত্ত পানি অন্য অববাহিকায় যেখানে ঘাটতি রয়েছে সেখানে স্থানান্তর করা। এই ২৯টি সংযোগ খালের মধ্যে ১৩টি হিমালয় বাহিত আর ১৬টি পেনিনসুলার বা বিভিন্ন নদী ও উপদ্বীপ থেকে উৎসারিত। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত সারাদেশে ৭৪টি জলাধার ও বেশ কিছু বাঁধ নির্মাণ করবে। ফলে বর্ষার সময় সঞ্চিত পানি শুকনো মৌসুমে বিভিন্ন স্থানে কৃষি ও অন্যান্য কাজে সরবরাহ করবে। এছাড়াও শুষ্ক মৌসুমেও এসব সংযোগ খালের মাধ্যমে এক জায়গায় পানি আরেক জায়গায় নেয়া যাবে।
এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৬ সালের মধ্যে সংযোগ খালসমূহ খনন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১৪টি লিংক তৈরি করা হবে। সেগুলো হচ্ছেÑকোচি-মেসি লিংক; কোচি-ঘাঘারা লিংক; গংদক-গঙ্গা লিংক; ঘাঘারা-যমুনা লিংক; সারদা-যমুনা লিংক; যমুনা-রাজস্থান লিংক; রাজস্থান-সবরমতি লিংক; ছনার-সোন ব্যারাজ লিংক; সোনড্যাম-গঙ্গা লিংক; মানস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা লিংক; জোগিঘোপা-তিস্তা-ফারাক্কা লিংক; ফারাক্কা-সুন্দরবন লিংক; গঙ্গা-দামোদর-সুবর্ণরেখা লিংক এবং সুবর্ণরেখা-মহানদী লিংক।
মূলত এই লিংকগুলোর মাধ্যমে ভারতের অভ্যন্তরে নদীগুলোর মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা হবে। যাতে প্রয়োজন মতো এক নদীর পানি অন্য নদীতে নিয়ে যাওয়া যায়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে খাল কেটে বৃষ্টি প্রধান উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে পানি পশ্চিম ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। কারণ পশ্চিম ভারতে অপেক্ষাকৃত বৃষ্টিপাত কম হয় এবং সেখানে আবহাওয়া শুষ্ক। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আসামের ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি খাল কেটে রাজস্থান, গুজরাটসহ দক্ষিণ ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। আবার গঙ্গার পানি গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং তামিলনাড়ু রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হবে।
এভাবে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে ১৭৪ বিলিয়ন কিউসেক পানি পশ্চিম ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে যার মাধ্যমে এসব রাজ্যের ১৬ লাখ হেক্টর জমিতে কৃষিকাজ করা হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পুরো ভারতজুড়ে একটি নদীপথ তৈরি করা হবে, যার মাধ্যমে ভারতের উষ্ণাঞ্চলে পানির প্রবাহ নিশ্চিত হয়ে যাবে।
দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তঃনদী সংযোগের ফলে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ ভারতের অন্য অঞ্চলে চলে গেলে তার ভয়াবহ প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে। ইতোমধ্যেই ফারাক্কা এবং গজলডোবার বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের একটি বিশাল অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। আর যদি ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, তাহলে গোটা বাংলাদেশই পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত। ভারত প্রকৃত অর্থে কী করছে, আমরা তার টেকনিক্যাল দিকগুলো জানতে চাইবো। আমরা তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাইবো-কেন তারা এমন বিতর্কিত একটি প্রকল্প করতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভাটির দেশ। আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা বাধাপ্রাপ্ত হয় এমন কিছু করাটা ঠিক হবে না। তিনি জানান, ভারতের সাথে আমাদের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। দু’দেশের স্বার্থেই ভারতকে এসব নদী বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতেই ভারতকে তার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প থেকে সরে আসতে হবে। তিনি বলেন, এই প্রকল্প নিয়ে ভারতের পরিবেশবাদীরাও সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশের জন্যও এই প্রকল্প উদ্বেগ ও দুঃশ্চিন্তার কারণ। তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এর নিস্পত্তি না হলে বাংলাদেশ প্রয়োজনে বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলবে।
দেশের বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। তিনি বলেন, দু’দেশের মধ্যে এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কাজেই সরকারকে রাজনৈতিকভাবেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
একইভাবে যৌথ নদী কমিশনের কর্মকর্তা মো. মোফাজ্জল হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত গঙ্গা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের কবলে পড়বে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ তার এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা বারবার ভারতকে জানিয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।