Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুন্দরবনে পর্যটক টানতে গুচ্ছ পরিকল্পনা

উন্নতমানের রিসোর্ট, কটেজ ও মোটেল স্থাপন

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের নৈসর্গিক দৃশ্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণে প্রথমবারের মতো পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সুন্দরবনের পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের থাকার জন্য সুন্দরবনের কাছাকাছি স্থানগুলোতে সরকারি উদ্যোগে উন্নতমানের রিসোর্ট, কটেজ ও মোটেল স্থাপন করা হবে। বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারের অনুমতি নিয়ে উন্নতমানের রিসোর্ট ও কটেজ তৈরি করতে পারবে। আর এক্ষেত্রে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য দেখতে আসা পর্যটকদের জন্য থাকবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা। এতে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা আয়ের পাশাপাশি সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। এরই মধ্যে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষকদের দিয়ে গত ডিসেম্বর থেকেই উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অংশের সুন্দরবনে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করেছে। তিন মাসব্যাপি এ সম্ভাব্যতা যাচাই এখনও শেষ হয়নি। এ কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই কোটি টাকা।
যদিও পর্যটন মোটেল স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পরিদর্শন, পরিকল্পনা, সম্ভাব্যতাসহ নানা কর্মতৎপরতার উদ্যোগের পর ৪৮ বছর কেটে গেছে। সূত্র মতে, খানজাহান আলীর (রহ.) স্মৃতিধন্য শিল্প ও বন্দর নগরী খুলনা। এখানেই বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। পর্যটন শিল্পের বিকাশেরও অপার সুযোগ। এই সুযোগ কাজে লাগাতেই ১৯৭০ সালে খুলনায় পর্যটন মোটেল ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য খুলনা মহানগরীর মুজগুন্নিতে হুকুম দখল করা হয় ৪ দশমিক ৮৪ একর জমি। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ সার্ভিসেস লি. ও বর্তমানে পর্যটন করপোরেশন এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। পরে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে বুয়েটের একটি প্রতিনিধিদল পর্যটন মোটেল, ট্রেনিং সেন্টারসহ আনুসঙ্গিক স্থাপনা স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে প্রতিবেদন দাখিল করে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনে। এরপর চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ সৃষ্টি করে দরপত্র আহবান এবং বর্তমানে সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম।
বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বেসামরিক বিমান, পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন জমা দেবেন। প্রতিবেদন পেলেই বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বিতভাবে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশি-বিদেশি ইকো পর্যটকদের পদচারণায় সুন্দরবন এলাকা মুখর হয়ে উঠবে। সেখানকার মানুষের আয়ের পথও সুগম হবে। পাশাপাশি সরকার প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা আয় করতে সক্ষম হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পর্যটন) মো. হুমায়ুন কবীর ইনকিলাবকে বলেন, পর্যটকদের আকর্ষণে সুন্দরবনকে নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ গত সপ্তাহের তথ্য অনুযায়ি এখনও শেষ হয়নি। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের রিপোর্ট পেলে নির্দিষ্ট হবে কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করা যায়।
সূত্র মতে, উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অংশের সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়েকটি স্থানকে পর্যটকদের জন্য বেছে নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ; বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, রামপাল; সাতক্ষীরা জেলার মুন্সীগঞ্জসহ আরও কয়েকটি স্থান রয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায়ও সুন্দরবনের পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হক বলেন, সুন্দরবন নিয়ে বিদেশি পর্যটকদের অনেক আগ্রহ রয়েছে। পরিকল্পনার অভাবে সুন্দরবন ঘিরে পর্যটন শিল্পের সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি। যথাযথ পরিকল্পনা নিলে সুন্দরবন থেকেই শত কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। বিলম্বে হলেও সুন্দরবনে পর্যটক টানতে পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন করছে সরকার।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, এশিয়ার অন্যান্য দেশে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ঘিরে পর্যটকদের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। মালয়েশিয়ার ম্যানগ্রোভ বন তুলনামূলক কম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত হলেও সুন্দর ব্যবস্থাপনার কারণে সেখানে প্রচুর দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। সে তুলনায় জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর সুন্দরবনে পর্যটক নগণ্য।
বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা-সংলগ্ন সুন্দরবনের কচিখালী-কটকা, নীলকমল ও দক্ষিণ অভয়ারণ্য নামে তিনটি অভয়ারণ্য রয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে এ অভয়ারণ্য। প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটক সুন্দরবনের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে আসেন। ২৪ ঘণ্টায় প্রাকৃতিকভাবে ছয়বার রূপ বদলায় সুন্দরবন। কটকার কাছে জামতলা সি-বিচে সূর্যোদয় ও সূূর্যাস্ত দেখার বিরল সুযোগ থাকলেও পর্যটকদের জন্য রাত যাপনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সীমিত। এ কারণে পর্যটকদের দূরের কোনো হোটেলে অবস্থান করতে হয়।
১৮৭৮ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারই পড়েছে বাংলাদেশে। বাকিটা ভারতীয় অংশে।
দেশের উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৫ লাখ পরিবার সুন্দরবনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। সুন্দরী, গেওয়া, পশুরসহ এ বনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। ৪৪৪টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, দেড় লাখ হরিণসহ ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, আট প্রজাতির উভচর ও ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৫০ হাজার বানর, ২৫ হাজার বন্য শূকর, ২৫ হাজার উট বিড়াল ও ২০০ প্রজাতির লবণ পানির কুমির রয়েছে।
এখানকার নদ-নদী ও জলাশয়ে বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির সাড়ে ছয় হাজার ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি ও ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। প্রতি বছর সুন্দরবন থেকে ১৫-১৬ হাজার মণ মধু আহরণ করা হয়।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, খুলনায় পর্যটন শিল্প বিকাশের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে দ্রুত মোটেল ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তৈরিতে গুরুত্বারোপ করেন তিনি। কারণ পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক (প্লানিং) খালিদ বিন মজিদ বলেন, খুলনার মুজগুন্নিতে আন্তজাতিকমানের ৫ তারকা মোটেল ও পর্যটন কমপ্লেক্স স্থাপনের প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে।#



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সুন্দরবন

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ