ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আবদুল্লাহ্ আল মেহেদী
হঠাৎ করে ৬ বছর পর বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা থেকে সরে আসছে সরকার। ২০১০ সালের করা এই মহাপরিকল্পনা পরিবর্তন করা হচ্ছে। নতুন পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, সরকার মনে করেছিল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পে বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে গ্রাহকরাও তা লুফে নেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভিন্ন, কারণ বেশি দামে এখন বিদ্যুৎ কিনতে আগ্রহী নয় শিল্প মালিকরা। এর পেছনের আরো কারণ হলো, শিল্প খাতে একের পর এক লোকসান ও ধসের হার বৃদ্ধি।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি ও প্রসারের জন্য ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকার ম্যাজিক কৌশল গ্রহণ করে। ঘোষণা দেয়া হয়, ২০১২ সালের পর দেশে আর বিদ্যুৎ সমস্যা থাকবে না। এর অংশ হিসেবে একের পর এক ভাড়াভিত্তিক ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য বিভিন্ন কোম্পানির সাথে চুক্তি করা হয়। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন একটি ভালো ব্যবসায় পরিণত হয়। ফলে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ফার্নিচার কোম্পানি, বড় বড় ব্যবসায়ী বিদ্যুৎ ব্যবসায় নেমে পড়েন। এই ব্যবসায়ের সুবিধা হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানোর জন্য যে জ্বালানি লাগবে তথা ডিজেল, ফার্নেস অয়েল তা ভর্তুকি দামে সরবরাহ করবে সরকার। আবার এসব কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অনেক বেশি দামে ক্রয় করবে সরকার।
এ ক্ষেত্রে দুইভাবে বিশাল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। বিদেশ থেকে ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দিতে হচ্ছে। আবার পিডিবি নির্ধারিত রেট হতে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। একই সাথে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ করতে সরকার ব্যর্থ হলে আবার জরিমানাও প্রদান করতে হবে।
বিভিন্ন সংবাদ সূত্র হতে জানা যায়, ২০১০ সালে পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান করে সরকার। ২০ বছর মেয়াদি এই প্লানে ২০১৬ সালে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয় ১১ হাজার ৪০৫ মেগাওয়াট। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, চলতি গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়াতে পারে সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট। এখানে বাস্তবতার মুখ দেখেনি সরকার। একইভাবে ২০২০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াতে পারে ১২ হাজার ৯৪৯ মেগাওয়াট। যদিও আগের মহাপরিকল্পনায় তা ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট। শিল্প খাতে চাহিদা না বৃদ্ধিই এর মূল কারণ বলে মনে করা হয়। ফলে নির্ধারিত মহাপরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়ায় ২০১০ সালে নেয়া মাস্টারপ্ল্যান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে কমানো হচ্ছে বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা। এ জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে কাজ করছে টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার সার্ভিস কোম্পানি। এপ্রিল মাসে পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান ২০১৫-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা ও উৎপাদন বিশ্লেষণ করা হয়েছে, পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি চাহিদা ও সম্ভাব্য দামও তুলে আনা হয়েছে নতুন মহাপরিকল্পনায়।
শিল্প খাতে বিদ্যুতের ব্যবহার না বাড়ার জন্য সরকারের ভুল নীতিকে দায়ী করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারে তারা বলেন, একসময় শিল্পে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রেখে ক্যাপটিভে উৎসাহ দেয়া হয়েছিল। সরকারের ভুল নীতির কারণে ক্যাপটিভ পাওয়ারের দিকে ঝুঁকেছেন শিল্প মালিকরা। ফলে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিল্প খাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়েনি, তবে সাধারণ গ্রাহককে বেশি সংযোগ দেয়া হয়েছে। এতে ব্যয়বহুল বিদ্যুতের সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না। বিদ্যুৎ খাতে ২০১০ সালে ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান প্রণীত হয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা নিরূপণ করা হয়। মহাপরিকল্পনায় সরকারের নীতি অনুযায়ী বিদ্যুৎ চাহিদা, ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে চাহিদা ও ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে চাহিদা নিরূপণ করা হয়।
এর মধ্যে সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয় সরকারি নীতির ক্ষেত্রে। তবে তিনটি প্রেক্ষাপটের কোনোটির সঙ্গেই বর্তমান বিদ্যুৎ চাহিদার সামঞ্জস্য নেই।
আগের মহাপরিকল্পনায় ২০২০ সালের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট। নতুন মহাপরিকল্পনায় তা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার ৯৪৯ মেগাওয়াট। আর ২০৩০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে ২৭ হাজার ৪৩৪ মেগাওয়াট, যা আগের পরিকল্পনায় ধরা হয়েছিল ৩৩ হাজার ৭০৮ মেগাওয়াট। চাহিদার পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও কমানো হচ্ছে নতুন মহাপরিকল্পনায়। এতে বলা হয়েছে, চাহিদা মেটাতে ২০২০ সালে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেই চলবে। আর ২০৩০ সালে উৎপাদন করতে হবে ৩০ হাজার ১৭৮ মেগাওয়াট। যদিও বর্তমান পরিকল্পনায় তা ধরা হয়েছে যথাক্রমে ২৩ হাজার ৮০৯ ও ৩৮ হাজার ৬৮৫ মেগাওয়াট।
দেশে বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম শিল্প খাতে বিদ্যুতের ব্যবহার আশানুরূপ বাড়েনি। পাশাপাশি আবাসিকে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জন্য দেশব্যাপী জরিপ চালানো হচ্ছে। এতে আগামীতে পরিকল্পিতভাবেই বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে।
বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়ার কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয় নতুন মহাপরিকল্পনায়। এতে বলা হয়, শিল্প খাতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত মূলত পোশাকশিল্পনির্ভর। এ শিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহার তুলনামূলক কম। হালকা প্রকৌশল ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কিছুটা বিকশিত হলেও রফতানিতে তেমন অবদান রাখতে পারছে না। আর ভারী শিল্পের বিকাশও খুব একটা হয়নি, তাই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী শিল্প খাতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে না।
সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার গত কয়েক বছরে বেড়েছে, তবে আবাসিক গ্রাহকের বিদ্যুতের ব্যবহার আশানুরূপ বাড়েনি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের ব্যবহার তুলনামূলক কম। এক্ষেত্রে সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করা হয়।
এদিকে আসছে বাজেটেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলছে পিডিবি। এ খাতের পুরনো প্রকল্প চালু রাখা এবং বিদ্যুতের নতুন সঞ্চালন লাইনের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। তবে, বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি গ্রাহক পর্যায়ে সহজে বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি এবং দাম সাধারণ জনগণের মধ্যে সহনীয় রাখারও পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তবেই সরকারের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ঘটবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।