Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতের আগ্রাসী নীতি - নদীভাঙনে সর্বস্ব হারাচ্ছে মানুষ

প্রকাশের সময় : ১৮ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রেজাউল করিম রাজু : অভিন্ন নদীগুলোর মুখে উজানের দেশ ভারতের পানি আগ্রাসী নীতি আর নিষ্ঠুর আচরণের কারণে এদেশের নদীগুলোর উপর মহাবিপর্যয় নেমে এসেছে। অসংখ্য ড্যাম-ব্যারাজ দিয়ে আর মাইলের পর মাইল খাল খনন করে পানিদস্যুতার মাধ্যমে ভাটির দেশের নদনদীগুলো হত্যা করা হয়েছে। দেশের পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, বহ্মপুত্র, তিস্তা ও সুরমা নদীতে শুকনো মৌসুমে পানি আটকে রেখে শুকিয়ে মারা আর বর্ষার সময় ওপারের বন্যার চাপ সামলাতে ড্যাম-ব্যারাজের সবকটি পাষাণ গেট খুলে দিয়ে এপারের মরা নদীগুলোয় ঠেলে দিয়ে ডুবিয়ে মারার চ- নীতি পালন করে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। নাব্যতা হারানো নদীগুলো একসাথে এত পানির চাপ সামলাতে পারে না। ফলে দু’কূল ছাপিয়ে চলে। ভাসায় জনপদ। ভাঙে দু’পাড়। বিলীন হয় ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত, হাটবাজারসহ তিল তিল করে সাজানো সংসার। গোয়াল ভরা গরু সব মিলিয়ে নিমিষেই যায় নদীর পেটে। একদিনের জোতদার হয়ে পড়েন খোলা আকাশের নিচের বাসিন্দা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নদীর পাড় ছেড়ে আশ্রয় নেন অন্য কোথাও। শহরের বস্তিতে। যার জমিতে একদিন অনেক লোক কামলা খাটত এখন সেই নদীভাঙনে নিঃস্ব, মানুষটি অন্যের জমিতে কাজ করে। যারা নদীর মায়া ভুলতে পারেন না তারা আরেকটু দূরে কিংবা চরের উঁচু জমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নেয়। যদিও বর্ষায় বানের পানি সেখানেও হানা দেয়। আবহমানকাল ধরে নদনদীতে স্বাভাবিকভাবে কম-বেশি ভাঙন হলেও এখন চিত্র ভিন্ন। প্রতি বছর ভয়াবহ বন্যা আর নদীভাঙনের শিকার হয়ে প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর সব হারিয়ে ছিন্নমূল মানুষের তালিকায় যোগ হচ্ছে বহু সংখ্যক আদম সন্তান। হাজার হাজার একর জমি চলে যাচ্ছে নদীগর্ভে। অন্যদিকে নদী গড়েও আর তা হলো বিশাল বালিচর। যার নিচে নদী চাপা পড়ে অস্তিত্ব হারিয়ে রূপ লাভ করে জীবাশ্ম ফসিলের। শঙ্কার কথা হলো আমাদের সীমান্ত লাগোয়া নদীগুলো ভাঙনের কবলে পড়ার পর সেখানেও ভারত আধিপত্য বজায় রাখার অপতৎপরতা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু স্থানে দখল কায়েম করেছে। ফলে চরাঞ্চলের মানুষ আজ নিজভূমে পরবাসী হয়ে গেছে। সরকারি হিসাবে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৮ জেলার নদ নদীভাঙনপ্রবণ। এর মধ্যে পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীতে ভাঙনের প্রবণতা বেশি। নদী গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের প্রায় সব নদী সর্পিল ধরনের। আুঁকাবাঁকা নদীতে বেশি ভাঙন হয়। ফারাক্কা বাঁধের কারণে সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার পদ্মা। পদ্মার যাত্রা শুরু স্থল চাঁপাইনবাবগঞ্জের হরিপুর ইউনিয়ন থেকে একেবারে গোয়ালন্দঘাট পর্যন্ত সমানে দু’পাড় ভেঙে চলেছে। ভাঙনে উত্তরের জনপদ একের পর এক বিলীন হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর ভাঙন হলো দক্ষিণের চরের গ্রামগুলো। প্রতি বছর ভাঙতে ভাঙতে বাংলাদেশের সীমানা নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শিবগঞ্জ, রাজশাহী গোদাগাড়ী চারঘাট বাঘা নাটোরের লালপুর ঈশ্বরদি পাবনা সর্বত্র চলছে পদ্মার ভাঙনের তা-ব। দক্ষিণের ভারত সীমান্ত লাগোয়া খানপুর, চর আসাড়িয়াদহ, ইউসুফপুর, মাঝার দিয়াড় চর ভাঙতে ভাঙতে এমন পর্যায়ে এসেছে যে তা রক্ষা করতে না পারলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যাবে। গত কয়েক বছরে ভাঙনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সীমান্ত পিলার নদীগর্ভে চলে যাওয়ায় এখন সেখানে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব চরের লোকজন নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাচ্ছেন। সরেজমিন পদ্মা দক্ষিণের চর খিদিরপুর, খানপুর এলাকায় গিয়ে জানা গেল ভয়াবহ ভাঙনের কথা। গত বর্ষায় সীমান্তের ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ আর ছয়শো মিটার প্রস্থ ভূখ- ভাঙনে নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙনে চর আষাড় দিয়াড় ও খানপুরের মধ্যবর্তী কলাবাগান এলাকার ১৬৪ ও ১৬৫ নম্বর সীমান্ত পিলার নদীতে ভেঙে গিয়ে ভারতীয় সীমানায় গিয়ে ঠেকেছে পদ্মার পানি। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের কথা বলে ভারতীয় বিএসএফ তাদের নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তৎপর। এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভারতীয় মোহনগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্প সরিয়ে এনে নদীর তীরে স্থাপন করেছে। সেখান দিয়ে বাংলাদেশীদের চলাচলে বাধা দিচ্ছে। মাছ ধরা নৌকা যেতে দিচ্ছেনা। ফলে ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে অনেকটা ঘুর পথে যেতে হচ্ছে। ক’দিন আগে এলাকার এমপি আয়েন উদ্দিন চরাঞ্চলে যাবার পথে ভাঙন কবলিত এলাকা দিয়ে যেতে গেলে ভারতীয় বিএসএফ বাধা দেয় বলে স্থানীয়রা জানান। চরাঞ্চলের মানুষ জানান প্রতি বন্যায় শত শত ঘরবাড়ি জমি জিরাত ভেঙে যাচ্ছে। চর তারানগর দিয়ার খিদিরপুর, দিয়াড় শিবনগর, চর বৃন্দাবন কেশবপুর, চর তিতামারী, শ্রীরামপুরের বেশিরভাগ জমি নদীর ভাঙনে চলে গেছে। বাকিটুকু ভেঙে ভারতীয় সীমানা অতিক্রম করলেই ভারতীয়রা তাদের বলে দখল করে নেবে। এখনি এসব এলাকার মানুষকে প্রতিনিয়ত হয়রানী করছে। বিশেষ করে জেলেদের মাছ ধরতে দিচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায় নদীর দক্ষিণ সীমান্তে পদ্মার ভাঙন রোধে চর মাঝারদিয়ার খানপুর বিদিরপুর ইউসুফপুর বিজিবির বিওপি এলাকা রক্ষার জন্য বছর তিনেক ধরে প্রকল্পের পর প্রকল্প পাঠানো হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। শেষ পর্যন্ত ১৭৪ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবটিও নাকচ হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, তারা পদ্মার উভয় তীর সংরক্ষণের জন্য এক হাজার কোটি টাকার বেশী প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও তা আলোর মুখ দেখেনি। প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে শুধু দক্ষিণের চরাঞ্চল নয় উত্তরের শহরের ভাঙনও রোধ করা যাবে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিবির এক সূত্র জানায়, পদ্মার পশ্চিমের বকচর থেকে হার্ডিঞ্জ পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় আশি কিলোমিটার এলাকায় দক্ষিণের পদ্মার তীরের তিন ভাগ চলে গেছে পানির মধ্যে। আর্ন্তজাতিক বিধি বিধানের কথা বলে ভারতীয় বিএসএফ এসব এলাকায় কোথাও দখল নিয়ে ফেলেছে। আমরা হারাচ্ছি আমাদের একক আধিপত্য।
উল্লেখ্য ভারত ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে ওপারের গঙ্গার পানির পর এবার এপারের সীমান্ত এলাকা পদ্মার পানিতে দখলি স্বত্ব কায়েমের অপতৎপরতা শুরু করেছে।
পত্রপত্রিকায় নদী ভাঙনের যে ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে তা সংক্ষিপ্ত। সরজমিনে প্রত্যক্ষ করলে শিউরে উঠতে হয়। সিরিজের পর সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভয়াবহতা আর নির্মমতার কথা শেষ করা যাবেনা। ভাঙন কবলিত এলাকা প্রত্যক্ষ করে বার বার মনে হয়েছে আমাদের প্রতিথযশা কবি-সাহিত্যিক-গবেষক মরহুম আহমেদ ছফার এক নিবন্ধের কথা। ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘ফারাক্কা বাংলাদেশের ওপর নামিয়েছে নাগাসিকা হিরোশিমার চাইতে ভয়ংকর বিভীষিকা।’ পরিশেষে বন্ধুবর নির্ভীক কলমসৈনিক কবি আব্দুল হাই সিকদারের ফারাক্কা দর্শনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা হলোÑএ তো ফারাক্কা বাঁধ নয়, এ হলো মানব সভ্যতার বধ্যভূমি। এ এক নতুন কারবালা। মানুষ মানবতা সভ্য ন্যায়ের বিরুদ্ধে ইয়াজিদের নির্মম ঘাতক বাহিনী। এ হলো চেঙ্গিস খানের প্রেতাত্মা। এ হলো হালাকু খানের কুৎসিত অট্টহাসি। শুধু ফারাক্কা নয় অভিন্ন সবকটি নদীর পানি শোষণের নির্মম চিত্র এমনই।
প্রতি বছর এক নীরব বিপর্যয় হিসাবে নদী ভাঙার খেলা মানুষের জীবনে দুঃখ-বেদনার কারণ হয়। বন্যা ও নদীভাঙন মিশে আছে আমাদের জীবনের সাথে। নগর বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর ভাঙনের খবর নিয়ে তোলপাড় হয়। কিন্তু নদীর বাঁকে বাঁকে ভাঙনের নিঃস্ব হওয়া মানুষদের খবর তেমন প্রকাশ হয় না। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশাল বিশাল প্রকল্প করে। দু-একটা অনুমোদন পেলেও বাকিগুলো আলোর মুখ দেখে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে এরা সময়ের কাজ সময়ে করে না। সারা শুকনো মওসুম হাত গুটিয়ে বসে থাকে বর্ষার অপেক্ষায়। নদী ভাঙন নিয়ে যখন তীরবর্তী মানুষ উৎকন্ঠায় থাকে তখন উৎসবের আমেজ আসে পানি উন্নয়ন বোর্ডে। চলে গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ভাঙন রোধের জন্য সিসিব্লক, বড় বড় পাথর আর ইটের খাঁচা বালির বস্তা ফেলা। ভাঙন রোধের জন্য এসব কত ফেলা হলো তা নিয়ে মানুষের সরস মন্তব্য এসব ফেলার সংখ্যা গোনা আর নদীর ঢেউ গোনা এক কথা। ভাঙন এলাকায় কত কি ফেলা হলো তার হিসেব আর কে রাখে। তবে সে সময় দিনরাত ব্যস্ত থাকে বোর্ডের কর্মী আর ঠিকাদাররা। এ ঠিকাদারী নিয়েও চলে তোঘলকী কারবার। জরুরি ভাঙন রোধে লাখ লাখ টাকা ব্যয় হলেও তা কতটুকু কার্যকরী তা প্রশ্ন রয়ে যায়। পদ্মা নদীর ভাঙন রোধের টি বাধ দেখার সময় বন্ধুবর সাংবাদিক আব্দুস সাত্তারের মন্তব্য ছিল নদী ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড যত টাকা খরচ করে তা দিয়ে কয়েকশ বিশাল বিশাল ভবন নির্মাণ করা যেত। তার লেখা ‘বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদীর পানি সংকট’ বইটিতে তা উল্লেখ করেছেন। নদীভাঙন ও রোধ নিয়ে মীর মোশারফ হোসেনের উদাসীন পথিকের মনের কথা গ্রন্থে সরস বর্ণনা পাওয়া যায়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


.

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারতের আগ্রাসী নীতি - নদীভাঙনে সর্বস্ব হারাচ্ছে মানুষ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ