Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চলে গেলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক সাদেক খান

প্রকাশের সময় : ১৭ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : ‘যেতে নাহি দিব হায়/ তবু যেতে দিতে হয়/ তবু চলে যায়’ কবির এই আকুতির মতোই পরিবার, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধবদের শোকে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন বরেণ্য সাংবাদিক সাদেক খান। গতকাল বেলা ১১টায় বারিধারায় নিজ বাসায় ৮৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। মুসলিম বনেদী পরিবারে জন্ম দেয়া সাদেক খানের অসংখ্য পরিচিতি। ভাষা আন্দোলনের শিপাহশালার, সিনেমার পরিচালক, সিনেমার প্রযোজক, সাংবাদিক, লেখক, কলামিষ্ট, টকশোর আলোচক নানাবিধ পরিচয়ে তিনি পরিচিত। এক সময় ইনকিলাবেও লিখতেন। মেধা, প্রজ্ঞায় ধীনস্থিত, জাপিত জীবনে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নীতিবান প্রবীণ এ বুদ্ধিজীবী দেশের আর দশজন বুদ্ধিজীবীর মতো ‘বুদ্ধি বিক্রীর হাটে’ নিজেকে তোলেননি। সুবিধাবাদী রাজনীতির ডামাডোলে ‘যেদিকে যা পাই/চেঁটেপুটে খাই’-এর শ্রোতেও গা ভাসিয়ে দেননি। কথা ও কাজে সাজুয্য রাখতেন; যা বিশ্বাস করতেন তাই বলতেন-লিখতেন। ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় হলেও পরবর্তীতে এদেশের মাটি মানুষের সঙ্গে নিজেকে একাকার করে ফেলেন। দেশের বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি হয়ে উঠেন আস্থাশীল। এ দেশের মাটি মানুষকে তিনি হৃদয়ে ধারণ করতেন। সে কারণেই নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী পারের মানুষের জীবন চিত্র নিয়ে ১৯৬৫ সালে নির্মাণ করেছিলেন ‘নদী ও নারী’ নামের কালজয়ী সিনেমা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি জাতীয়তাবাদী আদর্শের ধারা থেকে একচুলও নড়েননি। ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু তাকে নিজস্ব বিশ্বাস থেকে এক চুলও সরাতে পারেনি। যার কারণে দিল্লী-কোলকাতা প্রেমী বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতি সেবারা তাকে বিএনপির লোক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করতেন।
সাদেক খানের মৃত্যুর খবর শুনে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা ছুটে যান তার বাসায়। পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত হলে সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানান, আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় তাঁর নামাজে জানাজা জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত হবে। অতপর বাদ জোহর গুলশান আজাদ মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে পিতা মরহুম আবদুল জব্বার খানের কবরে সমাহিত করা হবে।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সাদেক খান ১৯৩৩ সালের ২১ জুন মুন্সীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ওই সময় তার বাবা সাবেক পাকিস্তান ন্যাশনাল এসেম্বলির স্পিকার মরহুম আবদুল জব্বার খানের কর্মস্থল ছিল মুন্সীগঞ্জ। তাঁর গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায় বাহের ক্ষুদ্রকাঠি। তিনি ভাই-বোনদের মধ্যে ছিলেন সবার বড়। তার অন্যান্য ভাইবোন হলেন সাবেক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত কবি মরহুম আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান, প্রখ্যাত সাংবাদিক সাবেক রাষ্ট্রদূত মরহুম এনায়েতুল্লাহ খান, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক প্রতিমন্ত্রী সেলিমা রহমান ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের প্রকাশক শহিদুল্লাহ খান বাদল।
সাদেক খান ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ‘কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটির’ সভা থেকে গ্রেফতার হন এবং একমাস কারাভোগ করেন। ১৯৫৫ সালে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ’৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংবাদের সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি চলচ্চিত্র আন্দোলনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। তিনি কলাম লেখার চর্চা অব্যাহত রেখে হলিডে ও অন্যান্য পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ লেখেন। এছাড়াও রেডিও, টেলিভিশন ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে জাতীয় সমস্যাদি, জাতীয় সম্পদ, নিরাপত্তা সাংবাদিকতা এবং সাংস্কৃতিক বিষয়াদিতে জ্ঞানলব্ধ মৌলিক বক্তব্য রেখেছেন। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
সাদেক খান এদেশের মাটি, মানুষের শেকড় বুঝতেন, বোঝার চেষ্টা করতেন। সেগুলো নিয়ে চিন্তাশীল লেখালেখি করতেন বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সেই পাকিস্তান আমলে এ দেশের সাহিত্য, সাংস্কৃতি আন্দোলনের নিজেকে জড়িয়েছেন। নির্মাণ করেছেন ‘নদী ও নারী’ নামে কালজয়ী সিমেনা। নদী পাড়েরর মানুষের জীবনচিত্র নিয়ে নির্মিত ‘নদী ও নারী’ ছবির প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় একটি চিল উড়ে যাচ্ছে; যা অশুভ কোন ঘটনার ইঙ্গিত। পরের দৃশ্যে দেখা যায় ছবির অন্যতম চরিত্র আজিজ (সুভাষ দত্ত) ঘাটে নৌকা বেঁধে তীরে উঠলে তার চোখে পড়ে নদী ভাঙ্গনে উপড়ে যাওয়া একটি বিশাল গাছ, যার শিকড় বাকড় আকাশের দিকে। চিৎকার করে লোকজন ডাকে সে। সবাই এলে প্রথম বলে ওঠে ‘সক্কলেরে খাইবো। তোমাগো সক্কলেরে খাইবো।’ নদীমাতৃক এই দেশের নদী মানুষকে যেমন দেয়; তেমনি কেড়ে নিয়েও যায় অনেক কিছু। আর তাই তিনটি ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে কাহিনীর বুনটে আমরা যেমন দেখতে পাই জেগে ওঠা চরে সোনা ফলাতে; তেমনি দেখতে পাই আজিজের সদ্য বিয়ে করা নতুন বউ কুলসুমকে নদীর পানি কেড়ে নিতে। নদীর ভাঙন, জেগে ওঠা চর, জীবনের চড়াই-উৎসাইয়ের পর দেখতে পাই মহাপ্লাবন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায় বন্যার কবল থেকে উদ্ধার পেতে সবাই যখন নৌকায় পাড়ি জমায়; তখন আজিজের মুখে ছবির শেষ সংলাপ ‘মাডি ঠিকই পাইয়া যামু’। মহাপ্লাবনের মধ্যেও মানুষের জীবনের গতিপথ পেয়ে যাওয়ার যে প্রেরণা ‘নদী ও নারী’ সিনেমায় সাদেক খান এঁকেছেন এটা এ অঞ্চলের মানুষের জেগে ওঠা বেঁচে থাকার জন্য বিরাট প্রেরণা।
বিভিন্ন সংগঠনের শোক
সাংবাদিক ও কলাম লেখক সাদেক খানের মৃত্যুতে বিএনপি চেয়ারপার্সনসহ শোক জানিয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক, সাংষ্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন। আলাদা শোক বিবৃতিতে সংগঠনের নেতারা মরহুমের রূহের মাগফিরাত কমানা করে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমাবেদনা জ্ঞাপন করেন।
বিএফইউজে ও ডিইউজে
প্রবীণ সাংবাদিক সাদেক খানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সামছুদ্দিন হারুন ও মহাসচিব এম আবদুল্লাহ এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি আব্দুল হাই শিকদার ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান। শোক বিবৃতিতে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
এনডিপি
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, প্রেসিডিয়াম সদস্য ক্বারী আবু তাহের, মোঃ মঞ্জুর হোসেন ঈসা, যুগ্ম মহাসচিব ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, শামছুল আলম, দপ্তর সম্পাদক মোঃ মুছার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, দেশের মৃত গণতন্ত্রের সময় তার এই মৃত্যু জাতি গভীর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল।
ওয়াকার্স পার্টি
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা এক শোক বিবৃতিতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, জনাব সাদেক খান তাঁর লেখনির জন্য সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিশিষ্ট রাজনীতিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেননের বড় ভাই। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল
জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দলের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জি. জেড আই এম মোস্তফা আলী মুকুল ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বেপারী এক যৌথ বিবৃতিতে গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করে নেতৃবৃন্দ বলেন দেশের এই দুৎসময়ে জাতি একজন বরেণ্য সাংবাদিককে হারালো। সাদেক খানের সাংবাদিকতা জীবনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেশ ও জাতির কল্যাণে রেখে গেছেন তা কখনো ভোলার মত নয়। মৃত্যুতে তার পরিবারের প্রতিগভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন তারা।
বরিশাল বিভাগ সমিতি
বরিশাল বিভাগ সমিতির সহ-সভাপতি গোলাম মুর্তাজা ও সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল কবির দুলু এক শোক বার্তায় বরিশাল বিভাগের কৃতি সন্তান ও দেশবরেণ্য প্রবীন সাংবাদিক সাদেক খানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চলে গেলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক সাদেক খান
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ