Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রভাবশালীদের চাপে অন্যায়কে প্রশ্রয় নয়

পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:৫৮ এএম, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৬

বিশেষ সংবাদদাতা : প্রভাবশালীদের চাপ যতই থাকুক, কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিতে পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের নামে কেউ প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করলে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি তার সঙ্গে যোগযোগ করারও নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্বলের স্বার্থ রক্ষার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, আমার দলেরও কেউ যদি প্রভাব খাটাতে চায়, অবশ্যই আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবেন। যোগাযোগের সুযোগ কিন্তু আছে। সবসময়ই এই যোগাযোগটা আমরা রাখি। ‘পুলিশ সপ্তাহ-২০১৬’ উপলক্ষে গতকাল বুধবার নিজ কার্যালয়ে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সবচেয়ে বড় কথা মানুষের আস্থা বিশ্বাস। আপনাদের কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে আসতে হবে, এখানে গেলে পরে নিরাপত্তা পাওয়া যাবে, ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, কিছু দুর্বল পরিবার, গ্রামে গ্রামে অনেকে থাকে। সেখানে তাদের জমি-জমা দখল করে নেয়া হয়। তাদের ওপর নানা রকম নির্যাতন করা হয়। তারা আশ্রয় চায় পুলিশের কাছে। দুর্বলদের সুরক্ষা করতে হবে। তাদের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, সব থেকে এখন বড় সমস্যা দেখা যাচ্ছে মাদক। এই মাদক সমাজের সর্বস্তরে। সমাজের উচ্চমহল থেকে নিচের মহল পর্যন্ত মাদকের প্রভাবে বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমাদের যুবসমাজের অনেকে বিপথে চলে যাচ্ছে এবং তাদের জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, এই মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। আরও বেশি কঠোর হতে হবে। এদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের সেবা, কল্যাণ, মঙ্গল এটাই কিন্তু একমাত্র লক্ষ্য। আর সেটা করতে গেলে যেটা সব থেকে প্রয়োজন তা হলো আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি করা। আর সে দায়িত্বটা সার্বিকভাবে পুলিশের ওপরই বর্তায়। কাজেই পুলিশকে আমরা সেভাবেই তৈরি করে দিতে চাচ্ছি, যেন তারা তাদের স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করতে পারে। নিজেদের কাজ সম্পর্কে পুলিশের সচেতনতা ‘যথেষ্ট’ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা ‘সময়োপোযোগী’ পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে মনে করেন সরকার প্রধান। এর ফলে বাংলাদেশে যে একসময় জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি। আর অর্থনৈতিক অগ্রগতিও আমরা অব্যাহত রাখতে পারছি। ২০১৫ সালে সরকার উৎখাতের নামে তিন মাস যে ‘তা-ব’ চলে, সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশের ‘অগ্রণী’ ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জনান তিনি। ওইসময় নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ যেন কোনোভাবেই মাথাচাড়া দিতে না পারে এবং চোরাচালান ও নারী-শিশু পাচার যেন বন্ধ হয় সেদিকেও নজর রাখার নির্দেশ দেন তিনি।
কম্পোজিট ইউনিটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মান ও চাহিদা অনুযায়ী অতিদ্রুত বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক চাহিদা অনুযায়ী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেটা অতিদ্রুত। দৃশ্যমানও করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের আন্তর্জাতিক চাহিদা পূরণ করেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেই আমাদের চলাচলটা অব্যাহত থাকবে। আমরা যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই, সেখানে একটা কম্পোজিট ইউনিট করতেই হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা শুধু বাড়ানো নয়, এটাকে দৃশ্যমান করতে হবে। সেটা যদি না করি আমাদের বিমান কিন্তু লন্ডনে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমেরিকায় কিন্তু আমরা এখনো পাঠাতে পারছি না একটাই কারণে, এখনও আমরা আন্তর্জাতিকভাবে এ গ্রেডের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে পারিনি।
বাংলাদেশ বিমান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমানকে আমরা শক্তিশালী করেছি। ছয়খানা এসেছে, আরো চারখানা উড়োজাহাজ আসবে। সারা বিশ্বে আমাদের বিমান যাক সেটা আমরা চাই।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, সড়ক, মহাসড়ক, রেলওয়ে ও পর্যটনের নিরাপত্তার বিষয়েও নজর দেয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস সৃষ্টির বিষয়েও গুরুত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। বাহিনীর সদস্যদের সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সকলের বেতন বলতে গেলে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করেছি। পৃথিবীর কোনো দেশে আজ পর্যন্ত কোনো সরকার শতভাগের ওপর বেতন বৃদ্ধি করতে পারে নাই। আমরা কিন্তু তা করে দিয়েছি। আমরা চাই সবার জীবনযাত্রা সহজ হোক, সুন্দর হোক।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বছরকে আমরা পর্যটন বছর ঘোষণা করেছি। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব বাড়াতে কর্মক্ষেত্রে সবাইকে চেইন অব কমান্ড মেনে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের হরতাল-অবরোধের নামে নৃশংসতা মোকাবেলা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থীদের দমনে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বোমা হামলা মামলার তদন্তেও পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন আপনারা।
দেশের জিডিপির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করার পেছনে পুলিশ বাহিনীরও অবদান রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অর্জন করবো। বিগত সময়ে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের সহিংসতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তা-ব না হলে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত করা যেতো।
তিনি বলেন, পুলিশের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি। পুলিশের বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছি। ঝুঁকিভাতার প্রচলন করেছি। কল্যাণ ফান্ড গঠন করেছি। রেশন বাড়িয়েছি। নতুন নতুন থানা ও ব্যারাক নির্মাণ করেছি। রাজারবাগে ১০ তলা বিল্ডিং করেছি। পুলিশের জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন সংগ্রহ করেছি। আমাদের কার্যকর পদক্ষেপের ফলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশের উন্নয়নে গত ৭ বছরে আমাদের সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে পুলিশের জনবল আজ দেড় লক্ষাধিক। আমরা জনবল আরও বৃদ্ধি করবো।
ইতোপূর্বে আমরা আইজিপি’র র‌্যাংক ব্যাজ পুনঃপ্রবর্তন করেছি। আইজিপি’র পদ ছাড়া পুলিশে আরও ২টি গ্রেড-১ পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ব্যাপক পদোন্নতি দিয়েছি। রংপুর রেঞ্জ, রংপুর রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স, দু’টি র‌্যাব ব্যাটালিয়নসহ আমরা বিশেষায়িত পুলিশ ইউনিট- স্পেশাল সিকিউরিটি প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন (এসপিবিএন), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ-পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, গঠন করেছি। আমরা ৩১টি নতুন থানা ও ৭০টি তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন করেছি। থানাগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবল এবং বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা পদায়ন করা হচ্ছে। পুলিশের আবাসন, অফিসের স্থান সংকট নিরসনে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি।
বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে আমাদের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ছিলো না। এখন সেই সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে পেরেছি। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে বিশেষায়িত ইউনিট গঠনের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকল সংকট কাটিয়ে তুলে আমরা গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তার সুদৃঢ় ভিত্তি নির্মাণ করে আপনারা দেশের উন্নয়নকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন-এ আমার প্রত্যাশা।
মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন সমস্যা ও দাবির কথা তুলে ধরেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাবিগুলো হলো- পুলিশ ডিভিশন প্রতিষ্ঠা, থানা ও আলামত সংগ্রহের স্থান বৃদ্ধি, পুলিশের আবাসন সমস্যা নিরসন, থানা প্রতি ৫টি পিক-আপ ভ্যান, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নীতকরণ, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পুলিশের একজন লিয়াজোঁ কর্মকর্তা নিয়োগ এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, দুদক, পাসপোর্ট অফিস, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষ, কারা অধিদফতরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রদান। এছাড়া পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে অন্তত আরো ১০টি গ্রেড-১ পদ সৃষ্টি। বর্তমানে পুলিশের আইজিপি’র পদ ছাড়াও আরো ২টি গ্রেড-১ পদ রয়েছে। এসব দাবি প্রসঙ্গে কাজের গতি বাড়াতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কতোগুলো বিভাগ করে আরো কয়েকজন সচিব নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা চলছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
পুলিশের বিমা পলিসি ও পুলিশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার দাবি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, পুলিশের কাজ ঝুঁকিপূর্ণ। একটা বিমা পলিসি থাকা প্রয়োজন। তবে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে ৪০০ কোটি টাকা লাগে। এ টাকা আপনারা যোগাড় করতে পারলে ব্যাংক করতে পারেন। পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে নিজের উপলব্ধির কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র সমস্যাগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে না ধরে সবগুলোর সমন্বয় করে বড় প্রজেক্ট আকারে প্রস্তাব নিয়ে আসার পরামর্শ দেন।
মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোজ্জাম্মেল হক খান, পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহিদুল হক, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেছুর রহমান, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি ইকবাল বাহার, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান, নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপার আমেনা বেগম।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রভাবশালীদের চাপে অন্যায়কে প্রশ্রয় নয়
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ