Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ

প্রকাশের সময় : ১৭ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ডা. বরুণ কুমার আচার্য (বলাই)
গতকাল ছিল ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ১৯৭৪ সালে ফারাক্কার বাঁধ চালু হয়। ১৯৭৬ সালের এই দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে সারাদেশের লাখ লাখ মানুষ রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দান থেকে মরণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চে অংশগ্রহণ করে। দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জনদুর্ভোগের জন্য তারা ওইদিন লংমার্চ করে ভারত সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানায়। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেন মওলানা ভাসানী। তাই এ দিনটি আজও শোষণ, বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং দাবি আদায়ের পক্ষে বঞ্চিতদের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। উল্লেখ্য, ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৭০ সালে শেষ হয় বাঁধটির নির্মাণ কাজ। অথচ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে, শীতকালের শুষ্ক মৌসুমেও পদ্মা নদী থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি পেত বাংলাদেশ। ফারাক্কার অভিশাপে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৯ ফুট উঁচুতে অবস্থিত রাজশাহীর গোদাগাড়ীসহ সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়তই নিচে নামছে। এতে অগভীর কোন নলকূপ থেকে বর্তমানে কোন পানি উঠছে না। সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্থানভেদে ১-২ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে। এরমধ্যে ২০১০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে খ্যাত গোদাগাড়ী এলাকায় পানির স্তর ছিল মাটির ১৯ ফুট গভীরে। ২০১১ সালে স্থানভেদে ১৯-২১ ফুট। ২০১২ সালে ২০-২৩ ফুট এবং ২০১৩ সালে পানির স্তর ছিল স্থানভেদে ২৩-২৫ ফুট মাটির গভীরে। চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি প্রদান করবে। শুষ্ক মৌসুমের এ সময়ে ভারত বাংলাদেশকে চুক্তি অনুযায়ী পানি প্রদান করলে পদ্মায় অন্তত পানি প্রবাহ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। গত নভেম্বরের প্রথম থেকেই পদ্মায় পানির প্রবাহ একেবারেই কমে যায়। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পদ্মায় সর্বোচ্চ পানির পরিমাণ রেকর্ড করা হয় ২৪ দশমিক ১৪ মিটার। গত কয়েক বছর থেকে পদ্মায় পানির পরিমাণ ১৩-১৪ মিটারে উঠা-নামা করে। তবে এক দশক পর গত ৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহী অঞ্চলে পদ্মার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপরে ১৮ দশমিক ৬২ মিটারে। পরদিন সকালে পদ্মার পানি ১২ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার নিচে এসে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৪৬ মিটারে।
স্বাধীনতার পর ভারত পরিণত হয়েছিল আধিপত্যবাদী প্রধান শক্তিতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দেয়াকে পুঁজি বানিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রাথমিক দিনগুলোতেই ভারত বাংলাদেশকে অবাধ লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দু’ দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ি ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে ভারত পেয়েছিল ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সম্মতি। এই সম্মতির ভিত্তিতে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সর্বনাশ সূচিত হয়েছিল। দেশ ও জাতির সেই দুঃসময়ে অভয় ও আশ্বাসের বাণী নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন মওলানা ভাসানী। তার আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের একটি উদাহরণ হিসেবে এখানে ফারাক্কা মিছিলের উল্লেখ করা দরকার। মজলুম জন নেতা ইন্তেকালের মাত্র ছয় মাস আগে, ৯৬ বছর বয়সে ঐতিহাসিক এ মহামিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৬ মে, ১৯৭৬ কৃষক-শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রেণির মেহনতি মানুষ থেকে শুরু করে সর্ব স্তরের লাখ লাখ নারী-পুরুষ সে মিছিলে অংশ নিয়েছিল। রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানে মওলানা ভাসানীর দেয়া ১০ মিনিটের ভাষণের মধ্য দিয়ে মিছিলের শুরু হয়েছিল। রাজশাহী থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে কানসাটে গিয়ে ১৭ মে মিছিলের সমাপ্তি টেনেছিল মওলানা ভাসানী। কানসাট হাই স্কুল ময়দানে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘ভারত সরকারের জানা উচিত, বাংলাদেশীরা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায় না, কারো হুমকিকে পরোয়া করে না।’
ফারাক্কা মিছিল কোনো আকস্মিক ঘটনা বা মওলানা ভাসানীর দিক থেকে কোনো বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি ছিল না। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ভারতবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তিনি প্রথম থেকেই দাবি জনিয়েছেন বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়ার জন্য। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বিরুদ্ধেও তিনি কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন।
তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ার পরই তিনি ফারাক্কা মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলে। ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকায় এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, ‘গঙ্গা আন্তর্জাতিক নদী। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী ভারত এককভাবে এই নদীর পানি ব্যবহার করতে পারে না।’
প্রতিবাদী কর্মসূচি হিসেবে ফারাক্কা মিছিলের জন্য ১৬ মে দিনটি নির্ধারণ করার পেছনের কারণ ছিল, ১৯৭৪ সালের ওই দিনটিতেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি। ফারাক্কা মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণার পাশাপাশি ভাসানী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। জবাবে ইন্দিরা গান্ধী তার চিঠির শেষাংশে লিখেছিলেন, ‘কারো এ কথা মনে করা উচিত নয় যে, ভারত কোনো হুমকি বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অযৌক্তিক দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করবে।’ কথাটার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল। জবাবে মওলানা ভাসানী লিখেছিলেন, ‘সমস্যার সমাধান হতে হবে স্থায়ী এবং ব্যাপকভিত্তিক। এই সমাধান শুধু শুষ্ক মৌসুমের জন্য হলে চলবে না, সারা বছর ধরে পানির প্রবাহ একই পরিমাণ হতে হবে।’ সংঘাত ও শত্রুতা এড়িয়ে এবং আমলাদের পরিবর্তে রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্জন করার আহ্বানের পুনরুল্লেখ করে চিঠির শেষ দিকে মওলানা ভাসানী লিখেছিলেন, ‘আপনি যদি আমার এই অনুরোধ রক্ষা না করেন, তাহলে সমস্যার সমাধান অর্জনের জন্য আমি ভবিষ্যৎ সংগ্রামের কর্মসূচি নির্ধারণ করতে বাধ্য হবো।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আর কোনো সাড়া না পাওয়ায় মওলানা ভাসানী ফারাক্কা মিছিলের কর্মসূচি পরিবর্তন করেননি। ১৭ মে মিছিল শেষ হয়েছিল কানসাটে গিয়ে, বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে। মিছিলের আতঙ্কে ভারত সরকার রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের দরিদ্র নিরস্ত্র মানুষের ভয়ে ভারতকে যখন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করতে হয়েছে তখন তার অবিলম্বে ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত।’
এ কথা সত্য যে, ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাবের কারণে মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিল সমস্যার স্থায়ী সমাধান অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে, মূলত এই মিছিলের জনপ্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর ব্যাপক প্রচারণার ফলেই ভারতকে বহুদিন পর বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে হয়েছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালেই জাতিসংঘে ফারাক্কা বাঁধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক কমিটির ২৪ নভেম্বরের সর্বসম্মত বিবৃতির ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শেষে ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল ‘ফারাক্কা চুক্তি’। বাংলাদেশের অনুকূলে ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ ছিল চুক্তিটির উল্লেখযোগ্য বিষয়। ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ থাকায় ভারত কখনো যথেচ্ছভাবে পানি প্রত্যাহার করতে কিংবা বাংলাদেশকে কম হিস্যা দিতে পারেনি।
লেখক : সভাপতি, চট্টগ্রাম সাহিত্য সমাজ অনুশীলন কেন্দ্র।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ
আরও পড়ুন