Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের পাশে একজন সালমা চৌধুরী ও আমরা

প্রকাশের সময় : ১৭ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফাহমিদা আহমদ
সেদিন ছিল মাদার’স ডে। ৮ মে ২০১৬ খবরের কাগজে চোখ মেলতেই দৃষ্টি পড়ল উধরষু ংঃধৎ-এর প্রথম পাতায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী খবর দেখে। ‘গড়ঃযবৎং ফধু ঃড়ফধু’ ঋড়ৎ পযরষফৎবহ রিঃয ঈধহপবৎ শিরোনামে উঠে এসেছে এক মমতাময়ী মায়ের নিবেদিত আত্মত্যাগের এক করুণ উপাখ্যান। যে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের সেবা দেয়ার ব্রত নিয়ে। সালমা চৌধুরী। মাত্র তিন বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুপুত্রকে হারিয়ে ঢাকার সেন্ট্রাল রোডে গড়ে তুলেছেন ক্যান্সার নিরাময় কেন্দ্র। শুধু তাই নয় এছাড়াও তিনি ধানমন্ডিতে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন অনকোলজি ও প্যালিয়াটিভ কেয়ার সেন্টার। ভবিষ্যতে বাংলামোটরেও এরূপ একটি ক্যান্সার নিরাময় কেন্দ্র খোলার আন্তরিক ইচ্ছে আছে তার। গত ১৬ বছর ধরে তিনি তার এই কাজ নীরবে নিভৃতে করে যাচ্ছেন। যেখানে মরণঘাতী রোগে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের বিনামূল্যে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তিনি তার এই সেন্টার হোমটির নাম দিয়েছেন অঝঐওঈ (অ ঝযবষঃবৎ ভড়ৎ যবষঢ়ষবংং রষষ পযরষফৎবহ)। সম্পূর্ণ শিশুবান্ধব পরিবেশে ডিজনীল্যান্ড ও মিকি মাউসের আদলে গড়ে উঠেছে এই হোমটি। অসুস্থ শিশুদের জন্য রাখা হয়েছে খেলাধুলারও ব্যবস্থা। মাত্র তিন বছর বয়সে সালমা চৌধুরীর ছেলে আশিক হোসেন চৌধুরী ১৯৯৩ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। নয় মাস বয়স থেকেই শিশু আশিক বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার কিডনিতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। পরে তা দ্রুত লিভার ও ফুসফুসে ছড়িয়ে যায়। সালমা চৌধুরী ও তার স্বামী সর্বস্ব দিয়ে তার শিশু সন্তানকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে শিশুটি চলে যায় না ফেরার দেশে। ইতিমধ্যে সালমা হারান তার আরেক মেয়ে মুনিয়াকে। যে ১৯৭৭ সালে একটি মারাত্মক রোড অ্যাক্সিডেন্টে ইন্তেকাল করেন।
দুই সন্তানের মৃত্যুতে সালমা চৌধুরী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। সন্তান হারানোর শোককে তিনি শক্তিতে পরিণত করেন। ঠিক করেন বাংলাদেশে ফিরে আসবেন। ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে স্বামীসহ চলে আসেন ঢাকায়। নিজের সর্বস্ব দিয়ে ২০০০ সালে গড়ে তোলেন অঝঐওঈ ফাউন্ডেশন। বিশেষত গ্রামে বসবাসরত অসুস্থ শিশুদের জন্যই তিনি এই ফাইন্ডেশন গড়ে তোলেন। যেসব শিশুর ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে হয়। যাদের থাকা-খাওয়ার কোন সংকুলান নেই তাদের জন্য এই অঝঐওঈ ফাইন্ডেশন। এ যাবৎ অঝঐওঈ ফাউন্ডেশন ১০০০ শিশুকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে। বর্তমানে এগারো জন অসুস্থ শিশু এখানে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে। সালমা চৌধুরীর মেয়ে আমেরিকা প্রবাসী মাহিন হামিদ ও পুত্র সিঙ্গাপুর প্রবাসী আসিফ চৌধুরী সবসময় অঝঐওঈ ফাউন্ডেশনের ফান্ড বৃদ্ধি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। অচিরেই তিনি চলতি আগস্ট মাসে বাংলামোটরে আরেকটিু সেবাকেন্দ্র চালু করতে যাচ্ছেন।
এছাড়াও সালাম চৌধুরী ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছেÑ ফ্যালিয়াটিভ কেয়ার সেন্টার। যেখানে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের শেষ পর্যায়ের চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। এই প্যালিয়াটিভ সেন্টারের উদ্দেশ্যই হলো শেষ সময়ে শিশুটিকে আরামে রাখা। যাতে শিশুটির মৃত্যুযন্ত্রণা কম হয়। সালাম চৌধুরীর একান্ত ইচ্ছে ভবিষ্যতে তিনি শিশুদের জন্য একটি বিশ্বমানের ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তুলবেন। যার মাধ্যমে তিনি ভুলে থাকবেন তার সন্তান হারানোর ব্যথা। আমরা স্যালুট জানাই সালমা চৌধুরীকে আর তার স্বপ্নকে। সবার সহযোগিতা পেলে নিশ্চয়ই তিনি তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন। আমরাও সেই আশা করছি।
ক্যান্সার শিশুদের জন্য নীরব ঘাতক। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১৩ হাজার শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। পৃথিবীর ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৯০ ভাগই দরিদ্র ও উন্নয়নশীর দেশে বসবাস করে। এসব শিশুর প্রতি ১০ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন উন্নত চিকিৎসা পায়। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর ২ লাখের কাছাকাছি শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সার শুনলেই ধরে নেয়া হয় এ রোগ আর সারবে না। এর কোন চিকিৎসা নেই। অনেক টাকার ব্যাপার ইত্যাদি। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন দুর্বল ও নি¤œমানের রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা, চিকিৎসক সংকট হচ্ছে শিশু ক্যান্সার নিরাময় জটিল এমন ভুল ধারণার কারণে এ রোগে আক্রান্তদের বেঁচে থাকার হার কম। তারা বলছেন প্রকৃতপক্ষে শিশু ক্যান্সারের চিকিৎসা দরিদ্র দেশগুলোতেও সম্ভব এবং সাধারণ ও স্বল্পমূল্যের ওষুধ এবং চিকিৎসকদের যুগ যুগ ধরে জানা পদ্ধতিতে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শিশুর জীবন বাঁচানো যায়। গ্রামগঞ্জে হাতুড়ে চিকিৎসাও একটি বড় সমস্যা। ঝাড়ফুঁক, টোটকা কবিরাজ, ফকিরি বা এই ধনের অপচিকিৎসকের পাল্লায় পড়ে রোগ নির্ণয়ে যেমন দেরি হয় তেমনি শারীরিক অবস্থারও অবনতি হয়। এসব অপচিকিৎসার মাধ্যমে বিপন্ন হয় রোগীর জীবন। ক্যান্সার মোকাবেলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা ২০০৯-১৫ প্রণয়ন করেছে। এ কর্মপরিকল্পনার উদ্দেশ্য হল একটি সমন্বিত ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ক্যান্সার নিরাময় কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের জন্য উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বল্পমূল্য ও বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। সরকারি ব্যবস্থা যা আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এজন্য সমন্বিতভাবে বেসরকারি তথা ব্যক্তি উদ্যোগ অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে সালমা চৌধুরী একটি অনন্য উদাহরণ। প্রাথমিক পর্যায়ে ছোট আকারে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের সেবা দান করে এখন তিনি বৃহৎ পরিসরে একটি বিশ্বমানের ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণের স্বপ্ন দেখছেন। এজন্য তিনি তার সর্বস্ব বিনিময়ে দিয়েছেন। আমাদের প্রয়োজন এরকম অসংখ্য সালমা চৌধুরী। যারা দুস্থ মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিবেন আমাদের সমাজে এরকম অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি আছেন যাদের একটুখানি সদিচ্ছায় অসহায় দুস্থ মানুষের চিকিৎসাসেবার নিশ্চিত হতে পারে। আবার অনেকের ব্যাংকে প্রচুর টাকা জমা থাকলেও ঠিক কোন খাতে তা ব্যয় করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সবার আন্তরিক সদিচ্ছা থাকলেই আমরাই গড়ে তুলতে পারি একেকটি বিশ্বমানের হাসপাতাল তথা নিরাময় অথবা সেবাকেন্দ্র। আজ সময় এসেছে এ সত্যটি অনুধাবন করার। আমরা চাই সালাম চৌধুরীর মত আরো সালমা চৌধুরী এ ধরনের সেবার ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসুক। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আর একটি শিশুও যেন আকালে প্রাণ বিসর্জন না দেয় আমরা সেই দিনটির অপেক্ষায় আছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের পাশে একজন সালমা চৌধুরী ও আমরা
আরও পড়ুন