পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
হাসান সোহেল : পরিবর্তন হচ্ছে চোখে পড়ার মতোই। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠছে দেশ। সম্ভাবনার দিগন্তে উড়ছে পতাকা। রাজনৈতিক অস্থিরতা আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যেই ভিতরে ভিতরে পাল্টে যাচ্ছে দেশের চিত্র। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে গড়ে উঠছে নতুন নতুন অবকাঠামো। রানা প্লাজা ট্রাজেডি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি প্রপাগা-ায় বিদেশী বিনিয়োগ কমে গেলেও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বেশ কিছু অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে-হচ্ছে। দেশে পুঁজি বিনিয়োগে বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে পদ্মা সেতু প্রকল্প, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, পানগাঁও নৌ টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, গ্যাস সংকট নিরসনে এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্প, মেট্টোরেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা সমুদ্র বন্দর, রাজধানীর চারপাশে সুয়্যারেজ ট্যানেল নির্মাণের মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। সম্প্রতি উন্নয়নের এ কর্মযজ্ঞে যোগ হয়েছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প এবং দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম প্রকল্প। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি অঞ্চলের কাজের উদ্বোধনও করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ নিরাপদ এবং পণ্য পরিবহন-খালাস সহজীকরণ করতে নেয়া আরো কিছু অবকাঠামোর সংস্কার হচ্ছে। একই সঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তি খাতেও এগিয়েছে দেশ। ১৬ কোটি মানুষের দেশে কয়েক বছরে সক্রিয় মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি, আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে ৫ কোটি মিলিয়ন। দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ মহাকাশে উৎক্ষেপণের কাজ এগিয়ে চলছে। আগামী বছরে যা উৎক্ষেপণ করা হবে। এর মাধ্যমে দেশের সব মানুষকে যোগাযোগ ও সম্প্রচার সুবিধার আওতায় আনার পাশাপাশি দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা নিশ্চিত হবে। এমনকি স্যাটেলাইটের বর্ধিত ফ্রিকোয়েন্সি ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রাও উপার্জন করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা এবং কাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আসবেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই উন্নযনের বড় বড় প্রকল্পগুলোর কাজের সর্বদা তদারকি করছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গুরুত্বপুর্ণ প্রকল্প পর্যবেক্ষণ করছেন। ইতোমধ্যেই চীন, জাপান, জার্মানীর মতো দেশ বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে। নতুন নতুন এসব অবকাঠামো অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করবে বিনিয়োগে। বিদেশী বিনিয়োগ এলে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতির চিত্র। এখন প্রায় মধ্যম আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখছে মানুষ। তখন স্বপ্ন নয়; বিশ্বদরবারে বাস্তবে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ।
এসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও স্থিতিশীল পরিবেশ থাকলে বিদেশিরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। যার মাধ্যমে গতি পাবে দেশের অর্থনীতিও। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এমন সম্ভাবনার তীরে দাঁড়িয়ে থাকার পরও রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশের বাইরের স্মরযন্ত্র, অবকাঠামোগত দুর্বলতাসহ নানা বাধায় পড়তে হচ্ছে। আর এর জন্য একটি স্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করার তাগিদ দিয়েছেন দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, রিজার্ভ এবং মাথাপিছু আয় বেড়েছে। জিডিপি সন্তোষজনক। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে এসব অবকাঠামো গড়ে উঠলে দেশ হবে অপার সম্ভাবনার। পিছনে তাকানোর সময় থাকবে না। অর্থনৈতিকভাবে পাল্টে যাবে দেশ। উন্নয়নের সেই সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে।
প্রধানন্ত্রীর মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত শক্তিশালী হচ্ছে। ভিশন-২১ সামনে রেখে সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিনিয়োগ। এ জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের অগ্রগতি সন্তোষজনক জানিয়ে তিনি বলেন, এখন বিনিয়োগকারীরা চাইলেই বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। বিনিয়োগ আকর্ষণে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি ফাস্ট ট্রাকভুক্ত প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
এদিকে মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার পথে রয়েছে বাংলাদেশ। এ সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, মধ্য আয়ের দেশ হতে গেলে দুটি ইনডেক্স ধরা হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে দুটি ইনডেক্সেই সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। আমরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি তা অত্যন্ত আশা জাগানিয়া। বাংলাদেশের জিডিপি সম্পর্কে তিনি বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় আমাদের জিডিপি একটি নির্দিষ্ট ধারায় আছে। একই সঙ্গে পার ক্যাপিটা ইনকামের দিক দিয়ে আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি। তবে এক্ষেত্রে দুটি শর্ত আছে। জাতিসংঘের একটি কমিটি আছে, যারা তিন বছর সময় নিয়ে কোনো দেশকে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণা করে থাকে। আর তাই বাংলাদেশ ২০১৮ সালে আবেদন করবে, তারপর তারা ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশ ঘোষণা করবে।
দেশের অর্থনীতি ও প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রবাসীরা বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় অংশটি আসে প্রবাসীদের মাধ্যমেই। এদিকে বৈদশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। প্রথমবারের মতো যা ২৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে এই রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ছাড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। যা দিয়ে দেশের আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন সমালোচনা করে আসলেও মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ মেনে নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। দাতা প্রতিষ্ঠানটি আগের পূর্বাভাস থেকে সরে এসে বলছেÑ এটা নিয়ে তর্ক করা অবান্তর। সংস্থাটির নয়া কান্ট্রি ডিরেক্টর স্পষ্ট করে বলেছেন, বিরূপ বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্জন ঈর্ষণীয়। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেন, জিডিপি পূর্বাভাস ৬ দশমিক ৫, ৬ দশমিক ৮ কিংবা ৭ এর ওপর হতে পারে। তবে এটা প্রশংসনীয় যে বাংলাদেশের জিডিপি এখন ৬ এর বেশির ঘরে পৌঁছাচ্ছে।
সার্বিকভাবে বিশ্বব্যাংক বলছে, সামস্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে, জ্বালানি তেলের কম মূল্যও সহায়ক হয়েছে। সরকারের জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। তারপরও দুশ্চিন্তার জায়গা হিসেবে তারা বলছে, বেসরকারী বিনিয়োগ বন্ধ্যাত্ব, বিনিয়োগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অপর্যাপ্ত সরবরাহ, সর্বোপরি রাজনীতিক অনিশ্চয়তা।
অথচ স্বাধীনতার পর হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে অবিহিত করেছিলেন। পাকিস্তানী শোষণ ও বঞ্চনার কারণেই উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশকে ভঙ্গুর অর্থনীতির হাল ধরতে হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ শুধু দরিদ্রই ছিল না, দারিদ্র্য দূর করার যে হাতিয়ারগুলো দরকার সেটাও ছিল না। ছিল না অর্থ, অবকাঠামো বা দক্ষ জনশক্তি। তখন বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ, অর্ধাহার-অনাহারকবলিত, বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি দেশ হিসেবে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ভঙ্গুর ও নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে এর স্থায়িত্ব সম্পর্কে সন্দিহান ছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বিদেশী সাহায্যনির্ভর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ফাল্যান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ পারকিন্সন বাংলাদেশকে বলেছিলেন ‘উন্নয়নের পরীক্ষাগার’। ১৯৭৬ সালে তাদের বই ‘বাংলাদেশ: স্টেট কেস ফর ডেভলপমেন্ট’-এ উল্লেখ করেন, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব হলে পৃথিবীর যে কোন দেশের পক্ষেই উন্নয়ন সম্ভব। ২০০৭ সালে এরা তাদের মত থেকে সরে আসেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘তিন দশকের সীমিত ও বর্ণাঢ্য অগ্রগতির ভিত্তিতে মনে হয় বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।’ এখন বাংলাদেশকে উন্নয়ন পরীক্ষাগারের পরিবর্তে উন্নয়ন মডেল বলছেন।
অবশ্য এর জন্য ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করার জোর প্রচেষ্টা চলছে। এই সেতু শুধু দেশের স্বপ্নই নয়; বিদেশী অনেক বিনিয়োগকারীও এই সেতুর ওপর চোখ রাখছেন। শুধু সেতুই নয়; সম্প্রতি ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতুর উপর রেল সংযোগ প্রকল্পের অনুমোদন হয়েছে।
এই পদ্মা সেতু এবং রেল সংযোগ চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর স্থলপথ সংযোগ স্থাপনে গতি আসবে। বিনিয়োগের সুযোগ বাড়বে। শুধু পদ্মা সেতুই নয়; ইতোমধ্যেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনের সুবিধা ভোগ করছে জনগন। যা পণ্য পরিবহনসহ যোগাযোগকে সহজতর করেছে। এর মাধ্যমে আশাতীত গতি পাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। বড় বড় চ্যালেঞ্জ পাড়ি দিতে হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে। ২০১৮ সালে ট্রেন ও যানবাহন চলবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (উড়াল সড়ক) মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ আগামী অক্টোবর থেকে শুরুর কথা বলেছেন ওবায়দুল কাদের। ৪২ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়াল সড়ক হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মহাখালী হয়ে তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মিত হবে। ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি জানান, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৭শ’ কোটি টাকা। তিনি বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের কাজের প্রস্তুতি অনেক দূর এগিয়েছে। ফান্ডিং-এর কোনো সমস্যা নেই।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে আরো কয়েকটি কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বুড়িগঙ্গা রক্ষা, ঢাকা শহরের চারপাশে নৌপথ, রেলপথ ও সড়ক পথ নির্মাণ, হাইটেক পার্ক নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, ট্যানারি স্থনান্তর, গার্মেন্টস পল্লী স্থাপন, ওষুধ শিল্প পার্ক স্থাপন, ঢাকা শহরের যানজট নিরসন ও সুন্দরবন সুরক্ষা ইত্যাদি।
এদিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি করে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে সরকারি-বেসরকারি অর্থায়নে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন কাজের উদ্বোধনও করা হয়েছে। বাকী অঞ্চলগুলোও প্রক্রিয়াধীন। এতে চীন, জাপান, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কুয়েতের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এখানে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিনিয়োগকারীদের জন্য বিদ্যুৎ এবং উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
অপরদিকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে এবং বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছে সরকার। বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উপস্থাপন করছে। যাতে সবার সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো যায় এবং অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থানে পৌঁছতে পারে।
মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংকিং সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকসের এক প্রতিবেদনে সম্ভাবনাময় ১১টি দেশের তালিকা করা হয়েছে। এ দেশগুলোর অর্থনীতি এগিয়ে আসছে বলে এদের নাম দেয়া হয়েছে ‘নেক্সট ইলেভেন’। এই উদীয়মান ১১টি দেশের একটি বাংলাদেশ। সংস্থাটি বাংলাদেশ সম্পর্কে বলেছে, দেশটির বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার বেশিরভাগই তরুণ। এদের মাধ্যমে দেশটির ভবিষ্যত বদলে দেয়া সম্ভব।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সব ধরনের সুযোগ বাংলাদেশে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের পূর্ভাভাসে বলেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ নেক্সট ইলেভেন সম্মিলিতভাবে ইউরোপিয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। লন্ডনের জাতীয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির বিচারে পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া মুডি’স ও স্ট্যান্ডার্ড এন্ড পুওর’স গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশের সন্তোষজনক অর্থনৈতিক রেটিং দিচ্ছে। তাদের প্রক্ষেপণও সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ইঙ্গিত করে। এসব পূর্বাভাস প্রমাণ করে, বাংলাদেশের সামনে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩১৬ ডলারে। যা গত অর্থবছরে ছিল ১১৯০ ডলার। মাথাপিছু আয় বাড়ায় বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান এখন ৪৪তম স্থানে। যা গতবছরও ছিল ৫৮তম অবস্থানে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জাতীয় আয় বাড়ার পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও ও গড় আয়ু বেড়েছে। বর্তমান গড় আয়ু ৭০ দশমিক ৭ মাস। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি অর্জিত হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, তা ছাড়িয়ে ৭ দশমিক শূন্য ৫ হওয়ার কথা জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
কয়েক বছর আগে বিশ্ব ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই এখন ১৮৫১ ডলার, এটা অব্যাহতভাবে ২ দশমিক ১ ভাগ এবং মোট জিডিপি বছরে নিয়মিতভাবে সাড়ে তিন ভাগ হারে বৃদ্ধি পেতে হবে। আর তাহলেই ২০২১ সালে বাংলাদেশ তার ৫০তম স্বাধীনতাবার্ষিকী উদযাপনকালে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে।
বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করতে ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোয় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসংবলিত পৃথক ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার কথা বললেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের জন্য ট্যাক্স হলিডে, কম সুদে ঋণ দেয়াসহ আকর্ষণীয় আলাদা কিছু অফারের বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এমন কিছু করতে হবে যেন বিনিয়োগকারীরা সহজে আকৃষ্ট হন। একই সঙ্গে দেশে যে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে তা বিশ্ববাজারে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
গত চার দশকে বাংলাদেশের অর্জনের তালিকা কম নয়। কৃষি প্রধান দেশ হলেও কিছুদিন পূর্বেও বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। সত্তর দশকের প্রথম দিকে দেশে চাল উৎপাদন হতো এক কোটি টন। জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। উৎপাদিত খাদ্যে ষাটভাগ চাহিদা মিটতো। বাকি খাদ্য আমদানি করতে হতো। বিদেশি মুদ্রার মজুদ ছিল সামান্য। তাই খাদ্যের জন্য বিদেশিদের কাছে হাত পাততে হতো। গত চার দশকে দেশে কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে এক খাদ্য বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ খাদ্যে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিদেশেও চাল রফতানি করা হচ্ছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে বেড়েছে খাদ্য চাহিদা। একই সঙ্গে বাড়ছে খাদ্য উৎপাদনও। জমির পরিমাণ কমলেও উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, গত ২৭ বছরের ব্যবধানে আউশ উৎপাদনের জমির পরিমাণ কমেছে ৪৩ লাখ একর, আমনের কমেছে দেড় লাখ একর। একই সময়ে আমনের উৎপাদন বেড়েছে ৫৫ লাখ টন ও বোরোর বেড়েছে এক কোটি ৪৩ লাখ টন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বরং ওই ঝুড়ি এখন খাদ্য ও বিদেশি মুদ্রায় পরিপূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এখন আমাদের অর্থনীতির অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের টেকসই প্রবৃদ্ধির মূলে ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স। স্বাধীনতার আগে গুটিকয়েক বাংলাদেশি বিদেশে কাজ করতেন। এখন দেড়শতাধিক দেশে প্রায় কোটি বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। রেমিট্যান্স রিজার্ভে এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।
আর্থসামাজিক অগ্রগতির পথে দৃঢ়পদক্ষেপে এগুচ্ছে বাংলাদেশ। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেট ছিল ২৮০ কোটি টাকা। আর রাজস্ব ও উন্নয়ন মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে এর আকার ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। যা আগামী অর্থবছরে ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানা গেছে।
স্বাধীনতার পর প্রথম দশকের তুলনায় গত দশকে টাকার গড় নমিনাল জিডিপি ২৮ গুণ বেড়েছে। সত্তরের দশকে বাংলাদেশে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর গত এক দশক ধরে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে রয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আকাক্সিক্ষত ফলাফল দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রেখেছে। দারিদ্র্যের হার উল্লেখজনক হারে কমেছে। চার দশক আগেও এই হর ছিল ৭০ শতাংশের ওপরে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছেন, মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সাথে সাথে দেশে দারিদ্র্যের হার কমছে। তিনি জানান, ২০১৪ সালের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার শতকরা ২৪ দশমিক ৭ ভাগ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) অন্যতম একটি লক্ষ্য এ বছরের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। বিশ্বব্যাংক তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে আশা করেছে, বাংলাদেশ সময়ের আগেই লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম ২০১৩ সালের ফল অনুযায়ী দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭০ দশমিক ১ বছর। ২০১২ সালের এটা ছিল ৬৯ দশমিক ৪ বছর, যা তার আগের বছর ছিল ৬৯ বছর।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, প্রবৃদ্ধিতে গতি সঞ্চালক বৃহৎ প্রকল্পকে দ্রুত সময়ে বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নজরদারিতে এনেছি। এর মধ্যে সরকারের চলতি মেয়াদেই পদ্মা সেতু এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষ করা হবে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রতিবছর দশমিক ৫৬ শতাংশ হারে বাড়বে এবং অনগ্রসর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উন্নয়ন কর্মকা- ত্বরান্বিত হবে।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ দপ্তরের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, জিডিপি নিয়ে সরকার যেখানে আগে থেকেই বলে আসছে সেখানে আলাদা করে পূর্বাভাস দেয়ারতো দরকার নেই। বরং যেটা দরকার সেটি হচ্ছে এই হিসাব অর্থনীতি সম্পর্কে কী বলছে তা দেখা। ২০২১ সালে বংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হতে পারবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেছেন, সঠিক নীতি সহায়তা, কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে মধ্য আয়ের দেশ না হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে প্রথমইে দরকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ। যার প্রধান হাতিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তিনি বলেন, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ, স্বচ্ছতা-জবাবদিহীতা, কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারলে বিনিয়োগ আসবেই। সাবেক এই গভর্নর বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নের পাশপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বোপরি ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদেশীরা দেখবে বিনিয়োগের পরিবেশ। সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলেই বিদেশীরা বিনিয়োগে আসবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।