পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
২২ হাজারের বেশি অবৈধ গোডাউন : বাপা
চোখের সামনে এই বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থের রমরমা ব্যবসা চললেও দেখার কেউ নেই
থিনার, তারপিন, এসিড ও লসিয়াম কার্বাইডসহ বিপজ্জনক সব দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যালের গোডাউন গড়ে উঠেছে পুরান ঢাকার আবাসিক ভবনগুলোতে। ক্ষতিকর দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যালের গোডাউন আর বিভিন্ন কারখানার মধ্যেই লাখ লাখ আতঙ্কিত মানুষের বসবাস। নিমতলীর পর চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির ঘটনায় পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের এখন আতঙ্কে দিন কাটছে। যেকোনো সময় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শঙ্কা থাকা সত্তে¡ও ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁঁকিপূর্ণ কেমিক্যালের ব্যবসা চলে পুরান ঢাকায়।
পুরান ঢাকা ঘুরে দেখা গেছে, ইসলামবাগ, চকবাজার, নিমতলী, পোস্তগোলা, আরমানিটোলা ও লালবাগসহ আরো অনেক এলাকায় আবাসিক ভবনের নিচতলার পার্কিং স্পেস কেমিক্যাল গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু বাড়িতে কেমিক্যাল পণ্যের কারখানাও রয়েছে। প্রকাশ্যে এসব গুদাম থেকে কেমিক্যাল আনা-নেয়া করছেন ব্যবসায়ীরা। সবার চোখের সামনে এই বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থের রমরমা ব্যবসা চললেও তা দেখার যেন কেউ নেই।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, পুরান ঢাকার এসব গুদামে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইলসহ ভয়ঙ্কর সব কেমিক্যাল দাহ্য পদার্থ। এসব কেমিক্যাল সামান্য আগুনের স্পর্শ পেলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ফলে পুরান ঢাকার মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছেন। গত কয়েক বছরে কেমিক্যাল সংশ্লিষ্ট কারণে রাজধানীতে যতগুলো অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তার সব ক’টিই ঘটেছে পুরান ঢাকায়।
বিশেষজ্ঞরা ও বিস্ফোরক অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, কেমিক্যাল কোথায় মজুদ, সংরক্ষণ, ব্যবহার ও পরিবহন কিভাবে করতে হবে- তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। বিপজ্জনক এসব দাহ্য মজুদাগারের চারপাশে কমপক্ষে ১০০ মিটারের মধ্যে স্থায়ী স্থাপনার চিত্র, মজুদাগারের অবস্থান* এসবের নকশা তৈরি করে বিস্ফোরক পরিদপ্তরে জমা দিতে হবে। থাকতে হবে মজুদাগার বা দোকানের চারপাশে কমপক্ষে ২২ ফুট ফাঁকা। এ ধরনের কঠোর নীতিমালা কেবল কাগজে-কলমেই; বাস্তবে কেউ এটা মানছে না। নীতিমালার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যুগ যুগ ধরে চলছে বিপজ্জনক কেমিক্যালের ব্যবসা।
বিস্ফোরক অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, ইসলামপুরসহ আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করে আবাসিক ভবনে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ চার শতাধিক প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব গোডাউন ও কারখানার অধিকাংশেরই বৈধ কাগজপত্র ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন নেই। আর এসব গোডাউনে যেকোনো সময় ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।
বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমরা পেট্রোলিয়াম জাতীয় দ্রব্যের অনুমোদন দেই। পুরান ঢাকায় আমাদের অনুমোদিত কোনো গুদাম নেই। যেগুলো আছে সেগুলো সবই অবৈধ। সবার চোখের সামনে দিনের পর দিন এগুলো কিভাবে চলছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাঝে মধ্যেই সিটি কর্পোরেশন-জেলা প্রশাসন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালাচ্ছে। অবৈধ গুদামগুলো সিলগালা করা হচ্ছে, জরিমানা করা হচ্ছে। অনেককে জেলেও পাঠানো হচ্ছে। আমরা তাদের সহযোগিতা করি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নিরাপদ নগরী গড়ে তুলতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ লক্ষ্যেই পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণের জন্য আমরা অভিযান চালাচ্ছি। কিছু কেমিক্যাল গোডাউন ও কারখানা বিপজ্জনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। নিমতলীর ঘটনার পর সরকার এসব গুদাম সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেও বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই তা মানেননি। এগুলো অপসারণ অভিযানে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। আমরা এগুলো সরাবই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক হিসাবে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসাবাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গোডাউন অবৈধ। ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলে এখানে। যেকোনো সময় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাবাজারের বইয়ের ব্যবসায়ী শহীদুল্লাহ খান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমি পরিবার নিয়ে ইসলামবাগ এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরে বসবাস করি। তিন বছর আগে আমি জীবন বাঁচাতে সেই বাসা ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। কারণ, ওই বাসার নিচতলায় কেমিক্যাল গোডাউন ছিল। যখন জানতে পেরেছি আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল রাখা অবৈধ এবং অগ্নিকাণ্ডের এটিই একটি অন্যতম কারণ, তখনই পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে ওই বাসাটি ছেড়ে মালিবাগে চলে যাই।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, প্রায় প্রতিদিনই পুরান ঢাকার কোনো-না-কোনো রাসায়নিক কারখানা ও গুদামে কর্মরত শ্রমিকরা দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে আসছেন। কেমিক্যালে পোড়া রোগী বাঁচানো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে পড়ে। তাই অগ্নিকাণ্ডজনিত প্রাণহানির ঘটনা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
ফায়ার সার্ভিসের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকায় গত ১৫ বছরে ২০০ স্থানে ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর নেপথ্যে ছিল দাহ্য কেমিক্যাল। অথচ কেমিক্যাল আমদানি ও বিপণনে চলছে পদে পদে অনিয়ম ও অরাজকতা। যেমন বুটপলিশ ও উড (কাঠ) পলিশের নামে ছাড়পত্র নিয়ে প্রতি মাসে সিঙ্গাপুর, চায়না, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হচ্ছে শত শত কোটি টাকার ভয়াবহ বিস্ফোরক ও দাহ্য কেমিক্যাল। শুধু কেমিক্যালই নয়, এর নেপথ্যে ভুয়া ডিক্লারেশন দিয়ে আনা হচ্ছে নামীদামি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের মূল্যবান কাঁচামালের চালানও। প্রকাশ্যে অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে। নিয়ম অনুযায়ী, নারকোটিক্স ও বিস্ফোরক অধিদফতর থেকে ছাড়পত্রধারীরাই কেবল কেমিক্যাল বিক্রি করার কথা। কিন্তু পুরান ঢাকায় প্রায় সব ক’টি কেমিক্যাল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের ছাড়পত্র নেই। তারপরও এসব দেখার কেউ নেই। যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান এসব মনিটরিং করার কথা, তারাও প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা মাসোয়ারা নিয়ে সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করছে। নিয়ম অনুযায়ী, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কাঁচামাল রাখার জন্য গোডাউনগুলোতে যে ধরনের পরিবেশ থাকার কথা, সেটাও মানছে না কেউ। পুরান ঢাকার নিমতলী, বংশাল, মমতাজ মার্কেট ও আরমানিটোলা এলাকার অধিকাংশ ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছে বড় বড় কেমিক্যালের গুদাম। এর মধ্যে বহুতল ভবন রয়েছে কয়েক হাজারের বেশি; যেসব বহুতল ভবনে পরিবার নিয়ে সাধারণ মানুষ বসবাস করছেন।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কিছুই করার নেই। এসব গোডাউন দেখার জন্য বিস্ফোরক অধিদফতরসহ সরকারের বেশ কয়েকটি সংস্থা রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে জীবন ও সম্পদের অনেক ক্ষতি হয়। অনেকেই মনে করেন, আগুন লাগলে দেখা যাবে- এ জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেন না। এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সব ক্ষেত্রেই নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস চাইলেও এসব গোডাউন উচ্ছেদ করতে পারে না। উচ্ছেদ করতে হলে পুলিশ, সিটি কর্পোরেশন ও বিস্ফোরক পরিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সহায়তা প্রয়োজন।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠপর্যায়ের দু’জন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, হাতেগোনা কয়েকজনের একটি সিন্ডিকেট ওই কেমিক্যাল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। বড়জোর ৫০ থেকে ৬০ জন লাইসেন্সধারী কেমিক্যাল আমদানিকারকের হাতে জিম্মি এই সেক্টর। বারবার এরাই নামে-বেনামে পুরান ঢাকার অলিগলিতে গড়ে তুলেছেন কমপক্ষে ১০ হাজার প্রতিষ্ঠান। এরপর প্রকাশ্যে দেদার বিক্রি করছেন এসব ধ্বংসাত্মক বিস্ফোরক ও কেমিক্যাল দ্রব্য। মমতাজ মার্কেট, এ এম টাওয়ার, আরমানিটোলা, মিটফোর্ড, চকবাজার ও নিমতলী এলাকায় এদের রয়েছে শত শত আন্ডারগ্রাউন্ড গোডাউন।
নিমতলীর বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, নিমতলী, চুড়িহাট্টা, ইসলামবাগ ও লালবাগের এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে খোঁজ করলে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা বা গুদাম পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, আবাসিক ভবনের নিচতলায় কেমিক্যালের গোডাউন ও জুতার কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া নানা ধরনের অবৈধ পণ্য তৈরির কারখানাও রয়েছে। এসব কারখানার আশপাশের হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর ঝুঁঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরান ঢাকার অবৈধ কারখানার মধ্যে রয়েছে- ব্যাটারি তৈরি, নকল ওষুধ, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক সরঞ্জাম, নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবল, ঝালাই, খেলনা ও জুতা-স্যান্ডেলসহ শতাধিক ধরনের পণ্য তৈরির কয়েক হাজার কারখানা। বিভিন্ন জায়গায় এসব পণ্য উৎপাদনে দাহ্য কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে জুুতা তৈরির কারখানায় যে সলিউশন ব্যবহার করা হয়, সেগুলো খুবই বিপজ্জনক।
নিমতলী থেকে লালবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে জানা গেছে, এসব এলাকার বাসাবাড়িতে এখনো এ ধরনের রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ মজুদ রাখা হচ্ছে। চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর এসব এলাকার অবৈধ কারখানা ও গুদাম তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। দুর্ঘটনার ঝুঁকির বিষয়টি জানেন ব্যবসায়ীরাও।
স্থানীয় লোকজন জানান, এলাকায় ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ইচ্ছে করলেই আসতে পারে না। দিনের বেলায় তো আরো বেশি জটিলতা। সব সড়কে গাড়ি আর মানুষের জটলা থাকে। এখানে নিরাপদ বাসস্থান নিয়ে কারো কোনো ভাবনা নেই। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে কেউ ভাবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।