Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ভারত থেকে চাল আমদানি চলছেই - ধানে কৃষকের সর্বনাশ

প্রকাশের সময় : ১৫ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৪ পিএম, ১৪ মে, ২০১৬

ইনকিলাব রিপোর্ট : চলছে বোরো ধান কাটার মৌসুম। সারাদেশে ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। এক মণ ধান উৎপাদনে প্রায় ৬শ’ টাকা খবর হলেও এলাকা ভেদে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা থেকে ৪২০ টাকা ধরে। অথচ সরকার প্রতি মণ ধানের মূল্য বেঁধে দিয়েছে ৯শ’ ২০ টাকা। সরকার কৃষিবান্ধব প্রমাণের জন্য এ খবর মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারও করা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করছে না গুদামগুলো। বাধ্য হয়েই ধান বিক্রি করতে গিয়ে প্রতি মণ ধানে ২শ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা লোকসান গুণছে কৃষক। এলাকা ভেদে দেড় মণ থেকে ৩ মণ ধানের দরে এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। ধানে কৃষকের সর্বনাশ এখন ‘টক অফ দ্য কান্ট্রি’। গ্রামের হাট-বাজারগুলোতে একই আলোচনা ধানের মূল্যই কৃষকের সর্বনাশ করছে। অনেক কৃষকের পথে বসার উপকৃম হয়েছে। অথচ ভরা মৌসুমে ভারত থেকে চাল আমদানি চলছেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধান উৎপাদন ব্যাপক হওয়ার পরও চলতি মাসেও ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করা হয়েছে। হিলিস্থল বন্দর দিয়েই ২০১৫ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ভারত থেকে ৩২ হাজার ৮৬৩ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে। অন্যান্য স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে কি পরিমাণ চাল এসেছে তা অবশ্য জানা যায়নি। চলতি মাসেও ভারত থেকে শত শত টন চাল আমদানি করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিলেও সেটা কার্যত কাগজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রতি কেজি ধানের দাম ২৩ টাকা করে প্রতি মণ ধান ৯২০ টাকায় ক্রয়ের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সরকারি দলের নেতাদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের উদ্দেশ্যে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান নিচ্ছে না। বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফরিয়া ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের হোমরা-চোমরাদের সঙ্গে সরকারি খাদ্য গুদামের কর্মকর্মা-কর্মচারীরা সিন্ডিকেট করেছেন। এখন কৃষকের কাছ থেকে যে ধান ৪শ’ টাকায় ফরিয়ারা কিনছে কয়েকদিন পর সে ধান ৯২০ টাকা মণ দরে জেলা-উপজেলা খাদ্যগুদামে তোলা হবে। অথচ সরকার প্রচার করছে ৫ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করা হবে। আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা জানান, যে দু’এক যায়গায় ধান ক্রয় করা হচ্ছে তা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকেই নেয়া হচ্ছে। কৃষকরা জানান, সার-কীটনাশক ও ডিজেলসহ অন্য সব কৃষি সামগ্রীর দাম ঊর্ধ্বমুখী। ধান রোপণ করা থেকে কাটা পর্যন্ত মজুরের মজুরিও বেড়েছে। ধান কাটতে একজন মজুর এলাকা ভেদে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা মজুরি নেয়। এ ছাড়াও দাদন ব্যবসায়ী-এনজিওসহ বিভিন্ন ব্যাক্তির কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ দিয়ে ধান চাষ করায় উৎপাদন খবর পড়েছে বেশি। অথচ সরকারি গুদাম কৃষককের কাছ থেকে ক্রয় না করায় সেই ধান বিক্রি করতে হচ্ছে অর্ধেক দামে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নেই বাজার তদারকি
মিজানুর রহমান তোতা, যশোর ব্যুরো :
নতুন বোরো ধান পুরাদমে বাজারে উঠলেও নেই বাজার তদারকি। চলছে পাইকার ও ফড়িয়াদের সীমাহীন দাপট। চাষিদের বস্তা হচ্ছে টানাটানি। উপযুক্ত দাম পাচ্ছে না কৃষক। এ ব্যাপারে নেই ন্যূনতম পদক্ষেপ। সরকারের সংগ্রহ অভিযান শুরু হলেও কৃষকের কোনো উপকারে আসছে না। হঠাৎ ধানের মূল্য এতটা কম হবে তা কেউ কল্পনাও করেনি। সেচ, সারসহ উপকরণের দাম বেশী হওয়ায় বোরো আবাদে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেশী হয় বলে মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। চাষিদের উৎপাদন খরচ উঠছে না। এই চিত্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের।
যশোরের শার্শা উপজেলার ডিহি ইউনিয়নের কৃষক মো. আলম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, কিছুদিন আগেও বাংলামতি ধান বিক্রি হয়েছে প্রতিমণ ৯৫০ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৮শ’ টাকায়। মোটা ধানের দাম আরো কম। যশোরের ডাকাতিয়া গ্রামের বোরো চাষি আব্দুল মান্নানসহ বেশ কয়েকজন চাষি জানালেন, ধান ভিজা, নরম, চিটার ভাগ বেশী এমন নানা অজুহাতে দাম কমিয়ে দিচ্ছে পাইকাররা। আড়তদার ও চাতাল মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম নির্ধারণ করছে। কৃষিজাত পণ্যের বিক্রয়মূল্য তদারকির ব্যাপারে আইনও আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই। সূত্র জানায়, আইনটি হচ্ছে, ১৯৬৪ সালের এগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেটস রেগুলেশন এ্যাক্ট ও ১৯৮৫ সালের সংশোধিত বাজার নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৬(১) ও ১৬(২) ধারামতে কৃষিজাত ও ভোগ্যপণ্যের ক্রয়মূল্য, বিক্রয়মূল্য ও মজুদ পরিস্থিতির তদারকির ক্ষমতা রয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জেলা বাজার কর্মকর্তাদের। কিন্তু বাস্তবে এ অঞ্চলের কোন জেলাতে কখনোই বাজার কর্মকর্তাদের তৎপরতা লক্ষ করা যায় না বলে ক্ষতিগ্রস্তদের বিস্তর অভিযোগ।
রাজশাহীতে মন ভালো নেই কৃষকের
রেজাউল করিম রাজু, রাজশাহী ব্যুরো
রাজশাহী অঞ্চলের মাঠে মাঠে আবাদকারীদের এখন বোরো ধান কাটা আর মাড়াইয়ের চিত্র সহজে নজরে পড়ে। আবহাওয়া মোটামুটি অনুকূল থাকায় এবার আবাদ ভাল হয়েছে। তবে শেষদিকে খরতাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে ফসল বাঁচাতে বেশী সেচ দিতে গিয়ে উৎপাদন খরচের পাল্লা আরেকটু ভারী হয়েছে। কৃষকরা জানান, বোরো রোপণের আগ দিয়ে বীজতলা প্রায় প্রতিবছর কোল্ড ইনজুরিতে পড়ে নষ্ট হয়। এবার তেমনটি হয়নি। বরং বৃষ্টি হওয়ায় জমিতে ভাল জো এসেছে। এতে করে আবাদ ভাল হয়েছে। যদিও ঘাম ঝরিয়ে টাকা খরচ করে ধান ফলানোর পর উৎপাদন মূল্য না পাবার কারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর সে কারনে কৃষক ধান আবাদ বাদ দিয়ে অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকছে, ফলে বোরো আবাদের জমি যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে উৎপাদনও। রাজশাহী কৃষি বিভাগ জানায়, এবার বোরো আবাদের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয় ৬৯ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৬৬ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার মে. টন। আবহাওয়া মোটামুটি অনুকূল থাকায় ফলন ভাল হয়েছে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।
বোরোর উৎপাদন ভাল হওয়ায় কৃষি বিভাগ তৃপ্তির ঢেকুর উঠালেও কাক্সিক্ষত দাম না পাবার কারনে কৃষকের মনে রয়েছে অতৃপ্তি। মাঠ পর্য্যায়ের কৃষকদের সাথে আলাপকালে তারা জানান গতবারের চেয়ে এবার ফলন ভাল হয়েছে। ভাগ্যগুনে বিঘা প্রতি গড়ে আঠারো থেকে কুড়ি মন ধান পাচ্ছেন। ফলন ভাল কিন্তু দাম নিয়ে হতাশ। বর্তমান এখানকার হাট বাজার গুলোয় মান ভেঙ্গে ধান বিক্রি হচ্ছে ছয়শো হতে সাতশো টাকা মনের মধ্যে। এ দামে ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ ওঠানো যাচ্ছে না। এরপর এখনো ধান মাঠে রয়েছে। ধানকাটা শ্রমিকের সংকটের কারণে দ্রুত ধান কেটে ঘরে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেড়েছে ধান টাকা শ্রমিকের মজুরী। ফলে উৎপাদকদের আরো ব্যয় বাড়ছে। বৈশাখজুড়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাবার পর এখন আবার শুরু হয়েছে ঝড়বৃষ্টি। যাদের ফসল এখন মাঠে আছে তারা বেশ দুশ্চিন্তায়। এরমধ্যে বজ্রপাতের ভয় তাড়া করে ফিরছে মাঠে ধান কাটা শ্রমিকদের।
ইতোপূর্বে এ কারণে অনেকে মারধরের শিকার হয়েছেন। এখন দায়িত্ব পালনে মানসম্মান ঠিক রাখা দায় হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রামে হতাশ কৃষক
রফিকুল ইসলাম সেলিম, চট্টগ্রাম ব্যুরো :
চট্টগ্রাম অঞ্চলে ধান বিক্রি করে লাভ নয়, লোকসানের বোঝা মাথায় উঠছে।
সেচ, সার, বীজ, কীটনাশকসহ আবাদ খরচই উঠছে না। কৃষি শ্রমিকের মজুরি গুনতে হচ্ছে নিজের পকেট থেকে। প্রতিমণ ধানে একশ থেকে দেড়শ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনছে কৃষকেরা। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা সোনালী বোরোর ধান এখন কৃষাণ-কৃষাণীর গলার ফাঁস। সরকারি উদ্যোগে কৃষক পর্যায়ে ধান সংগ্রহের ঘোষণা এলেও তা এখনও কার্যকর হয়নি। এতে করে কৃষকেরা হতাশ।
এদিকে দাম না পেয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কৃষকরা। এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। বোরোর বদলে সয়াবিন ও শাকসবজি এবং ডাল আবাদ করেছে প্রান্তিক চাষীরা। আবার অনেক এলাকায় মাইলের পর জমি পতিত পড়ে থাকছে। বার বার লোকসানের মুখে ধান আবাদে কৃষকদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলার প্রবণতাকে কৃষি খাতের বিশিষ্টজনরা অশনি সংকেত মনে করছেন। তারা বলছেন, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে প্রধান খাদ্য ভাতের এই দেশে খাদ্য নিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের তথ্যমতে এবার চট্টগ্রামসহ এই অঞ্চলের ৫ জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৩২ হাজার ৩২০ হেক্টর। আর শেষ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৯১০ হেক্টরে। গত কয়েক বছর থেকে প্রতিবছরই বোরোর আবাদ কমে আসছে।
হলেও তা এখনও কার্যকর হয়নি। ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে কিন্তু খাদ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সংগ্রহ অভিযান শুরু করা যায়নি। এতে করে বাজারে ধানের দাম দিনে দিনে নি¤œমুখী হচ্ছে। সরকার যেখানে ২৩ টাকা করে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছে সেখানে বৃহস্পতিবার বাজারে প্রতি কেজি ধানের দাম ছিল ১৭ থেকে ১৬ টাকা।
কৃষকরা বলছেন, প্রতিবছর খাদ্য বিভাগ ধান, চাল সংগ্রহ করেন। কিন্তু কৃষক পর্যায় থেকে না করে চালকল মালিকদের কাছ থেকে ধান, চাল সংগ্রহ করায় এর সুফল পুরোটাই মিল মালিকেরা পেয়ে থাকে। মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে বাজারে ধান, চালের দাম কমিয়ে দেয়। আর চাষীরা বাধ্য হয়ে তাদের কাছে কম দামে লোকসানে ধান বিক্রি করে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে চাষীরা আবাদের আগ্রহ হারাবেন বলে জানান প্রান্তিক চাষীরা।
দিনাজপুরে কৃষকের চোখে পানি
মাহমুফুল হক আনার, দিনাজপুর অফিস : ইরি-বোরো ধান নিয়ে কৃষকেরা চরম বিপাকে পড়েছে। বেশী মূল্যে বীজ-সারসহ কৃষি উপকরণ ক্রয় করে বোরো আবাদের পর শেষ মুহূর্তে বিদ্যুতের বেহাল অবস্থায় সেচের যোগান দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে কৃষকেরা। সবশেষে ধান কাটার পর বাজারে তুলে মাথায় হাত পড়েছে। এক বস্তা ধান ৯০০ টাকায় বিক্রি করে চোখের পানি ফেলা ছাড়া কোন উপায় থাকছে না কৃষকদের। এর উপর শুরু হয়েছে শিলা বৃষ্টি। গত কয়েকদিনের শিলা বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ায় একরের পর একর জমির ধান ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে গেছে।
বাজারে ইরি-বোরো ধান উঠছে শুরু করেছে। পারিজাতের ধান ৯০০ টাকা, ২৮ জাতের ধান এক হাজার থেকে ১১০০ টাকা বস্তা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বস্তায় ধান থাকে ৮০ কেজি। ৯০০ টাকা বস্তা হিসাবে বিক্রি করলে এক কেজি ধানের দাম পড়ে ১১ টাকা ২৫ পয়সা। কৃষকদের অভিযোগ এই দামে ধান বিক্রি করে তাদের উৎপাদন খরচও উঠবে না। সেচ, সার, বিষ এবং ধান কাটা ও মাড়াইয়ে যে খরচ তা যোগাতে হয়েছে কর্জ-মাহাজন করে। দাদনের টাকা ফেরত আর জোতদারের অংশ দিয়ে প্রকৃত কৃষকের ঘর শূন্য হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখনও পুরোদমে ধান কেনা-বেচা শুরু হয়নি। যারা এখন ধান বিক্রি করছে তারা মূলত প্রান্তিক চাষি। ধানে পাক ধরা মাত্রই কেটে-মেড়ে বাজারে নিয়ে আসছে বিক্রির জন্য। কারন ইরি-বোরো আবাদ শেষে এখন দেনাদারের চাপ আর সাংসারিক খরচ যোগাতে ধান বিক্রি ছাড়া কোন পথ নেই। ফলে শুকানোর পর প্রতি বস্তায় ৭ থেকে ৮ কেজি ওজন কমে যাবে। ফলে বাম্পার ফলনের দাবীদার কৃষকেরা বাম্পার লোকসানের মুখে পড়ছে এটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে।
বগুড়ায় হতাশ কৃষক
মহসিন রাজু, বগুড়া থেকে : জেলায় বোরো ধান কাটা-মাড়াই এখন শেষের পথে। চাষীদের ঘরে ঘরে এখন ধান কাটা-মাড়াই এর ব্যস্ততা। কিন্তু বাজারে ধানের মূল্য খুব কম থাকায় কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এখন পর্যন্ত বগুড়ায় সরকারিভাবে ধান-চাল ক্রয় শুরু হয়নি। ফলে ধানের বাজারে কাক্সিক্ষত দাম না থাকায় কৃষকদের মধ্যে হতাশাও বাড়ছে।
উত্তরাঞ্চলের মধ্যে বগুড়া খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত জেলা হিসাবে পরিচিত। এবার বোরো মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে আবাদ এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ লাখ ৪৩ মেট্রিক টন ধান। অনুকূল আবহাওয়া ও সার, বীজ এবং সেচ ব্যবস্থা ঠিক থাকায় আবাদ ভাল হয়েছে। তবে ফলন ভালো হলেও কৃষকের মুখে হাসি ফুটছে না। বাজারে ধানের দাম কম থাকায় উৎপাদন খরচও মিলছে না বলে কৃষকদের অভিযোগ। এছাড়া ধান কাটা-মাড়াইয়ে শ্রমিক স্বল্পতা নিয়েও বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ফলে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে। প্রতিবিঘা ধান কাটতে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা লাগছে, গত বছরে এর অর্ধেক মূল্যে কাটা-মাড়াই সম্ভব হয়েছিল। বাধ্য হয়ে কৃষকরা ঋণ করে ধান কাটা-মাড়াই করছে। তবে মজুরি বেশি পাওয়ায় খুশি ধান কাটা শ্রমিকরা।
সিলেটে কৃষকের মাথায় হাত
খলিলুর রহমান, সিলেট অফিস
শীলাবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে এবার সিলেটে বোরো ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। ধানের দাম কম পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। সিলেটের একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সিলেট বিভাগে এ বছর বোরো ধান আবাদ করা হয় ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৭০৬ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সিলেট জেলায় আবাদ হয়েছে ৭৯ হাজার ৫৪৫ হেক্টরে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, তারা ধান মাড়াই ও শুকিয়ে ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এবছর ঝড় ও শিলা বৃষ্টিতে ধানের কিছু ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও বাজারে ধানের দাম নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন জেলার কৃষকেরা। বর্তমানে যে দামে ধান বিক্রি হচ্ছে, তাতে উৎপাদন খরচই উঠবে না কৃষকের। বাজারে বর্তমানে মণ প্রতি ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা থেকে সাড়ে ৫৫০ টাকা। অথচ মণ প্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হওয়ায় লোকসান দিতে হচ্ছে মণ প্রতি দেড়শ থেকে তিনশ টাকা। সেই সাথে ধানকাটা শ্রমিক না পাওয়ায় বেশি মুজুরি দেওয়ায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে কৃষকদের।
সিলেটের মুন্সিবাজার এলাকার কৃষক ফয়জুল ইসলাম বলেন, ধান চাষ করলেও এতে কোনো লাভ নেই। বাজারে ধানের যে দাম পাচ্ছি তা দিয়ে খরচও উঠবে না। এক বিঘা জমিতে চাষ করতে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা, চারা ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা, জমি লাগাতে ১ হাজার ৫০০ টাকা, সার ৩ হাজার টাকা, ডিজেল ২ হাজার, কাটতে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সব মিলেয়ে ধান বিক্রি করে লোকসান দিতে হচ্ছে। একাই এলাকার কৃষক নিজাম উদ্দিন ধান বিক্রি করতে সাহস পাচ্ছেন না জানিয়ে বলেন, বাজারে যে দামে ধান বিক্রি হচ্ছে সে দরে বিক্রি করলে লোকসান দিতে হবে।
সিরাজগঞ্জে হাসি নেই কৃষকের
সৈয়দ শামীম শিরাজী, সিরাজগঞ্জ থেকে
সিরাজগঞ্জ জেলার ৯টি উপজেলার ১১টি থানায় ইরি-বোরো মৌসুমি ধান কাটা ও মাড়াই চলছে। ঋণগ্রস্ত প্রান্তিক কৃষকদের ঘাম ঝরানো ফসল যাচ্ছে মহাজনের গোলায়। অপরদিকে নতুন ধানের দরপতন, শ্রমিকের মূল্য বেশি, শ্রমিক সংকট, ঝড়বৃষ্টির আশঙ্কায় কাঁচাপাকা ধান কাটা প্রভৃতি নানাবিধ প্রতিকূল পরিবেশের কারণে এবার কৃষকদের মুখে হাসি নেই। দুঃখের আগুনে পুড়ছেন তারা।
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জসহ চলনবিল অঞ্চলে ইরি-বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও নানাবিধ সমস্যার কারণে কৃষকদের মুখে নেই হাসির ঝিলিক। প্রান্তিক কৃষকরা ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেছিল। তাদের ঋণ পরিশোধ করতে সব ফসল চলে যাচ্ছে মহাজনদের গোলায়। ধানের দাম কমে যাওয়া, শ্রমিকের সংকট ও শ্রমের মূল্য বেশি, অভাবের কারণে আগাম কাঁচাপাকা ধান কাটা প্রভৃতি নানাবিধ কারণে কৃষকদের এবার লোকসান গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে এক মণ ধানের মূল্য ও একজন দিনমজুরের (কামলা) দিন হাজিরা সমপরিমাণ হওয়ায় কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। গত মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে জেলার সর্বত্র ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হওয়ায় কামলা সংকট ও মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়ও শ্রমিক মিলছে না। কারণ সম্পর্কে স্থানীয় কৃষকরা জানান, অসহ্য গরম, লু-হাওয়ায় মাঠে যেমন কাজ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে, তেমনি দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় যে কোনো মুহূর্তে ঝড় ও প্রচ- শীলা বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে মনে করে অনেক কৃষকই ক্ষেতের কাঁচাপাকা ধান আগাম কাটার জন্য শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে ধানের দাম কম হওয়ায় হতাশায় ভুগছে কৃষককূল। কৃষির প্রতি অনীহা বাড়ছে তাদের। চলনবিল জনপদের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষের জীবিকা কৃষিনির্ভর। তাদের একমাত্র ফসল বোরো ধান। তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে খরচ পড়েছে ২২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে জমি সেচ, বীজ বোনা, সার দেয়া ও শ্রমিকের মজুরিসহ বিভিন্ন ধরনের খরচ রয়েছে। আর ধান কাটানো থেকে গোলায় উঠানো পর্যন্ত প্রতি একরে আরও খরচ পড়েছে ১৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা অর্থাৎ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে দাম পাচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। ফলে প্রতি বিঘায় লোকসান হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কৃষকভেদে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। কোনো কোনো কৃষক এক থেকে দুই বিঘা বা তার চেয়ে কম জমিতে ধান চাষ করেছেন। এদের মধ্যে অনেকেরই একমাত্র সম্বল এই একটি ফসল। ফসল ফলিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় তারা এখন স্বাভাবিকভাবেই জীবন-জীবিকার তাগিদে ভিন্ন পথ খোঁজা শুরু করে দিচ্ছেন। এদিকে বিপাকে পড়েছেন বর্গা চাষিরা। জমির মালিককে ভাগ দেয়ার পর তাদের তেমন কিছুই থাকছে না। এদের মধ্যে যারা মহাজনের ঋণ নিয়েছেন তাদের ফসল মহাজনের গোলায় চলে যাচ্ছে। আব্দুল মালেক নামে এক বর্গা চাষী জানান, চিন্তা করছি, সামনে আর ধান ক্ষেত করব না। ক্ষেত ছেড়ে দেব। ক্ষোভের সাথে তিনি আরও জানান, এবার বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টি থেকে ইরি-বোরো ধান রক্ষা হলেও রক্ষা হচ্ছে না চাতাল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগী মহাজনদের কাছ থেকে। হাটবাজারে ধান উঠলেও ক্রেতা না থাকায় বিক্রি না হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে চাতাল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগী মহাজনরা। অপরদিকে আব্দুল লতিফ জানান, গত বছর ধান কাটতে প্রতি একরে খরচ পড়েছে দুই হাজার টাকা, চলতি বছর খরচ হচ্ছে ৪ হাজার টাকা। শ্রমিকের মজুরি ৫০০ টাকা আর ধানের মণ ৪০০ টাকা। এক মণ ধান বিক্রি করে ১ কেজি ইলিশ মাছ কেনা যায় না। এ দুঃখ রাখার জায়গা কোথায়?
সুনামগঞ্জে দুর্দশার শেষ নেই
আজিজুল ইসলাম চৌধুরী, সুনামগঞ্জ থেকে :
সুনামগঞ্জের কৃষকের মাথায় হাত। একদিকে তারা বোরো ফসল ঠিকমত ঘরে তুলতে পারেনি। অন্যদিকে ধানের উপযুক্ত মূল্য নেই। পানিতে তলিয়ে ছোট-বড় অনেক হাওরের ফসল নষ্ট হয়েছে। তাই তাদের দুর্দশার যেন শেষ নেই। পানির দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। তাও আবার ক্রেতা নেই। নিতান্ত বাধ্য হয়েইে স্থানীয় অতি মুনাফা লোভীদের নিকট বিক্রি করতে হচ্ছে। নানা কারণে সরকারী গুদামেও ধান নিয়ে যেতে পারছেন না কৃষকরা।
সুনামগঞ্জে ছোট বড় অনেক হাওর রয়েছে। বলতে গেলে এ এলাকার মানুষ এ সকল হাওরের উপর নির্ভরশীল। বোর ফসলই তাদের সম্বল। এ ফসল দিয়ে তাদের সব খরচ চলে। পরিবারের ভরণপোষণ থেকে শুরু করে স্থানীয় মহাজনদের ধার-দেনা শোধ করতে হয় ধান বিক্রি করে, কিন্তু এবার বিধিবাম। কৃষকরা ধান তাদের ঘরে তুলতে পারেনি। সর্বনাশা পানি ও শীলাবৃষ্টি তাদের সর্বনাশ করে দিয়েছে। অনেক কৃষক তাদের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। বৈশাখ মাস আসার আগেই শীলাবৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওর রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে পানিতে তলিয়ে গেছে হাওরের ফসল। অনেক হাওরের ফসল ডুবেছে। তারপরও কিছু হাওরের ধান কেটেছেন কৃষকরা। তাও আবার কাচা ও আধা পাকা। এখন প্রয়োজনের তাগিদে এ ধান পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। তাতেও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিমন ধানের দাম ৪ শত টাকা থেকে সাড়ে ৪ শত টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জেলা খাদ্য বিভাগ ধান কেনা শুরু করলেও তাদের নিয়ম কানুনের কারণে কৃষকরা তাদের ধান খাদ্য গুদামে নিয়ে বিক্রি করতে পারছেন না। নিয়ম অনুযায়ী তালিকায় কৃষকদের নাম থাকতে হবে। তাছাড়া কৃষি কাড নিয়ে যেতে হয় খাদ্য গুদামে। এ সকল বাধ্যবাধকতায় কৃষকরা পড়েছেন বিপাকে। তাছাড়া ধানের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। এ সকল কারনে তারা ধান নিয়ে যেতে পারছেন না সরকারী খাদ্য গুদামে। ধরমপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের মহেষপুর গ্রামের কৃষক দুলাল মিয়া জানান এবার তাদের এলাকার সোনামোড়ল হাওরটি কোনভাবে রক্ষা হওয়ায় প্রায় হাজার মনের অধিক ধান ঘরে তুলেছেন তিনি। কিন্তু ধানের উপযুক্ত দাম না থাকায় ধান বিক্রি করতে পারছেন না। একই কথা বললেন বাবুল মিয়া। তিনিও ২ শত মনের অধিক ধান পেয়েছেন। কিন্তু ধানের ক্রেতাও নেই, উপযুক্ত দামও নেই। সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস সুত্রে জানা গেছে এবার সুনামগঞ্জ জেলায় ৩০ হাজার ৯ শত ৭৯ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হলেও কৃষকরা এখনও গুদামে ধান নিয়ে আসছে না। প্রতি কেজি ধান ২৩ টাকা দরে কিনা হবে কৃষকদের নিকট থেকে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু নাঈম মুহাম্মদ সফিউল আলম ইনকিলাবকে বলেন, ধান সংগ্রহের অভিযান শুরু হলেও কৃষকরা ধান গুদামে নিয়ে আসছেন না। সরকারী গুদামে ধান নিয়ে আসার জন্য কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণা চলছে। মাইকিং করা হচ্ছে, লিফলেট বিতরণ হচ্ছে। এবার পানিতে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সংগ্রহের অভিযান কিছুটা দেরী হতে পারে। তবে আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা পূরণ হয়ে যাবে আশা করি। এবার ২৩ টাকা কেজি দরে ধান কেনা হবে। তাও ভাল মানের ধান হতে হবে।
স্থানীয় কৃষিবিভাগের উপ-পরিচালক জাহেদুল হক বলেন, জেলায় এবার বোরো আবাদ হয়েছিল ২ লাখ ২০ হাজার ৮০৫ হেক্টর। উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮লাখ ৩৭ হাজার ৫৮২ মেট্রিক টন। ১১টি উপজেলায় পানির নিচে তলিয়ে গেছে ৩৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল এবং শীলা বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ১৩২ হেক্টর জমির ফসল। যার ক্ষতির পরিমান দাড়ায় ৫১৩ কোটি টাকা। তিনি আরো বলেন এবার কৃষকরা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নেত্রকোনায় কৃষকের মøান
এ কে এম আব্দুল্লাহ নেত্রকোনা থেকে
নেত্রকোনায় বোরো ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেলেও ধানের দাম না থাকায় সেই হাসি মøান হয়ে গেছে।
নেত্রকোনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিলাস চন্দ্র পাল জানান, নেত্রকোনা জেলা মূলত ধান উদ্বৃত্ত জেলা। এ জেলার উৎপাদিত ধান দিয়ে ৮টি জেলার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
নেত্রকোনার কৃষকরা তাদের খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মাঠে সোনার ফসল ফলায়। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং সময় মতো সেচ, সার ও প্রয়োজনীয় কীটনাশক ব্যবহারের ফলে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। চারিদিকে বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠ জুড়ে সোনালি ধানের মৌ মৌ গন্ধ কৃষকের মনে স্বপ্নের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। ধানের বাম্পার ফলনে এ অঞ্চলের কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেলেও ধানের দাম না থাকায় সেই হাসি মূহুর্তে মøান হয়ে যায়।
নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা সংসারের খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবার পরিজন নিয়ে একটু ভালমতো জীবন যাবনের জন্য অনেকে ধার দেনা করে বোরো ধান আবাদ করেছে। কিন্তু ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষকের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়েছে। কিভাবে তারা মহাজনের কাছ থেকে নেয়া চড়া সুদ পরিশোধ করবে, তা ভেবে কৃষকরা দিশেহারা। কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের ঘোষখিলা গ্রামের প্রান্তিক চাষী শফিকুল ইসলাম জানান, অনেক আশা নিয়ে আমি এ বছর ৪০ কাঠা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছিলাম। ধানের ফলনও ভাল হয়েছে। কিন্তু ধানের ন্যায্য মূল্য না থাকায় আগামী বছর ধানের আবাদ কমিয়ে ফেলব। মোহনগঞ্জ উপজেলার মাঘান ইউনিয়নের শেওড়াতলী গ্রামের কৃষক রতন মিয়া বলেন, হাওড় এলাকায় ধান কাটা শ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দৈনিক ৫শ’ টাকা দিয়েও ধান কাটা শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই প্রতি শ্রমিককে ৬শ’ টাকা করে মজুরি দিয়ে ধান কাটাতে হচ্ছে। তারপর হাওড় থেকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে হ্যান্ড ট্রলি বা ট্রলি খরচ রয়েছে। কৃষক খোকন মিয়া বলেন, ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় মাঠের ফসল মাঠেই বিক্রি করছি। খরচ করে বাড়ি পর্যন্ত ধান নিয়ে লোকসানের মুখ আর বাড়াতে চাই না। সরকারের কাছে কৃষকদের দাবি, ধান কাটার সাথে সাথে সরকারের উদ্যোগে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে ধান ক্রয় শুরু করে। তারা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কিছুদিন পরপরই মন্ত্রী এমপি ও সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাড়ে কিন্তু কৃষকের সুযোগ সুবিধা বাড়াতে কিংবা ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে কোন সরকারই কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তারপরও কৃষকদের কোন অভিমান নেই। তারা প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, কাক ডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়-ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করে দেশের প্রতিটি মানুষের মুখে অন্ন জোগান দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাদের একটাই দাবি, সরকার যেন ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে কৃষকদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন।
নীলফামারীতে দুঃশ্চিন্তায় কৃষক
নীলফামারী থেকে মোশাররফ হোসেন জানান, নীলফামারীতে এবছর বোরো ধানের ভালো ফলন হলেও ধানের দাম না থাকায় দুঃচিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। বর্তমানে বাজারে ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ না উঠায় তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
নীলফামারীতে এবছর ৮০ হাজার ৬শ’ ৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলনও হয়েছে ভালো। এছাড়া চারা রোপনের পর থেকে ধান পাকা পর্যন্ত তেমন কোন রোগ-বালাই ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না। মে মাসের শুরু থেকে এ জেলায় পুরো দমে শুরু হয়েছে ধান কাটা। ধান কাটা-মাড়াই নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন এ জেলার কৃষান-কৃষানিরা। কিন্তু বাজারে ধানের দাম না থাকায় হতাশ হয়ে পড়েছে তারা। বর্তমান বাজারে ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ না আসায় দুঃচিন্তায় পড়েছেন বোরো চাষিরা।
কৃষকরা জানান বর্তমানে নীলফামারীর বিভিন্ন হাট-বাজারে প্রতিমন ধান ৪শ’৫০ টাকা থেকে ৫শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিজেল, সার, বিদ্যুৎসহ কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। আর ধান বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। তারা জানান এক মন ধান বিক্রি করে এক কেজি মাংস কেনা যাচ্ছে না। এছাড়া সরকারি ভাবে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হওয়ার এখনও বেশ কিছু সময় বাকী থাকায় বাজারে পর্যাপ্ত পাইকার ও ক্রেতাও পাওয়া যাচ্ছে না।
সদর উপজেলার টুপামারী ইউনিয়নের বাজার মৌজা গ্রামের কৃষক সিদ্দিক আলী, আশরাফ হোসেন, বনবিভাগ গ্রামের মজিবর রহমান, পৌর এলাকার মুরাদ আলীসহ অনেক কৃষক জানান বর্তমানে ধানের যে দাম তাতে করে লাভ তো দুরে থাক উৎপাদন খরচ উঠছে না। ডোমার উপজেলার ভোগডাবুড়ি ইউনিয়নের মাস্টার পাড়া গ্রামের হবিবর রহমান চানু ও আমিনুর রহমান জানান লাভের আশায় ধার-দেনা করে বোরো আবাদ করে এখন লোকসান গুণতে হচ্ছে। তারা জানায় গত তিন বছর ধরে বোরো ধানের ন্যায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে কৃষকরা বোরো আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।
নওগাঁয় কামলা সঙ্কট
এমদাদুল হক সুমন, নওগাঁ থেকে জানান, নওগাঁর ধামইরহাট ও নওগাঁ জেলার অন্যান্য উপজেলায় এবার ইরি বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও কামলা (শ্রমিক) সঙ্কটের কারণে কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এ সুযোগে কামলারা কৃষকদেরকে বেকায়দায় ফেলে বেশি মজুরি আদায় করছে। অনেক কৃষক ঘরে ধান তুলতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। জানা গেছে, এবার ধামইরহাট উপজেলা প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে কৃষকগণ ইরি বোরো ধান চাষ করেছে। অন্যান্য বারের তুুলনায় এবার ধানের রোগ বালাই কম, সঠিক সময়ে সার, কীটনাশক প্রয়োগ, সময়মত পানি সেচ প্রদান এবং উপজেলা কৃষি বিভাগের কর্র্মকর্তা-কর্মচারীদের সঠিক দিক নির্দেশনায় ইরি বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। বর্তমানে পুরো উপজেলায় ধান কাটা মাড়াইয়ের কাজ চলছে। অধিকাংশ জমিতে কৃষকগণ জিরাশাইল ধান চাষ করেছে। ধানের ফলনও ভালো। প্রতি একরে প্রায় ৭৫-৮০ মণ ধানের ফলন হয়েছে। বাজারে বর্তমানে প্রতি মণ ধান ৬৪০ থেকে ৬৫০ টাকা দরে কেনাবেচা চলছে। সরকারিভাবে এখনও ধান ক্রয় শুরু হয়নি। সব কিছুই কৃষকের অনুকূলে থাকলেও কামলার সঙ্কট ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ ধান এক সাথে পাকতে থাকায় এ সঙ্কট আরও ঘনিভূত হয়েছে। উপজেলার জয়জয়পুর গ্রামের কৃষক মো. নবিবুল ইসলাম বলেন, গত বছর যে ধান প্রতিমণ ৫-৬ কেজি দরে কাটা হতো এবার তা বেড়ে ৮-৯ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। এতে কৃষকদের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। বড় চকগোপাল (আবিলাম) গ্রামের কৃষক মো. রবিউল ইসলাম লিটন বলেন, কামলা সঙ্কটের কারণে তার ধান এখনও কাটা শুরু হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় কামলার জন্য হণ্যে হয়ে খোঁজ করেও কামলা মিলছে না। এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি অফিসার ড. মো. জামাল উদ্দিন বলেন, কৃষকরা বৈজ্ঞানিক যন্ত্র রিপার দিয়ে ধান কাটলে এ সংকট হতো না। তিনি আরও বলেন, কৃষক ধান কাটার মেশিন রিপার ক্রয় করতে চাইলে সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ ভাগ ভর্তুকি দিয়ে ৭দিনের মধ্যে সরবরাহ করা হবে।
বানারীপাড়ায় মিলিয়ে গেছে আনন্দ
বানারীপাড়া (বরিশাল) থেকে এস মিজানুল ইসলাম জানান, এ বছর বানারীপাড়ায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকদের মুখে হাসি থাকলেও বাজারে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় অবয়বে হতাশার চিত্র ফুটে উঠে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। বানারীপাড়া উপজেলার উর্বর ফসলী জমিতে ধানের সোনালী ঢেউ বয়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে পথচারীদের উক্তি সাড়া বছর যদি দেশে এমন ফসল হতো তা হলে অর্থনৈতিক ভাবে আমাদের দেশ আরো স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো। পরোক্ষণেই সে আনন্দ মনের গভীরে মিলিয়ে যায় যখন কৃষক তার উৎপাদিত খরচের মূল্য নিয়ে চিন্তিত থাকেন। ফসলের ক্ষেতে ধান চাষের জন্য ফসল উৎপাদন করতে যে উপকরন ব্যবহার করতে হয় তার মূল্য উৎপাদন খরচের দেড়গুণ। ধান ক্ষেতে সোনালী ঝিলিক থাকলেও কৃষকের ঘরে তখন অমানিষার অন্ধকার বয়ে যায়। তার পরেও ফসল ক্ষেত থেকে কাটতে হয়।
বাগমারায় বিপাকে কৃষক
বাগমারা (রাজশাহী) থেকে আলতাফ হোসেন জানান, রাজশাহীর বাগমারায় মওসুমের বোরো ধান কাটা-মাড়ায় নিয়ে কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। মাঠের পর মাঠ জুড়ে এখন বোর ধানের হিল্লোল। এবারে অনুকূল আবহওয়ায় বোরো ধানের চাষ ও ফলন ভালো হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন মাঠে ধান পেকে গেছে। তবে ধান চাষে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে ধানের মূল্য কমে তা উৎপাদন খরচ জুটছে না। সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধিতে ধানচাষে এলাকার কৃষকরা চরম হতাশায় ভোগছেন। অনেকেই মহাজন ও ব্যাংক ঋণের টাকায় ফসল করে ন্যায্য মূল্য না পেয়ে ভিটে মাটি বিক্রি করে নিঃস্ব হতে বসেছেন। কৃষকদের অভিযোগ কৃষি উৎপাদনের প্রধান উপকরণ সার, ডিজেল ও কীটনাশকের দাম বাড়ছে প্রতি নিয়তই। কিন্তু কৃষকদের কৃষি পণ্যের দাম বাড়ছে না। এতে করে কেউ বুঝতে পারে না কৃষকের দুরবস্থা।
দুপচাচিয়ায় দুঃশ্চিন্তায় কৃষক
দুপচাঁচিয়া (বগুড়া) থেকে মোঃ গোলাম ফারুক জানান, দুপচাঁচিয়া উপজেলায় চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা কে ছাড়িয়ে কৃষকরা রেকর্ড পরিমাণ জমিতে বোরো ধান চাষ করেছে। অনুকূল আবহাওয়া এবং জমিতে সেচ দিতে বিদ্যুৎ এর লোডশেডিং এর কোন প্রভাব না পড়ায় এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে ধান কাটা মাড়াই নিয়ে কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। মাঠের পর মাঠ জুড়ে এখন বোরো ধানের হিল্লোল। ক্ষেতের ধান পেকে গেছে। তবে কামলার (শ্রমিক) সংকট দেখা দেওয়ায় কৃষকরা শংকিত হয়ে পড়েছে।
চাটমোহরে ডুবছে ফসল
চাটমোহর (পাবনা) থেকে আফতাব হোসেন জনান, চাটমোহরসহ চলনবিলাঞ্চলে ধানের বাম্পার ফলন হলেও নায্য দাম না



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত থেকে চাল আমদানি চলছেই - ধানে কৃষকের সর্বনাশ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ