পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বাঙালি হুজুগের জাতি। সবাই আমরা যেন হুজুগে মাতি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফেসবুক, টুইটার, ব্লগের মধ্যে সক্রিয় রয়েছি। বর্তমানে চলছে এন্ড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে ‘সেলফি যুগ’। সেলফি তুলতে গিয়ে লঞ্চডুবি, রাস্তা পারাপার, ট্রেন ও বাসের নিচে পিষ্ট হয়ে কতজনের প্রাণ গেছে, সে খবর কে রাখে! অনেক অনেক দিন আগে ইতালির রোমে ভ্যালেন্টাইন্স ডে আবিষ্কার হয়েছে। পশ্চিমারাও এখন আর এই দিবস পালন করে না। আমরা হুজুগপ্রিয়। তথাকথিত প্রগতিশীলতার নামে কলকাতার বাবুদের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’সহ অনেক দিবস পালন করছি। দিবসটি পালন করতে গিয়ে অপসংস্কৃতির চর্চার প্রতিযোগিতায় বেলেল্লাপনা করছি, সে খেয়াল নেই। বিদেশীদের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ‘ভালোবাসা’ পবিত্র শব্দটি নিয়ে যে নোংরামি এবং বাণিজ্য করছি তা কি আমাদের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে যায়?
বছরজুড়ে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালন করতে হয়। তবে কিছু কিছু ‘আজগুবি’ দিবসও পালিত হয়। সে দিবস পালনে আমরা নামি প্রতিযোগিতার দৌড়ে। জজ ডে, সেন্টমার্টিন ডে, সেন্ট বার্থোলোমিজম ডে, আল সেইন্টম ডে, সেন্ট এন্ড্রু ডে, সেন্ট প্যাট্রিক ডে, র্যাগ ডে, রোজ ডে, প্রপোজ ডে, হাগ ডে, ভ্যালেন্টাইন ডে- কত বিচিত্র নামের উৎসব করি! আহা কত্ত প্রেম!! সত্যিই কি এগুলো মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা? আজকাল বিয়ে, ভালোবাসা সব কিছুই হয় কমার্শিয়াল চিন্তায়। জাপানি প্রেম-চাইনিজ প্রেম শব্দ দু’টি সমাজে বহুল প্রচারিত। জাপানি প্রেমকে বলা হয় দীর্ঘস্থায়ী। আর ‘চাইনিজ প্রেম’ চাইনিজ ইলেকট্রনিক্স পণ্যের মতো ক্ষণস্থায়ী। যেকোনো সময় ভেঙে যেতে বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে নামে চকচকে লোক দেখানো ভালোবাসার নামে যে বেলেল্লাপনা দেখা গেল, তাতে কি ভালোবাসা আছে? ভালোবাসা ছাড়া সমাজ অচল। বাবা-মা, ভাইবোন, প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা আদিযুগ থেকেই। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে মিডিয়ায় ও পথে প্রান্তরে উচ্ছ্বাসকারীদের ভালোবাসা কি একে অন্যকে আপন করে নেয়! এই প্রেমিক-প্রেমিকাদের বিয়ে যেন স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন নয়, শর্তের লিস্ট। শুধুই শো অব টাইম পাস!
২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন পাদ্রি চিকিৎসক খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের অভিযোগে গ্রেফতার হন। বন্দী থেকেই তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। তাদের দু’জনের মধ্যে এক সময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চিকিৎসক ভ্যালেইটাইন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। রাজা ঈর্ষান্বিত হয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুদন্ড দেন। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স স্মরণে ‘১৪ ফেব্রুয়ারি’ ভ্যালেন্টাইন দিবস ঘোষণা করেন। পশ্চিমাদের এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। অথচ বাংলাদেশে চলছে মাতামাতি। ভ্যালেন্টাইন ডে যেন হয়ে গেছে আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি। বাংলাদেশে এই ভ্যালেইটাইন ডে আমদানি করেন সাংবাদিক শফিক রেহমান। তিনি ‘লাল গোলাপ’ নামে টিভিতে অনুষ্ঠান করেন এবং তার প্রতিষ্ঠিত একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ১৯৯৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে দেশে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ পালনের জন্য তরুণ-তরুণীদের উষ্কে দেন। কয়েক বছর ধরে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এই অপপসংস্কৃতির প্রচারে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পশ্চিমা অপসংস্কৃতির ধারক-বাহক সেই শফিক রেহমান অবশ্য পরবর্তীকালে নানান বিপর্যয়ের মুখে পড়েন।
শুক্রবার জুমার নামাজে যখন মুসল্লিদের জায়গা হয় না। মসজিদে মসজিদে মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড়। শিক্ষিত তরুণরা ইসলামী শিক্ষা এবং ইসলামী জীবনব্যবস্থায় নিজেকে পরিচালিত করার পথে ধাবিত হচ্ছে। তখন প্রগতিশীলতা-আধুনিকতার নামে পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতিকে অনুকরণে বর্তমানে দেশে বেহায়াপনা বেলেল্লাপনা চর্চার প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে কিছু মিডিয়া ও কিছু মুখচেনা ব্যক্তি। তাদের এই অপকর্মে উচ্ছন্নে যাচ্ছে কিছু তরুণ-তরুণী; ঘৃণা, হিংসা, প্রতিহিংসা-বিদ্বেষ ও অপসংস্কৃতি চর্চা গোটা সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাস এবং বিরোধ-বিসম্বাদ চলছে তাকে বিবাহ বিচ্ছেন বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। ফ্রি স্টাইলে জীবন যাপন মূলত এর জন্য দায়ী। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকা শহরে প্রতি ঘণ্টায় একটি করে দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটছে। হাজার হাজার বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন সিটি কর্পোরেশনে জমা রয়েছে। এত বিচ্ছেদ- এত তালাক! ভবিষ্যতে বর্তমানের ভ্যালেন্টাইন দিবসের বাণিজ্যিক ভালোবাসার মতোই বিয়ে বিচ্ছেদও বাণিজ্যিক উপাদান হয়ে যাবে। তখন ভ্যালেন্টাইন ডে’র মতো ‘ডিভোর্স ডে’ পালিত হবে হয়তো।
আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষের ধর্ম মানুষকে ভালোবাসা। মা-বাবা-ভাই-বোন-ছেলে মেয়ে-স্ত্রী-স্বামী-ছাত্র-শিক্ষক-প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন একে অপরকে ভালোবাসবেন- সেটাই স্বাভাবিক। কবিরা নানানভাবে তাদের কবিতায় এই সত্য তুলে ধরেছেন। স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ক কী, সেটাও সবার জানা। কিন্তু পশ্চিমাদের অপসংস্কৃতি চর্চার নামে তথাকথিত ভালোবাসা দিবস! অদ্ভুত আমাদের ভাবনার জগৎ। উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি চর্চার নামে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে; নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে প্রতারণা করছে। কলকাতার বাবুদের সঙ্গে শ্রোতে গা ভাসাতে দেশের তরুণ-তরুণীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে। তরুণ-তরুণীদের ভালোবাসার নামে বেলেল্লাপনা, নারী-পুরুষের প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে পথে প্রান্তরের কোনাকাঞ্ছিতে অবাধ মেলামেশায় উদ্বুদ্ধ করতে নাটক, বিশেষ অনুষ্ঠান, গান ইত্যাদি প্রচার করেছে। বেহায়াপনা-বেলেল্লাপনার প্রতিযোগিতার বাণিজ্য করেছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কোটি কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। জাতীয় দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুনের মতো ১৪ ফেব্রুয়ারি ইস্যুতে প্রচুর ফুল বিক্রি হতে দেখা যায়। মহল্লায় মহল্লায় ফুলের দোকান। একটি গোলাপ ১৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা এবং মাথায় দেয়া একটি টায়রা দেড় শ’ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ীরা বাড়তি লাভের মুখ দেখেছেন। কিন্তু জাতীয় দিবসগুলোর সঙ্গে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ মেলানো যায় কি? দিবসটি না উদযাপিত হলেও ফুল বিক্রি ঠিকই হতো। আলু-বেগুন-পটোল-মুলা উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে মধ্যে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার যন্ত্রণায় পড়তে হয়; কিন্তু ফুল চাষ করে কৃষক লোকসান দিয়েছেন- এমন খবর মিডিয়ায় কখনোই দেখা যায়নি।
পশ্চিমা সংস্কৃতি নিয়ে নাচানাচি করছি; অথচ আমাদের রয়েছে হাজার বছরের নিজস্ব সংস্কৃতি। ৯২ ভাগ মুসলমানের এই দেশের সমাজব্যবস্থা পৃথিবীতে বিরল। ধর্মীয় মূল্যবোধ, বাবা-মা-ভাই-বোন নিয়ে পারিবারিক বন্ধন, ছোট-বড় এর মধ্যে ভালোবাসা, সহানুভূতি সহমর্মিতা শত শত বছর ধরে বিদ্যমান। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা দেশের সংস্কৃতি। প্রতিটি জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমে বেড়ে ওঠে। বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, কোনো জাতিকে ধ্বংস করা সম্ভব না হলে তার সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে হয়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় শিল্প সংস্কৃতি ধ্বংস করতে হয়। সংস্কৃতি ধ্বংস করা গেলে সে জাতিকে অতি সহজেই ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা যায়। আমরা কেন বিদেশি অপসংস্কৃতি নিয়ে মাতামাতি করছি? কেন অপসংস্কৃতি চর্চার নামে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করছি? আমাদের ধ্বংস করতে কি বিদেশিরা এই অপসংস্কৃতি চর্চায় অতি উৎসাহী হয়ে পড়েছে। আমরা কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে সে ফাঁদে পা দিচ্ছি?
বিজ্ঞানের বদৌলতে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঢাকায় বসে বিশ্বের তাবৎ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবর পড়া-শোনা যায়। ব্রিটেন, আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মিডিয়াগুলোর খবর পড়ে বোঝা যায় ভ্যালেনটাইন ডে নিয়ে ওদের মিডিয়াগুলোর তেমন মাথাব্যথা নেই। এমনকি সারা বিশ্বে ‘সিনেমা’ বিক্রি করে কোটি কোটি ডলার আয় করা ভারতের মুম্বাইয়েরও এই দিবস নিয়ে আগ্রহ নেই। অথচ বাংলাদেশের স্যাটেলাইট টিভিগুলোতে কয়েক দিন ধরে চলছে তথাকাথিত ‘ভালোবাসা দিবস’ নিয়ে প্রচারণা। ‘ভালোবাসা দিবস’ পালনে অনুষ্ঠান, নাটক, গান, আলোচনা অনুষ্ঠানের চলছে প্রতিযোগিতা। ঢাকঢোল পিটিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে। কেন এই অপকান্ড? তাহলে আমরা কি নিজস্ব শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং স্বকীয়তা ভুলে নতুন প্রজন্মকে ভালোবাসা বাণিজ্যের নামে সমাজের শৃঙ্খলা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক অনুশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছি?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।