Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাছ সঙ্কটে বাড়ছে দাম

প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম : তাপমাত্রার পারদ স্মরণকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি লাগাতার বৃষ্টির অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীগুলো অনেকটাই ইলিশশূন্য হয়ে পড়েছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে এবার চাঁদপুরের উজান-ভাটিতে মেঘনা এবং উপকূলীয় ভাটি মেঘনা মুখ ছাড়াও বুড়িশ্বর, বলেশ্বর, তেঁতুলিয়াসহ সবগুলো শাখা নদ-নদীর পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি। উপরন্তু বৃষ্টির আকালে স্বাদু ও স্বচ্ছ পানির অভাবেও দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ইলিশের বিচরণ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে।
ফলে চাঁদপুরের ভাটি থেকে সাগর মোহনার বিভিন্ন অভয়াশ্রমগুলোর নদ-নদীতে ইলিশের বিচরণ নেই বললেই চলে। এসব অভয়াশ্রমগুলোতে গত কয়েক মাসের নিষেধাজ্ঞার পরে জেলেরা নদীতে নাও ভাসালেও জালে মাছের দেখা নেই। বেশিরভাগ জেলেই সকাল থেকে জাল ফেলেও সন্ধ্যায় ফিরছে শূন্য নাও নিয়ে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের জেলে পল্লীগুলোতে এখন চরম হাহাকার। দেশের ৬টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগেরই প্রায় দেড় লাখ জেলে এ পেশার সাথে জড়িত বলে মৎস অধিদফতর জানিয়েছে। যার ৬৫% সার্বক্ষণিকভাবে ইলিশ আহরণে জড়িত বলে এক জরিপে বলা হয়েছে। বর্তমানে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান ১%-এরও বেশি। দেশের মোট মৎস্য সম্পদে একক প্রজাতি হিসেবে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১২-১৩%।
এবার অভ্যন্তরীণ নদী-নদীর পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩-৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বেশি থাকায় এখনো ইলিশ সাগর উপকূল থেকে গভীর সমুদ্রে বিচরণ করছে। চলতি বছর বরিশাল অঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ সম্প্রতিককালের সর্বোচ্চ ৩৭.৫ডিগ্রী সেলসিয়াসে উঠে যায় গত ২৪ এপ্রিল। গত গত ১১ এপ্রিল তাপমাত্রা পুনরায় ৩৭.১ ডিগ্রিতে উন্নীত হয়। অথচ এপ্রিলে বরিশাল অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩.২ ডিগ্রি এবং চলতি মাসে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকার কথা।
অথচ অনেকটা অসময়েই গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারী পর্যন্ত শীতকালীন সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীন বিভিন্ন নদ-নদীতে ইলিশের প্রাচুর্য ছিল লক্ষণীয় মাত্রায় বেশি। মার্চ মাস পর্যন্ত বরিশাল সহ দক্ষিনাঞ্চলে প্রায় সব নদ-নদীতেই ভাল সাইজের ইলিশের বিচরন ছিল লক্ষনীয়। মৎস অধিদফতরের মতে গত অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ও সহনীয় আহরণ ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার টনের কিছু বেশি। অথচ সরবারহ ঘাটতির কারণেই এখন বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের পাইকারি বাজারে এক কেজির ওপরের সাইজের ইলিশ বিক্রী হচ্ছে ৮০-৮৫ হাজার টাকা মন দরে। ৫শ গ্রাম থেকে সাড়ে ৭শ গ্রাম সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৬০হাজার টাকা মণ দরে। ৫শ গ্রামের নিচের সাইজের ইলিশ ২৮-৩৫ হাজার টাকা মণ।
এদিকে গত ১ নভেম্বর থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশেই ইলিশ পোনা-জাটকার আহরন পরিবহন ও বিপণন নিষিদ্ধ রয়েছে। ইতোপূর্বে এ নিষেধাজ্ঞা ৩০ মে পর্যন্ত বলবত থাকলেও এবার তা আরো এক মাস সম্প্রসারণ করে ৩০ জুন করা হয়েছে। পাশাপাশি জাটকার সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন আনা হয়েছ। ইতিপূর্বে ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত ইলিশ পোনাকে জাটকা হিসেবে চিঞ্হিত করা হলেও মৎস বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকে এখন তা ১০ ইঞ্চিতে উন্নীত করা হয়েছে।
মৎস বিজ্ঞানীদের সুপারিশ অনুযায়ী এখন থেকে প্রতি বছরই ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ১০ ইঞ্চির নিচে ইলিশ পোনা-জাটকা আহরন, পরিবহন ও বিপণন নিষিদ্ধ থাকবে। পাশাপাশি এসময়কালের মধ্যে পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে নভেম্বর থেকে জানুয়ারী এবং মার্চ থেকে এপ্রিল মাস সময়কালে নিম্ন মেঘনা, শাহবাজপুর চ্যানেল ও তেতুলিয়া নদীতে ‘অভয়াশ্রম’ হিসেবে ঘোষণা করে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণ ও পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সুপারিশের আলোকে মার্চÑএপ্রিল মাসে শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিনে চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার মধ্যবর্তী পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকাকেও ‘অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করে সব ধরনের মৎস আহরণ ও পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এছাড়াও বরিশালের হিজলা উপজেলার নাছকাটি পয়েন্ট, হরিনাথপুর পয়েন্ট, ধুল খোলা পয়েন্ট এবং মেহেদিগঞ্জ উপজেলার ভাষানচর পয়েন্ট এলাকার মেঘনার শাখা নদী, হিজলা উপজেলার ধর্মগঞ্জ সহ নয়া ভাঙনী নদী ও মেহেদিগঞ্জের লতা নদীর ৬০ কিলোমিটার এলকায় ‘ইলিশ ও জাটকার সষ্ঠ অভয়াশ্রম’ ঘোষণার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এসব এলাকায়ও জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময়ের নির্দিষ্ট কিছু দিনে সব ধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য দেশের ৪০টি জেলার ১৪৫টি উপজেলার দেড় হাজার ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৪লাখ জেলে ইলিশ আহরণের সাথে জড়িত। যার ৩২% সার্বক্ষণিক ও ৬৮% খ-কালীন এ পেশায় সম্পৃক্ত বলে মৎস্য অধিদফতর জানিয়েছে। এছাড়াও ইলিশ বিপণন, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাত করন, জাল ও নৌকা তৈরীসহ মেরামত কাজেও আরো প্রায় ২০-২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
তবে জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে বর্তমানে কোন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন নেই। এ লক্ষ্যে উচ্চভিলাষী একটি ‘প্রকল্প প্রস্তাব’ তৈরীর কাজ চলছে বলে মৎস অধিদফতরের দায়িত্বশীল মহল জানিয়েছেন। দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে ২০০৪ সাল থেকে সর্বপ্রথম ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে “জাটকা আহরণকারী মৎস্যজীবীদের পুনর্বাসন/বিকল্প কর্মসংস্থান বিষয়ক উন্নয়ন কর্মসূচি” বাস্তবায়ন শুরু হয়। ২০০৭-২০১০ সাল পর্যন্ত এ কর্মসূচীর দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো কিছু জেলেকে পুনর্বাসনের লক্ষে ৬ কোটি টাকা ব্যায়ে আরেকটি কর্মসূচী বাস্তবায়িত হয়। একই সাথে ২০০৮-০৯ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে “জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও গবেষণা প্রকল্প” নামে অপর একটি কর্মসূচী বাস্তবায়নকাল ধরা হলেও প্রকল্প মেয়াদ দু দফায় বাড়িয়ে ২০১৪-এর ৩০ জুন তা সমাপ্ত হয়।
এর পর থেকে নতুন কোন প্রকল্প প্রনয়ন বা অনুমোদন লাভ করেনি। তবে জাটকা সংরক্ষণ ও জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে একটি ‘কর্মসূচি’ চলছে বলে মৎস্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল মহল জানালেও এলক্ষে নতুন প্রকল্প প্রস্তাবনা-ডিপিপি প্রণয়ন ও তার চূড়ান্ত অনুমোদন কবে হবে তা বলতে পারছেন না কেউ। অপরদিকে জাতীয় মাছ ইলিশ নিয়ে অনেক বড় বড় কথা দায়িত্বশীল মহলসহ সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হলেও আজ পর্যন্ত এ মাছের উন্নয়নে কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি দেশে। নতুন প্রকল্পের আওতায় এ ধরনের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পরিকল্পনা থাকলেও সে প্রকল্প আর কতদূর তা জানে না কেউ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাছ সঙ্কটে বাড়ছে দাম
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ