ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
ফাহিম ফিরোজ
না, দেশে কোনো কিছুই যেন ঠিকঠাক মতো চলছে না। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই যেন একটা অলিখিত অনিয়ম-অনাচার চলছে। এর বিরুদ্ধে কোনো কিছু লিখেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের কথাই বলি। ছোটবেলা থেকেই এর প্রতি আমার একটা অনুরাগ ছিল এবং অন্ধ আবেগ ছিল। ভাবতাম এর কাজকর্ম সততায় উজ্জ্বল। ইতিহাস-ঐতিহ্যকে যারা ভালোবাসে অন্তত তাদের মধ্যে কোনো কুটিলতা এবং জটিলতা থাকতে পারে না, থাকার কথা নয়। তাদের কাজই হচ্ছে সত্যকে উদ্ধার করা। বিভিন্ন সময় এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে অনেকের ভেতরের অন্ধকার দৃশ্যটা কিছুটা হলেও চোখে পড়েছে, যা সুখকর নয়। এ দফতরের কিছু সৎ লোকের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ আছে। তবে বিভিন্ন কারণে তারা কোণঠাসা। গত কয়েক মাস ধরেই চলছে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়াতে জরিপ ও খনন কাজ। বর্তমানে একটি দল ওই এলাকায় জরিপ কাজে ব্যস্ত রয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ গোলাম ফেরদৌস তিনি বাগেরহাট মিউজিয়ামের কাস্টোডিয়ান। এ বছর ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে তিনি আমাকে মোবাইলে জানান, চুয়াডাঙ্গা জেলাধীন জীবননগর থানায় প্রতœস্থলগুলো কোথায়? বুঝতে পারলাম এ ভদ্রলোক নাছোড়বান্ধা। শেষে একটি প্রতœস্থলের অবস্থান জানালাম। ভদ্রলোক স্পটে গিয়ে কিছুক্ষণ জানালেন, এটি সেন আমলের। এর কিছুদিন পর চুয়াডাঙ্গা এবং মেহেরপুরের বিভিন্ন প্রতœস্থাপনার সংখ্যা, কিছু প্রতœসামগ্রীর আলোকচিত্রসহ প্রেসরিলিজ সংবাদকর্মীদের কাছে পাঠান তিনি এবং এর এক কপি আমার হাতেও এসে পড়ে। এর মধ্যে দিল্লীর স¤্রাট মোহাম্মদ শাহের একটি রৌপ্য মুদ্রার ছবিও ছিল। কিন্তু এর আদিঅন্ত সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না। শেষে অভিজ্ঞ ফারসী প-িতদের মাধ্যমে এর ভাষা উদ্ধার করে দৈনিক ইনকিলাবে একটি রিপোর্ট করি। এতে ঐ এলাকায় প্রতœতত্ত্ব বিষয়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। এর পরই হঠাৎ এ দলের উদ্যোগে মেহেরপুর আমঝুপিতে খনন শুরু হয়। নানা কারণে ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য জনপদ।
বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলার দূরদর্শী নবাব আলীবর্দী খান এ অঞ্চলে শিকার করতে আসতেন। আমিনুল ইসলামের লেখা মেহেরপুর ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে লর্ড ক্লাইভ পলাশী যুদ্ধের আগে অন্যদের সঙ্গে বসে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেন মেহেরপুরে। নদীয়ার ধূর্ত রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায় ছিলেন নবাব সিরাজের ঘোরতর বিরোধী, এটি ছিল তখন তার রাজ্যভুক্ত। অন্যদিকে নবাব আলী বরর্দীর প্রিয় ভাজন ছিলেন স্থানীয় জমিদার গোয়ালা চৌধুরী। মেহেরপুর থেকে মুর্শিদাবাদ আনুমানিক ৩৫ মাইল দূরে। এক সময় বহু বিত্তশালী লোকের বাস ছিল এখানে। জায়গাটা কিছুটা দুর্গম। যে কোনো ষড়যন্ত্রের জন্য উত্তম স্থান। স্বাভাবিকভাবেই এর মাটির নিচে মূল্যবান পুরাকীর্তি থাকার একটা ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আলোচ্য খননদল সেখানে কি পেলো? একটি বাটি এবং নীলকুঠির কাছ থেকে একটি হ্যান্ডকাপ। এটা খনন দলের জন্য ভালো কোনো সাফল্য নয়। খনন যে সব সময় সফল হবে এমন কথা আমরা বলছি না। ব্যর্থও হতে পারে কিন্তু এ বিষয়ে লুকোচুরি কাম্য নয়?
সম্প্রতি জীবননগর উপজেলায় দৌলতগঞ্জে প্রতœঢিবির জীর্ণ ভবন ভাঙ্গার কথা মিডিয়াতে এসেছে। ওখান থেকে আতিকুজ্জামান চঞ্চল প্রেরিত ছবিতে সদ্য ধ্বংসপ্রায় একটি ভবনের ছবিও রয়েছে। জানা যায়, এটি নাকি জনৈক হাবীবুরের কেনা বিল্ডিং। অন্য একটি মিডিয়াতে এ বিষয়ে ছবি প্রতিবেদন ছাপা হয় এবং প্রত্ম নিদর্শন ধ্বংসের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সতর্ক করে দেওয়া হয়। এদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়, প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর এবং এলাকাবাসীর এ বিষয়ে কি করণীয় তাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ইতিমধ্যে দৌলতগঞ্জ পুরাকীর্তি রক্ষা কমিটি তৈরী করেছে এবং এ সংক্রান্ত তথ্য ও খবর মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশের সিদ্ধান্তÍ নিয়েছে। সাংবাদিকরা এখন বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। এ বিষয়ে মোঃ গোলাম ফেরদৌসকে আমিসহ কয়েকজন সাংবাদিক ফোনে জানাই, পুরাতত্ত্ব অধিদফতর যেন এই ধ্বংস রোধে দৃঢ় ব্যবস্থা নেয়। গোলাম ফেরদৌসের ভাষ্য :সংশ্লিষ্ট এ বিষয়ে কোনো রিপোর্ট এখনও উপর মহলে জমা দেননি। ফলে আইনগত ব্যবস্থাও নিতে পারছেন না। এখন আমাদের প্রশ্ন, উপর মহলকে না জানিয়ে কেন তারা মিডিয়া কর্মীদের কাছে ঐ এলাকায় প্রতœস্থলের নিউজ পাঠালেন? প্রতœতত্ত্ব বিভাগ কি একবারও ভেবে দেখেছে, এদেশের প্রতœতত্ত্বের একমাত্র ধারক-বাহক শুধু সেই নয়, এদেশের সুশীল সমাজও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আমার জীবনের একটি অংশ এই এলাকায় কেটেছে । এলাকায় বাড়িঘর-রাস্তাঘাট সবই আমার পরিচিত। পুরো দৌলগঞ্জজুড়েই রয়েছে দৃশ্য-অদৃশ্য প্রত্ম নিদর্শন। মাটির নিচে খুড়লেই প্রাচীন কালের ইটের দেখা মেলে। বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেছে দু’বছর আগে একটি বাড়ি থেকে ১২ ইঞ্চি লম্বা একটি স্বর্ণের মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল এবং পরে তা থানায় জমা পড়েছিল। বহু উচ্চ ঢিবি দৌলতগঞ্জে রয়েছে। তবে বর্তমানে ব্যাঙের ছাতার মতো সেখানে নতুন নতুন পাকা ভবন নির্মিত হওয়ায় আড়ালে চলে যাচ্ছে পুরনো নিদর্শনগুলো। অথচ এসব ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে পারলে জাতি হিসেবে আমাদের গর্ব করার মতো আরও কিছু থাকতো । তারা যাতে এভাবে ধ্বংস না করে এ বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ অমল, সুশীল সমাজ এবং সাংবাদিকরা বেশ বুঝিয়েছেন, সতর্ক করেছেন। কিন্তু ভাঙা থামছে না। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, একমাত্র পুরাতত্ত্ব অধিদফতরই এই ধ্বংস রোধ করতে পারে। তাদের কাজে ভুল থাকতে পারে কিন্তু সংশোধনের তো পথ আছে। জানা যায়, যে স্থানে বর্তমানে দৌলতগঞ্জে প্রত্ম নিদর্শনের ধ্বংস চলছে, সেখানে ১৭১৪ সালে দৌলতখা নামের বিখ্যাত এক মোঘল কর্মকর্তার বাসস্থান ছিল। মোঘল সময়ের বহু ইমারত ছিল। এসব ইমারতের অপরিকল্পিতভাবে সংস্কার করে ব্রিটিশরা, যা দেখতে মোটেই দৃষ্টিনন্দন নয়। থানা রোডের উত্তর পার্শ্বে এবং দোয়ার পাড়ায় যেতে এর মধ্যবর্তী উঁচু যে স্থান রয়েছে এখানে কিছুদিন আগেও পাকা একটি ঘর এবং এর উত্তরে পুরনো ইটের দেয়াল দেখা যায়। ঘরের উপরের অংশ ফেলে দিয়ে ইংরেজরা বড় টালি ব্যবহার করে।
দেশে প্রায়ই প্রতœখননের সংবাদ ছাপা হয় পত্রপত্রিকায়, সারাদেশেই চলছে কোথাও না কোথাও খনন এবং প্রতœজরিপের কাজ। তবে বর্ষকাল আসায় খনন বন্ধ রাখা হয়। মুন্সীগঞ্জ টঙ্গীবাড়িতে বৌদ্ধবিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে ক’বছর আগে। এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা উচিত। এটি খনন দলের একটি বড় সাফল্য। সোনারগাঁয়ের পানাম ব্রিজটির অবস্থা ভালো নয়। পাশে আরও একটি ব্রিজও রয়েছে, যা অবহেলা-অযতেœ মাটির নিচে লুকিয়ে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়িতে ঈশাখার দরবার ঘরের অবস্থা করুণ। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ইচ্ছা করলে ঈশাখার প্রাসাদটি সংস্কার করতে পারে। সোনারগাঁ ব্রিটিশ সময়ের ঘরবাড়িগুলো কিন্তু ঠিকই প্রতœতত্ত্ব অধিদফর রংচং করে সাইনবোর্ড টানিয়ে দায়িত্ব রোধের পরিচয় দিয়েছে। মুন্সীগঞ্জ জেলাধীন লৌহজংয়ে রাজবল্লভের তৈরি বেজগাঁও রাজ প্রাসাদাটি ইতিমধ্যে দুষ্টুচক্র ধ্বংস করে ফেলেছে। পাশে অনীল কুমারের দ্বিতল বাড়িটি এখনও সুন্দরভাবে সংস্কার করা সম্ভব। ভূমিদস্যুরা নাকি জায়গাটি দখলে তৎপর। এই সব ভূমিদস্যুর মধ্যে নাকি রাজনৈতিক ব্যক্তিও রয়েছে। ঘটনা সত্য হলে সরকারের উচিত অবিলম্বে এসব দস্যুকে গ্রেফতার এবং অনিল কুমারের দ্বিতল বিখ্যাত বাড়িটি পুরাতত্ত্ব অধিদফতরের অধীনে । আনুমানিক ১৭৯০ সালে এ বাড়িটি নির্মিত হয়। বর্তমানে এলাকায় সবচেয়ে জীর্ণ এবং প্রাচীন জমিদারবাড়ি এটি। পুরাতত্ত্ব অধিদফতর কি এখানেও পিছপা হবে?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।