Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জমজমাট জুয়ার আসর

প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৪:৩০ এএম, ১৩ মে, ২০১৬

নূরুল ইসলাম : রাজধানীর পাড়া মহল্লায় চলছে জমজমাট জুয়ার আসর। তিন তাস, কাইট, হাজারী, কেরামসহ বিভিন্ন আইটেমের জুয়ার আসরে লাখ লাখ টাকার কারবার চলে। ক্লাব, রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের অফিস, সমিতির অফিস, মার্কেট ও দোকান ঘরে এসব আসরে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, এলাকার মাস্তান, পেশাদার ছিনতাইকারী, ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এমনকি দিনমজুরও অংশগ্রহণ করে। কোনো কোনো এলাকায় জুয়ার আসরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একাধিক মাদকের স্পট। চলছে নির্বিঘেœ মাদক বেচাকেনা। উঠতি বয়সিরা জুয়া ও নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে অবিভাবকরা উদ্বিগ্ন। আবার জুয়ার আসরকে ঘিরে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের আনাগোনাও বেড়ে যায়। গত ২৫ এপ্রিল রাতে মিরপুর মাজার রোড এলাকায় বিভিন্ন জুয়ার আসরে রাতভর অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল ও বিপুলসংখ্যক মোবাইলসহ জুয়া সিন্ডিকেটের ১৪ সদস্যকে আটক করে র‌্যাব-৪ এর একটি দল। অভিযানের পর র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, আটককৃত সিন্ডিকেট মাজার রোডে জুয়ার আসর বসায়। এসব আসরে জুয়া খেলতে আসা লোকজনকে তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নিতো। অভিযানে আটক ব্যক্তিদের কাছে থেকে বিভিন্ন ব্রান্ডের ৪০টি মোবাইল সেট উদ্ধার করে র‌্যাব। একাধিক ভুক্তভোগি জানান, থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে জুয়ার আসর চলে বলে এ নিয়ে অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার মেলে না। বরং কেউ জুয়ার আসর নিয়ে মুখ খুললে এলাকার মাস্তানরা হুমকি দেয়। নানাভাবে ঝামেলা করে। রাজধানীর বিভিন্ন থানা এলাকায় জুয়ার আসরের অনুসন্ধান পাওয়া গেছে। কোনো কোনো এলাকায় জুয়ার আসর বসে সন্ধ্যার পর। আবার কোনো কোনো এলাকায় রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই জুয়া চলে। যাত্রাবাড়ী থানার আশপাশে চারটি স্পটে জুয়ার আসর বসে। এসব আসরে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ছিনতাইকারী, ছিঁচকে চোর, পকেটমার, মলমপার্টির সদস্য এমনকি দিনমজুররাও অংশ নেয়। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার কারবার হয় এসব আসরে। সরেজমিনে ঘুরে জুয়ারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পাইকারী বাজারে আল্লাহর দান মৎস্য আড়তের বটতলায় কয়েকটি কক্ষে দিন-রাত তিন তাস, কাইট, হাজারী ও কেরাম বোর্ডে রাতদিন জুয়া চলে। এখানকার দুটি স্পটে জুয়ার আসর চালায় সবুজ। তার সহযোগী হিসাবে আছে রাজু ও রমজান। এর মধ্যে রমজান হলো বাড়ীওয়ালা। প্রতিদিন জুয়ার আসর থেকে তাকে দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। আলাপকালে সবুজের দুটি স্পটের জুয়ারীরা জানায়, প্রতিটি স্পটের জন্য থানা পুলিশকে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে দিতে হয়। এ ছাড়া সোর্স, এলাকার মাস্তান, প্রভাবশালী নেতাদেরকেও প্রতিদিন টাকা দিতে হয়। যাত্রাবাড়ীর কাজলায় সবুরের বাড়ীর স্পট চালায় রাজু ও সবুজ। বাড়ির মালিক হিসাবে সবুরও এই স্পটের অংশিদার। এখানেও তিন তাস, কাইটসহ বিভিন্ন আইটেমের জুয়া চলে। প্রতিদিন শতাধিক মানুষ আসে এই স্পটে। এই স্পটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জমজমাট মাদকের বেচাকেনা। সবুরের বাড়ির পাশেই বিক্রি হয় ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজাসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য। স্থানীয় কয়েংকজন বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, বাড়িতে জুয়ার আসর চলে বলে সবুর নিজেকে খুব প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর মনে করে। টেলিফোনে জানতে চাইলে বাড়িওয়ালা সবুর জুয়ার আসর বসানোর কথা অকপটে স্বীকার করে বলেন, সারাদেশেই তো অবৈধ কার্যকলাপ চলছে। আমি করলে দোষ কি? এক পর্যায়ে তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান এটা নিয়ে লিখে আপনার লাভ কি? যাত্রাবাড়ীর আরেক স্পট চলছে বিএনপি নেতা বরকত উল্লাহ বুলুর নির্মাণাধীন পেট্রোল পাম্পে। এখানেও প্রতিদিন জুয়ার পাশাপাশি মাদকের আসর বসে। পাম্পের কেয়ারটেকার আজাদের সহযোগিতায় এই স্পট চালায় তোফাজ্জল, চাঁন ও সোর্স আলম। এখানকার জুয়ারীরা জানান, জুয়ার আসরের জন্য প্রতিদিন আজাদকে দুই হাজার টাকা ছাড়া থানা পুলিশ, সোর্স, প্রভাবশালী ও মাস্তানদের টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী টিএন্ডটি অফিসের সামনে শ্রমিকলীগের অফিসের ভিতরে জুয়ার আসর বসায় শ্রমিক লীগ যাত্রাবাড়ী থানা শাখার নেতা আবুল ও সৈনিক লীগের শরীফ। এখানেও তিনকার্ডসহ বিভিন্ন আইটেমের জুয়ার আসর বসে। এসব জুয়ার আসর সম্পর্কে জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আনিসুর রহমান বলেন, আমার জানা মতে, মাছের আড়তের সামনে দিনমজুররা কেরামবোর্ড খেলে। সেখানে কোনো জুয়া হয় কিনা জানিনা। ওসি বলেন, জুয়ার আসর বসালে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কদমতলী থানার আলীবহর নামক স্থানে প্রতিদিন জুয়ার আসর বসে। মোটর চালকলীগ, ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন শ্রমিক ও অঙ্গ সংগঠনের অফিসে নিয়মিত জুয়ার আসর বসে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পোস্তগোলা থেকে পাগলা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের অফিসগুলোতে রাত-দিন জুয়া চলে। ওলামা লীগের একজন নেতার প্রত্যক্ষ মদদে এসব জুয়ার আসর বসে বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। এ ছাড়া বড়ইতলা থেকে জুরাইন রেলগেইট পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে কমপক্ষে দুই হাজার কেরাম বোর্ডে জুয়া চলে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। জাতীয়পার্টির এক নেতা এসব জুয়ার নিয়ন্ত্রক। থানা পুলিশও এখান থেকে নিয়মিত বখরা পায়।
মতিঝিলের ক্লাব পাড়া ছাড়াও দিলকুশা, ব্যাংক কলোনী, আরামবাগ, ফকিরেরপুল, পল্টনের নয়া পল্টন, কাকরাইল, গুলিস্তান, ওসমানী উদ্যান, বঙ্গবাজার এলাকায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসে। মিরপুরের ২ নং সেকশন, শাহআলী মাজার, গাবতলীর মাজার রোড, কল্যাণপুর বস্তি, মিরপুর ১০ নং সেকশনের ফুলবাগান ক্লাব, ১১ নং সেকশনে নির্মাণাধীন সিটি কর্পোরেশন মার্কেটের পেছনে ফকিরপট্টি এবং ৬নং সেকশনে চলন্তিকা ক্লাবে নিয়মিত জুয়ার আসর বসে। এসব আসরে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার কারবার চলে। স্থানীয়রা এসব জুয়ার আসর নিয়ে অনেকটা বিব্রত। ভুক্তভোগিরা জানান, এ নিয়ে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয় না। অভিযোগ করলে উল্টো ঝামেলায় পড়তে হয়। হাজারীবাগের অন্তত ৪০টি স্থানে প্রতি রাতে জুয়ার আসর বসে। লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা চলে নির্বিগ্নে। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশকে ম্যানেজ করেই জুয়ার আসর বসে। এখান থেকে পুলিশের ক্যাশিয়ার নামধারী জনৈক ব্যক্তি সপ্তাহ তুলে থাকেন। মাঝেমধ্যে যারা টাকা দিতে চান না তাদের আসরে অভিযান চালিয়ে জুয়ার পুরো টাকা কেড়ে নেয়া হয়। হাজারীবাগ ৫ নম্বর গেটের ট্রাকস্ট্যান্ডের পাশে আওয়ামী লীগ নেতা বাসুর রিকশা গ্যারেজে প্রতিদিন সন্ধ্যায় জুয়ার বোর্ড বসে। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। সনাতনগড় বউবাজার বস্তিতে তিনটি রিকশার গ্যারেজে এ আসর বসে প্রতি রাতে। বাসা-বাড়িতেও চলে ভোররাত পর্যন্ত। কালুনগর, নবীপুর ও বাড্ডানগর লেনের অধিকাংশ বাড়িতে রাতে জুয়ার বোর্ড বসানো হয়। স্থানীয়রা জানান, হাজারীবাগ থানা পুলিশের প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায় জুয়ার আসরগুলো বহালতবিয়তে চলে আসছে। এজন্য কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। কিছু বলতে গেলে পুলিশের ভয় দেখানো হয়। ভুক্তভোগি কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, জুয়ার কারণে এলাকার উঠতি বয়সী যুবসমাজ বিপথগামী হচ্ছে। জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে বাড্ডানগর লেনের ৪৯/ডি নম্বর বাড়িতে বসা জুয়ার বোর্ড থেকে পুলিশের এএসআই মাইনুল হোসেনসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে কিছু ইয়াবা ও নগদ ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৯ টাকা উদ্ধার করা হয়। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের মধ্যে একজনকে তিন মাস এবং ১১ জনকে ১৫ দিন করে সাজা দেন। রওশন আলী নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৮ হাজার টাকায় বাসাটি ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চক্রটি জুয়ার আসর চালাচ্ছিল। এছাড়া গত বছর উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের উত্তরা ইন হোটেলের চতুর্থতলার জুয়ার আসর থেকে পুলিশ কনস্টেবল মশিউর রহমান, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গুলশান শাখার কর্মকর্তা সাইফুল হাসান ওরফে রুবেল, দক্ষিণখান থানা শ্রমিকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাফিজ ওরফে জামাই হাফিজ, মো. আব্দুস সালাম, সোহেল রানা, আলম, মাহফুজুর রহমান, গিয়াসউদ্দিন, জাহাঙ্গীর, কাওসার চৌধুরী ও মাসুদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর কয়েক দিন আগে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ব্রিটিশ হোম নামে একটি রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে জুয়ার আসর থেকে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানসহ ৫২ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জমজমাট জুয়ার আসর
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ