পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বিশেষ সংবাদদাতা : মৃত্যুদ- কার্যকরের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। পরিবারের সদস্যদের সাথে শেষ সাক্ষাতের সময়ও তিনি স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলেছেন। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। কারাগার সূত্র জানায়, মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত খুবই স্বাভাবিক ছিলেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। ফাঁসির দড়ি গলায় ঝুলানোর পরেও তিনি উচ্চস্বরে পড়ছিলেন। কনডেম সেল থেকে জমটুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চের দিকে যাওয়ার সময়ও তিনি উচ্চস্বরে কলেমা পড়েন। কনডেম সেল থেকে বের হওয়ার আগে শেষ বারের মতো দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। ফজরের নামাজ আদায়ের পর কোরআন তেলাওয়াত করেন। এরপর কিছু সময় অন্য বন্দিদের সঙ্গে কথা বলেন। সকালে তাঁকে নাশতা দেয়া হয় দুটি রুটি ও এক বাটি সবজি। এসময় একজন কারা কর্মকর্তা কনডেম সেলে উপস্থিত হলে নিজামী তার কাছে জানতে চান, আজ তার মৃত্যুদ- কার্যকর হবে কি না? কর্মকর্তাটি সরাসরি উত্তর না দিয়ে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন নিজমাী ওই কর্মকর্তার কাছে জানতে চান, আজ (মঙ্গলবার) পরিবারের সদস্যদের তাঁর সাথে দেখা করতে পারবে কি না। এবার ওই কর্মকর্তা কৌশলে বলেন, আসলে তো আপনি জানতেই পারবেন। সূত্র জানায়, সকালে নাস্তার পর বেশ কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত ও নামাজ আদায় করে সময় পার করেন নিজামী। দুপুরে তার মেডিকেল চেকআপ করার জন্য কনডেম সেলে যান ডাক্তার বিপ্লব কান্তি ও আহসান হাবিব। এসময় তিনি সুস্থই ছিলেন। বেলা ১২টায় নিজামীকে কারা ক্যান্টিন থেকে দুপুরের খাবার দেয়া হয়। দুপুরের পর সর্বশেষ আইনী পর্যায় হিসাবে নিজামীর কাছে যান একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি সরকারী প্রতিনিধি দল। তারা নিজামীর কাছে জানতে চান তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না? নিজামী সাফ জানিয়ে দেন- তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন না। এসময় তাঁকে একটু সময় নিয়ে বলতে বলা হলেও তিনি তা নাকচ করে দেন। আছরের নামাজের পর কারাগারের অভ্যন্তরের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে নিজামী অনেকটা নিশ্চিত হন যে, রাতেই তাঁর মৃত্যুদ- কার্যকর হবে। সন্ধ্যা ৭টায় তাঁকে রাতের খাবার দেয়া হয়। খাবারের মেন্যুতে ছিল ভাত, মাছ, সবজি, ডাল ও মুরগীর গোশত। কিন্তু তিনি সেই খাবার খান নি।
কারাগার সূত্রে জানা যায়, নিজামীর সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য পরিবারের সদস্যরা রাত ৮টার কিছু পরে কারাগারের ভিতরে প্রবেশ করেন। প্রধান ফটক থেকে একটু ভিতরে একজন কারা কর্মকর্তার কক্ষের পাশে স্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। পরিবারের সদস্যদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধকরণসহ কিছু অফিসিয়াল কার্যক্রম শেষে কনডেম সেল থেকে নিজামীকে আনতে যান একজন কারা কর্মকর্তার নেতৃত্বে কয়েকজন। এসময় নিজামী নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ শেষে তাকে বলা হয়, আপনার জন্য স্বজনরা অপেক্ষা করছে। তিনি স্বাভাবিকভাবেই তাদের সাথে আসেন। সূত্র জানায়, স্বজনদের কাছে আসার পর নিজামীকে খুবই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেন। এ সময় তিনি খুবই সংযত হয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। বলেন, তোমরা এতো অধৈর্য্য হলে কেনো? আমি তো শক্ত আছি। তোমরাও শক্ত হও। সূত্র জানায়, এসময় নিজামী তার নাতীকে আদর করেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। একই সাথে ছেলে মেয়েকে সঠিক পথে চলার পরামর্শ দেন। নিজামীর এক মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। বলেন, আব্বা আপনার জন্য একটা চশমা কিনেছিলাম। এই বলে তিনি চশমাটি বাবার হাতে তুলে দেন। নিজামী সেটি হাতে নেন। এ সময় তিনি কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। সাক্ষাত পর্বে একে একে পরিবারের সবাই নিজামীর কাছে দোয়া চান, নিজামীও তাদের কাছে ক্ষমা চান। দোয়া করতে বলেন। এক পর্যায়ে তিনি সবাইকে নিয়ে দোয়া করেন। সূত্র জানায়, অনেকক্ষণ ধরে সেই দোয়া চলে। দোয়া চলাকালে সাক্ষাত করতে যাওয়া সবার চোখ বেয়ে পানি ঝরছিল। কেউ কেউ হু হু করে কেঁদে ওঠেন। সাক্ষাত পর্ব থেকে ফেরার সময় নিজামীর স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও এক ভাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর মতিউর রহমান নিজামীকে কনডেম সেলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তখন রাত ৯টা ৫৫ মিনিট। এরপর তাকে গোসল করানো হয়। গোসলে সহায়তা করেন কারাগারের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন। গোসল করার পর ওজু করে নিজামী নামাজ পড়েন। এরপর কোরআন তিলাওয়াত করেন। ইমাম সাহেব তাঁকে তওবা পড়াতে চাইলে তিনি নিজেই তওবা পড়বেন বলে জানান। এসময় নিজামী মেয়ের দেয়া নতুন চশমাটি পরেছিলেন। রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে জল্লাদ রাজুর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের জল্লাদদল কনডেম সেলে যায়। তাদের মধ্যে আবুল হোসেন, মাসুম-১ ও মাসুম-২ ছিল। এ সময় সেখানে সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলর নেছার আলম, সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল মালেক মৃধা ও কারাগারের অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কনডেম সেলে গিয়ে সিনিয়র জেল সুপার নিজামীকে বলেন, আপনার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে। উত্তরে নিজামী বলেন, আমার প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। পরক্ষণেই দোয়া পড়ে চোখের চশমা খুলে টেবিলে রাখেন। এরপর জল্লাদ রাজু বলে, হুজুর হাত পেছনে নেন। নিজামী হাত পেছনে নেন। জল্লাদ রাজু তাঁর হাতে হাতকড়া পরায়। এরপর সেলের ভেতরে তাকে জমটুপি পরানো হয়। ১২টা ৫ মিনিটে নিজামীকে সেল থেকে বের করে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। সূত্র জানায়, নিজামী খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পায়ে হেঁটে ফাঁসির মঞ্চের দিকে যান। এ সময় তিনি উচ্চ স্বরে দোয়া পড়ছিলেন। দোয়া পড়া অবস্থায় ১২টা ১০ মিনিটে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে লাল রুমাল মাটিতে পড়ার সাথে সাথে জল্লাদ রাজু লিভার টানে। এরপর ফাঁসির দড়িতে পাঁচ মিনিট নিজামীকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পরে পায়ের রগ কাটাসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। লাশের গোসল শেষে কাফনের কাপড় পরিয়ে কফিনে তুলতে অনেক সময় লেগে যায়। রাত দেড়টার দিকে তাঁর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এর আগে মৃত্যুদ- কার্যকরের চূড়ান্ত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত রোববার রাত ১১টার পর মতিউর রহমান নিজামীকে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই-সিকিউরিটি কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। আপিল রিভিউ খারিজের বিষয়টি সোমবার রাতে নিজামীকে জানানো হয়। সূত্র জানায়, রিভিউ খারিজের রায় শোনার পর কিছুটা বিমর্ষ দেখায় নিজামীকে। সেদিন রাতে অনেক দেরি করে ঘুমাতে যান তিনি। এর আগে নফল নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াত করেন। তবে মৃত্যুর আগের মুহূর্তগুলো সেই বিমর্ষতা কাটিয়ে তিনি অনেকটাই স্বাভাবিক ছিলেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।