দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
প্রশ্ন : কোরবানি কি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে?
উত্তর : মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহা হল কোরবানির ঈদ। আর কোরবানি মানেই অর্থনীতির পালে সুবাতাস ছড়িয়ে দেয়া। কোরবানির পশুর বাজারকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গরু-খাসি পালনের জন্য অনেকেই বিনিয়োগ করেন। কেউ মাত্র কয়েক মাসের জন্য বিনিয়োগ করেন। আবার অনেকের পরিকল্পনা থাকে দীর্ঘমেয়াদি। লাখ টাকা বা তার চেয়েও বেশি দামে পশু বিক্রির টার্গেট থাকে অনেকের। পারিবারিক পর্যায়ে পশু পালনের আয়োজন যেমন দেখা যায়, তেমনি বড় ধরনের অর্থ বিনিয়োগ করেও খামার গড়ে তুলছেন খামার ব্যবসায়ীরা।
কোরবানির জন্য বিক্রি হওয়া পশুর সংখ্যা কত, তার সঠিক তথ্য এখনও বের করা যায়নি। এক হিসাবে যদি এ সংখ্যা ৩০ লাখ বলা হয়, তো আরেক হিসাবে দেখানো হয় ৬০ থেকে ৭০ লাখ গরু-ছাগল জবাই হয় কোরবানির তিন দিনে। পশুসম্পদ বিভাগের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৩-১৪ সালে বাংলাদেশে গরুর সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৩৫ লাখের মতো। মহিষ ছিল সাড়ে ১৪ লাখ। ভেড়া ৩২ লাখ এবং খাসি-ছাগল আড়াই কোটির কিছু বেশি। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে গবাদিপশুর উৎপাদন প্রায় স্থিতিশীল রয়েছে (মাত্র ০.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি); কিন্তু ছাগল-খাসির উৎপাদন যথেষ্ট বেড়েছে। কোরবানির জন্য এ দুই ধরনের পশুর ওপরই চাপ পড়ে। অনেকেই এ সময়ে ভালো দাম পেয়ে ঘরের গরু-ষাঁড়-খাসিও বিক্রি করে দেন।
ফরমাল ও ইনফরমাল মিলিয়ে ঈদুল আজহার সময় প্রচুর গরুর আগমন ঘটে আমাদের এ দেশে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন বলেছিল, ৩৫ লাখ গরু ও ৫০-৫৫ লাখ ছাগল কোরবানি দেয়া হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের বিভিন্ন পশু হাটের তালিকা করে সেগুলোতে হিসাব করে বলেছে, ২০১৫ সালে ৪৫ লাখ গরু ২০ হাজার কোটি টাকায় বেচাকেনা হয়। আর ৩৫ লাখ খাসি গড়ে ৫ হাজার টাকা ধরলে এ বাবদ লেনদেন হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। প্রশ্ন হলো, এই ২১ হাজার কোটি টাকা যাচ্ছে কোথায়? যাচ্ছে গরিবদের ঘরে। প্রায় ৯৯ শতাংশ কোরবনির পশুই কেনা হয় গরিবের কাছ থেকে। গরিব মানুষ সারা বছর গরু লালন-পালন করে কোরবানির হাটে নিয়ে আসে। হাটে গরু বিক্রি করে ধনীদের হাতে তুলে দেয়। আর তারা ঘরে নিয়ে যায় মোটা অঙ্কের টাকা। কোরবানির পুরো টাকাটাই তাদের ঘরে যায়। একসঙ্গে এতগুলো টাকা পেয়ে তারা তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করে। গরিবদের অর্থনৈতিক চাকা সচল হয়। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। গ্রামগঞ্জের বাজারগুলো সচল হয়ে ওঠে। কোরবানির গোশতেরও সিংহভাগ চলে যায় গরিবের ঘরে। সারা বছর যেসব গরিব পরিবার ভালোভাবে গোশত খেতে পারে না কোরবানি তাদের তৃপ্তিভরে গোশত খাওয়ার সুযোগ করে দেয়।
আবার কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে কসাই ও যারা মাংস কাটাকাটি করেন, তাদের হাতেও অর্থের সমাগম ঘটে। এটাকে কেন্দ্র করে আমাদের কামার-কুমোর সম্প্রদায় চাঙ্গা হয়। অনেক সময় ইলেকট্রনিক পণ্য বিশেষ করে ফ্রিজের একটা আলাদা বাজার তৈরি হয়। মসলার আমদানি বাড়ে, সেসঙ্গে আলোচ্য বাজারে বিক্রি-বাট্টা বাড়ে, লেনদেনও বাড়ে। এজন্য বলছি, ঈদকে কেন্দ্র করে উপকারভোগী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় আট কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কোরবানি ঈদের সময় রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়ে ওঠে, যা প্রামীণ অর্থনীতিতে বাড়তি গতি এনে দেয়। লক্ষণীয়, প্রায় ৬০-৬৫ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ করা হয় এ কোরবানির ঈদের সময়। এক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের অভিজ্ঞতা খারাপই বলা যায়। আমাদের চামড়াজাত দ্রব্যের রফতানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেলেও ঋণটা যাচ্ছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। এখন সময় এসেছে ওই ঋণের কিছু গবাদিপশু পালনকারীদের দেয়া যায় কিনা সেটা ভাবার। যতটুকু জানি, কিছু বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক এ বিষয়ে উদ্যোগও নিয়েছে।
সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় দেখা যায় কোরবানির অর্থনীতিটা ফি-বছর বড় হচ্ছে। আগে শুধু কোরবানি দেয়াটাই ছিল মুখ্য। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পর্যটন। যুক্ত হয়েছে ঈদ বোনাস। সব মিলিয়ে একটি ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে অর্থনীতিতে। ধীরে ধীরে আনুষ্ঠানিক পেশার বিস্তার ঘটছে। সেটাকে কেন্দ্র করে কোরবানির অর্থনীতিও বড় হচ্ছে। যেখানে রমজানের ঈদের অর্থনীতি প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা, সেখানে কোরবানির অর্থনীতির আকার প্রায় ৩০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ইদানীং লক্ষ করছি, ফ্রিজসহ অন্যান্য পণ্যের বিক্রি বাড়ছে কোরবানির সময়। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগছে। একটি ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে, যাতে সহযোগী শিল্পগুলো ও প্রণোদিত হতে পারে।
উত্তর দিচ্ছেন : মুফতী মাওলানা এহসানুল হক মুজাদ্দেদী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।