Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

হিজাবের প্রতি এত বিরাগ কেন?

প্রকাশের সময় : ১১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ তোফাজ্জল বিন আমীন

ইসলাম আল্লাহতায়ালার মনোনীত একমাত্র জীবন ব্যবস্থার নাম। ইসলাম প্রত্যেকটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলে। ইসলাম নারীর অধিকারের কথা বলে। ইসলামের বিধিবিধান মেনে চলার মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। ইসলামে হিজাবের গুরুত্ব অপরিসীম। পর্দার আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে হিজাব। এর শাব্দিক অর্থ প্রতিহত করা, বাধাদান করা, গোপন করা, আড়াল করা, ঢেকে রাখা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের যারা ‘গাইর মাহরাম’ (যাদের সঙ্গে বিবাহ বৈধ) সেসব পুরুষের সামনে যতটুকু খোলা রাখার অনুমতি ইসলাম দিয়েছে তা ব্যতীত পা হতে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রাখাকে হিজাব বা পর্দা বলে। ইসলাম নারীর সতীত্ব রক্ষা করার জন্যই হিজাবের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, একশ্রেণীর অভিভাবক হিজাবের গুরুত্ব উপলব্ধি না করার কারণেই তাদের তরুণী মেয়েদের বিনা পর্দায় স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাইতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। ইসলাম নারীকে যে অধিকার দিয়েছে তা পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম দেয়নি। তারপরেও ইসলামকে মৌলবাদ বলে গালি দেওয়া হচ্ছে। মহাগ্রন্থ আল কোরানে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করছেন : ‘‘আর মুমিন মহিলাদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। আর তারা যেন স্বীয় সাজ সৌন্দর্য অপরকে না দেখায়, তবে যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তার কথা ভিন্ন। তারা যেন তাদের ওড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে” (সূরা আন নূর-৩১)। হিজাব হলো ভদ্রতা, সভ্যতা ও আধুনিকতা রক্ষার আচ্ছাদন, যা সর্বাবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তি ও পরিবারের গোপনীয়তা সংরক্ষণ ও সম্মান রক্ষা করে। হিজাব সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যে এমন একটি শালীনতার সীমা তৈরি করে যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে অশালীন ও অনৈতিক কর্মকা- থেকে রক্ষা করে। হিজাব বা পর্দা হচ্ছে আল্লাহকে ভয় করার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। যারা পর্দায় বিশ্বাস করে এবং মনেপ্রাণে মেনে নেয় তারাই প্রকৃত শরিয়াহ অনুযায়ী হিজাব পরিধান করে পর্দা করে। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করাই মূলত পর্দার লক্ষ্য। হিজাব ব্যবস্থায় নারীর সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য আড়াল হয় ঠিকই কিন্তু মেধা ও যোগ্যতা আড়াল হয় না। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরার অপরাধে এক ছাত্রীকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। কিছু শিক্ষকের ভিতরে যে অসুস্থ রকমের হিজাব বৈরিতা বিরাজ করে তা কোনো অজানা ব্যাপার নয়। হিজাব অথবা নিকাব নিয়ে ক্লাসে কটূক্তি করা, এই পোশাক পরতে নিষেধ করা, নিষেধ না শুনলে ক্লাস থেকে বের করে দেয়া মৌলিক ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একসঙ্গে হাঁটতে পারবে না ছাত্র-ছাত্রীরা। এমনকি পাশাপাশি বসতেও পারবে না। এমন নির্দেশিকা জারি করেছে পাকিস্তানের পাখতুনখোয়া সোয়াত বিশ্ববিদ্যালয়। এরকম সিদ্ধান্ত যদি বাংলাদেশে নেওয়া হতো তাহলে ধর্ষণের হাত থেকে অনেক নারীর ইজ্জত রক্ষা করা যেত। প্রতিনিয়ত ধর্ষণের সংবাদ পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। হত্যা, খুন, ধর্ষণ যেন মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। নারীর ইজ্জত তো কচুপাতার পানি নয়! তাহলে কেন মুসলিম অধ্যুষিত জনপদে নারীকে হিজাব পরে ক্লাসে যেতে বাধা দেয়া হচ্ছেÑ এ বিষয়টি মুসলিম অভিভাবকের ভেবে দেখা প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে হিজাব পরার অপরাধে একই বিভাগের শিক্ষক ড. আজিজুর রহমান ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছেন। ড. আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি ওই ছাত্রীকে বোরকা পরে ক্লাসে আসতে নিষেধ করেন। একই সঙ্গে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিনি বলেন, যতদিন হিজাব পরে আসবে ততদিন ক্লাসের উপস্থিতিও দেয়া হবে না। এ ঘোষণার পর বেশ কয়েকটি ক্লাসে ওই শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকলেও শিক্ষক তার উপস্থিতি দেননি। সর্বশেষ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ক্লাসেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় ছাত্রীটি দাঁড়িয়ে তার হাজিরা দেওয়ার জন্য স্যারকে অনুরোধ করেন। ড. আজিজুর রহমান তাকে হিজাব খুলে ক্লাসে আসলে হাজিরা দেয়া হবে বলে সাফ জানিয়ে দেন। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত বছরও ড. আজিজুর রহমান বোরকা পরে আসার কারণে নাবিলা ইকবাল নামে তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে ক্লাস থেকে বের করে দেন।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকই ধোয়া তুলসিপাতা নন। প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর যৌন হয়রানির খবর মুদ্রিত হচ্ছে। সম্প্রতি দেশের অন্যতম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আহছান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ও ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্ছিনিয়ার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌসকে যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌস দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রীদের নানা কায়দায় যৌন হয়রানি করছিলেন। ক্লাসের পড়া বুঝানোর কথা বলে বাসায় ডেকে জোরপূর্বক যৌন হয়রানি করতেন। এতে কেউ রাজি না হলে তাকে সেমিস্টারে ফেল, ড্রপ আউট, চারিত্রিক সনদ না দেয়াসহ ইনকোর্স ও অ্যাসাইনমেন্টে নম্বর কমিয়ে দেয়ার হুমকি দিতেন। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে চুয়াডাঙ্গা ঝিনুক মাধ্যমিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহাদ আলীকে ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নিকট অতীতে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) ভিসি ড. আলিমুল্লা বোরকা, হিজাব, পায়জামা, পাঞ্জাবি, টুপি ও পাগড়ির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এমনকি পরীক্ষা দিতে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঞ্জাবি, টুপি, হিজাব, বোরকা খুলতে বাধ্য করা হয়। শুধু কি তাই! ইসলামী পোশাক পরার কারণে ছাত্র ও ছাত্রীদের লিফট থেকেও বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটে।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড়শত ছাত্রছাত্রী প্রেসিডেন্টের নিকট বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় পোশাক পরতে নিষেধ করার প্রতিবাদ করলে ধর্মীয় পোশাক পরার ওপর কড়াকড়ি বন্ধ থাকে। কিন্তু গত ১লা ডিসম্বরে ছাত্রছাত্রীদেরে ধর্মীয় পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানসংলগ্ন চত্বর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ইসলাম যেখানে নারীকে হিজাব পরার অনুমতি দিয়েছে সেখানে জঙ্গির জজুর ভয় দেখিয়ে হিজাব পরতে বাধা দেয়ার প্রেক্ষিতেই স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ইজ্জত লুণ্ঠিত হচ্ছে, যা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়।
মহান আল্লাহতায়ালা কোরআনের ঘোষণার মাধ্যমে পর্দার বিধান ফরজ করে দিয়েছেন। নারীর ইজ্জত আবরুর হিফাজতে বোরকা মুসলিম সমাজে প্রাচীনকাল থেকে পর্দানশিন পোশাক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকায়ও মুসলিম নারীদের কাছে বোরকা জনপ্রিয় পোশাকে পরিণত হয়েছে। এমন বাস্তবতায় ৯০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ যেখানে কৃষ্টি-কালচার ও ঈমান-আকিদার ব্যাপারে নিষ্ঠাবান সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর বোরকা পরিধানে বাধা ভাবতেই অবাক লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমালোচনা করার ন্যূনতম জ্ঞান বা বুদ্ধি আমার নেই। তবে এটুকু কথা না বললেই নয়, যেসব শিক্ষক হিজাবের বিরোধিতা করেছেন তারা কি ব্যক্তি পারিবারিক জীবনেও হিজাববিরোধী নাকি বিশেষ মহলের সুবিধা পাওয়ার জন্য বিরোধিতা করেছেন তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। একজন নারীর ইজ্জতের চেয়ে বড় সম্পদ দুনিয়াতে আর কিছু নেই। যে কোনো সচেতন মানুষই এ পৃথিবীতে সম্মান ও নিরাপত্তার সাথে বসবাসের গ্যারান্টি চায়। কিন্তু গ্যারান্টি পাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের নিজেরও কিছু করণীয় আছে তা আমরা অনেক সময় বেমালুম ভুলে যাই। একথা তো অস্বীকার করার কোনো জো নেই যে, নারীর অবাধ সৌন্দর্য প্রদর্শনের বিষয়টি পুরুষদের আগ্রাসী করে তোলে। নারী যখন ইভটিজিং কিংবা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, তখন আমরা নৈতিকার প্রশ্ন তুলি। পুরুষ নারীকে অসম্মান করবে না, নিপীড়ন করবে না এটা যেমন নৈতিকতার বিষয় তেমনি নারীও নিজেকে শালীন রাখবে আবৃত রাখবে, এটাও তো নৈতিকতার বিষয়। হিজাব নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেই সিঙ্গাপুরের মতো দেশে হিজাবের আরোপিত ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবির প্রতি সমর্থন বাড়ছে। নারীর হিজাবের বিরোধিতা যারাই করছে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক- এটাই কাম্য।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হিজাবের প্রতি এত বিরাগ কেন?
আরও পড়ুন