Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘এটা ইতিহাসের কলঙ্কিত নির্বাচন’

নির্বাচন নিয়ে বাম জোটের প্রার্থীদের গণশুনানি

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালটে সিল, আইন শৃংখলা বাহিনীর ভোটারদের ভোটদানে বাধাসহ নানা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে জোটের ১৩১ প্রার্থী এক গণ শুনানিতে নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরেন। তারা জানান, প্রতিটি কেন্দ্রেই ভোটের আগের রাতে ৩০-৫০ শতাংশ ভোট নৌকা মার্কায় সিল মারা হয়। কোথাও পুলিশের সহায়তা ব্যালটে নৌকা প্রতীকে সিল মারা হয় কোথাও পুলিশ নিজেই সিল মারে নৌকা মার্কায়।
গণশুনানিতে বাম গণতান্ত্রিক জোটের জোটের সমন্বয়ক শাহ আলম, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতির জোনায়েদ সাকী, মোশরেফা মিশুসহ কেন্দ্রীয় নেতা এবং সারাদেশের জোটের প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
নির্বাচনে ভোট চিত্র নিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের উদ্যোগে আয়োজিত গণশুনানিতে সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয়ে চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। বাম গণতান্ত্রিক জোট এবারের নির্বাচনে ১৩১টি আসনে ১৪৭ জন প্রার্থী অংশ নেয়। আর গণশুনানিতে ১৩১ জন প্রার্থী নির্বাচনের দিনে অনিয়মের চিত্র লিখিত ভাবে তুলে ধরেন এবং বর্ণনা দেন।
গণশুনানীতে বামজোটের প্রার্থীরা অভিযোগ করেন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকার বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিরোধী দল ও জোটগুলোর কোনো দাবিই মানেনি। সরকার পদত্যাগ করেননি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠিত হয়নি, জনগণের সমর্থনহীন বিতর্কিত সংসদ বিলুপ্ত করা হয়নি, অকার্যকর ও সরকারি দলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশনে পরিবর্তন আনা হয়নি। পুলিশ বাহিনীকে আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বোপরি নির্বাচনের টাকার খেলা বন্ধসহ অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ন্যুনতম কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
অভিযোগে তারা বলেন, জনগণের প্রতি পুলিশের মারমুখি আচরণ ছিল ভয়ঙ্কর। তফসিল ঘোষণার পর বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানি, হুমকি শাস্তি দেওয়া অব্যাহত রয়েছে। দেশের অধিকাংশ এলাকায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে বলে অভিযোগ করেন প্রার্থীরা। তারা অভিযোগ করে বলেন, দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর সংলাপের ফল হিসাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অনুষ্ঠানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সরকার ও সরকারি দল সুষ্ঠু নির্বাচনের যুক্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত কোনো দাবিই মানেনি।
প্রার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, নির্বাচনে দেখা গেছে, মনোনয়ন বাণিজ্য বড় বাণিজ্য পরিণত হয়েছে। সমগ্র নির্বাচন টাকার খেলায় পর্যবসিত হয়েছে। এ কারণে সংগ্রামী, নিবেদিতপ্রাণ পোড়খাওয়া রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
পঞ্চগড়-২ আসনের বাম দলের প্রার্থী আশরাফুল আলম ভোটের দিনে ভোটারদের আইন শৃংখলা বাহিনীর ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধাসহ বিভিন্ন অনিয়মের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভোটের দিনে সরকারি দলের লোকজন পুলিশের সহায়তায় ভোট কেন্দ্রে জবর দখল করে রেখেছিল। প্রার্থীদের দূরের কথা ভোটারদেরও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়নি। বিরোধী দলের কোনো পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি যারা ভোট গ্রহণ করেছে তারাও সাধারণ ভোটারদের ভোটদানের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে নৌকার সীল মারার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।
আগের রাতেই ব্যালটের নৌকা প্রতীকে সীল মারা হয়েছে জানিয়ে গাইবান্ধা-১ আসনের প্রার্থী গোলাম রাব্বানী বলেন, ভোটগ্রহণের আগের রাতে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যালট পেপারে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে রাখা হয়েছিল। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কাউকে ভোটকেন্দ্রের আশপাশে যেতে দেওয়া হয়নি। ভোটগ্রহণের আগের রাতে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা ছিল পুলিশ বাহিনীর। তারই নৌকা প্রার্থীকে জেতানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। পাবনা-১ আসনের প্রার্থী জুলহাসনাইন বাবু বলেন, ভোটের জন্য ঠিকমতো প্রচারণা করতে দেওয়া হয়নি। সবসময় আমাদের নেতাকর্মীদের হুমকির মধ্যে রাখা হয়েছে। প্রতি পদে পদে বাধা দেওয়া হয়েছে আমাদের। নজীরবিহীনভাবে আইন শৃংখলা বাহিনী নৌকার প্রার্থীর পক্ষ্যে কাজ করেছে।
নরসিংদী-৪ আসনে কাস্তে মার্কা নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন সিপিবির কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন। তিনি অভিযোগ করেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় একটি ভোটকেন্দ্রের এক প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নির্বাচনের আগের দিন আমার কাছে স্বীকার করেন, প্রশাসনের নির্দেশ ৩৫ শতাংশ ভোটের সিল যেন নির্বাচনের আগের রাতেই দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের চাপে পরে তা ৪৫ শতাংশ হয়ে যায়। সেই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নির্বাচনের আগের দিন রাতে আমাকে বলছিলেন, ‘এখন আমি কীভাবে এই বাড়তিটুকু ম্যানেজ করব’।
ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থী শম্পা বসু মই মার্কায় নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি গণশুনানিতে অভিযোগ করেন, সকালে সেগুন বাগিচা হাই স্কুল ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখি, কেন্দ্রে কোনো ভোটার নেই। অথচ ব্যালট বাক্স ভোটে ভর্তি হয়ে আছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, মাত্র ১০০টি ভোট পড়েছে। কিন্তু ব্যালট বাক্স ভর্তি এত ভোট কোথা থেকে এল? গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ঢাকা-১২ আসন থেকে কোদাল মার্কার প্রার্থী ছিলেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগের দিন রাতেই কেন্দ্রভেদে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোট সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর মতো কলঙ্কজনক নির্বাচন আর নেই। আমার উপলব্ধিতে এটা ইতিহাসের কলঙ্কিত নির্বাচন। নির্বাচনের আগে থেকেই পুরো একটা একতরফা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। বিরোধী প্রার্থীদের ওপর হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার করে এই পরিবেশ তৈরি করা হয়। মানুষ যাতে ভোটকেন্দ্রে আসতে না পারে, জনগণ ভয় পায় এমন পরিবেশ তৈরি করা ছিল।
রাজশাহী-১ আসনের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের প্রার্থী আলফাজ হোসেন বলেন, ভোটের নানা অনিয়ম রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ প্রশাসনকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হলেও তার কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। রাঙামাটি জেলা থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির জুঁই চাকমা। তিনি বলেন, ভোটের দিন আমার নির্বাচনী এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে বাঁধা দেয় আওয়ামী লীগের কর্মীরা। আমার দলের লোকেরাই তাঁদের ভোট দিতে পারেননি। ভোটকেন্দ্র দখলের প্রতিবাদ করায় উল্টো আমার এজেন্টদের মারধর করা হয়। আমি ১৫টি ভোটকেন্দ্র ঘুরে অনিয়ম পেয়েছি।
গণশুনানিতে অংশ নেন ঠাকুরগাও-৩ আসনের প্রার্থী প্রভাত সমীর, দিনাজপুর-৩ আসনের প্রার্থী বদিউজ্জামাল বাদল, নীলফামারী-৩ আসনের প্রার্থী ইউনুস আলী, রংপুর-৩ আসনের প্রার্থী আনোয়ার হোসেন বাবুল, কুড়িগ্রাম-২ আসনের প্রার্থী উপেন্দ্র নাথ রায়, বগুড়া-৬ আসনের প্রার্থী আমিনুল ফরিদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটের অসংখ্য প্রার্থী।



 

Show all comments
  • Mohamed Altafur Rahman ১২ জানুয়ারি, ২০১৯, ১০:৫৫ এএম says : 0
    আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে উনাদের বকতব্য গুলো পরলাম আর ভাবলাম উনার ইতিহাসের কথা বলছেন কিন্তু কোন ইতিহাস ও কোথাকার ইতিহাস? বাম দল বলতে সাধারণত আমরা পৃর রাশা, পৃর চাতলাপুর, পৃর কিউবা , পৃথক ভিৎেতনাম বা প্রখর উত্তর কোরিয়া এর কোন কোন দেশের চাইতে বাংলাদেশের দমন নিরুপন বেশি, বাঁক ও ব্যাকতি স্বাধীনতা কম অথবা ভোটাধিকার সিমিতো!! উত্তর পেলে খুশি হবে!!
    Total Reply(0) Reply
  • রহিম ১২ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:৩৯ পিএম says : 0
    ভোটের কথা পরে আগে যান বাচান ঘরে থাকলে খুন বাহির গুম
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ