Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্ভাবনা নয় সঙ্কট বাড়বে

প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৩ পিএম, ৯ মে, ২০১৬

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : খনি অভ্যন্তরেই পড়ে রয়েছে দেশীয় কয়লা। নীতিমালার অভাবে তা উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে দেশে কয়লাভিত্তিক বেশ কয়েকটি বড় ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে শতভাগ আমদানিনির্ভর কয়লায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হবে। এটা সম্ভাবনার চেয়ে সঙ্কটই বাড়াবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, আমদানিতে যেকোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে কয়লানির্ভর এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া আমদানিনির্ভর কয়লায় ইউনিটপ্রতি আনুমানিক উৎপাদন ব্যয় পড়বে যেখানে গড়ে সাত টাকা, সেখানে দেশীয় কয়লা উত্তোলন করে খনির পাশে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে উৎপাদন ব্যয় ৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪ টাকার বেশি হবে না।
এই কর্মকর্তার মতে, বর্তমানে আমদানিনির্ভর কয়লাকে কেন্দ্র করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে সরকার চুক্তিবদ্ধ হলেও এক সময় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেশীয় কয়লার ওপরই নির্ভর করতে হবে। তখন সমুদ্র তীরবর্তী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দেশীয় কয়লা সরবরাহ করে উৎপাদনে যাওয়াটা অনেক ব্যয়বহুল হবে। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে কয়লা খনির কাছাকাছি অবস্থানে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। বর্তমানে আবিষ্কৃত সব কয়লা খনির অবস্থানই দেশের উত্তরাঞ্চলে। অথচ বড় ধরনের যে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে তার দু’টি সুন্দরবনের কাছাকাছি এবং একটি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে।
সমুদ্র তীরবর্তী স্থানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বড় ধরনের আন্দোলন হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বলানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, বাঁশখালী এবং রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সরকারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে না। যথাস্থানেই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে। তার মতে, কাছেই সমুদ্র এবং প্রকল্প এলাকায় বসতি কম হওয়ায় সব দিক বিবেচনার্থে রামপাল এবং বাঁশখালীর নির্ধারিত স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করাটা লাভজনক হবে।
উল্লেখ্য, চট্রগ্রামের বাঁশখালী এবং সুন্দরবনের রামপালে সরকার পৃথক দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। এর মধ্যে রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হবে ভারতের সাথে যৌথ উদ্যোগে এবং বাঁশিখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে সম্প্রতি সেখানে ত্রিমুখী সংঘর্ষে কমপক্ষে চারজন গ্রামবাসী প্রাণ হারান। এছাড়াও ওই সংঘর্ষে আহত হয়েছেন আরো অনেকে।
অন্যদিকে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও রয়েছে পরিবেশবাদীদের তীব্র আপত্তি। তাদের মতে, এখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অর্থই হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন বনভূমিকে ধ্বংস করে দেয়া। জাতীয় তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম বলেন, অব্যাহতভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে অপপ্রচারণা চলছে। এটি যেমন বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে, তেমনি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরেও। তিনি জানান, আমদানি করা কয়লা দেশীয় কয়লার চেয়েও উন্নতমানের হবে। তার মতে, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে যেসব কয়লা আমদানি করা হবে তাতে সালফারের পরিমাণ অনেক কম থাকবে। এছাড়াও কয়লানির্ভর এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র সমুন্দ বন্দরসংলগ্ন হওয়ায় আমদানি করা কয়লা সহজেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে নেয়া যাবে।
এই বক্তব্যের সাথে একমত নন জাতীয় তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা কমিটি। এ ব্যাপারে ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, ভারতের এনটিপিসির সাথে বাংলাদেশের পিডিবি যৌথভাবে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তা অসম, অস্বচ্ছ এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী। এছাড়াও বাংলাদেশের ওরিয়ন কোম্পানিকেও সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ৫৫৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একই ধরনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপকে ১৩২০ মেগাওয়াটের যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে তাও সঠিক নিয়মনীতি মেনে দেয়া হয়নি। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মানুষ ও প্রকৃতির অপূরণীয় ক্ষতি ছাড়াও বাংলাদেশের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হবে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, এছাড়াও পরিবেশ সমীক্ষার নিয়মাবলি অস্বীকার করে আগে ভূমি অধিগ্রহণ, নির্যাতনমূলকভাবে মানুষ উচ্ছেদ, হাইকোর্টের রুল অগ্রাহ্য করা এবং পরবর্তীতে স্ববিরোধী, ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ, অসঙ্গতিপূর্ণ এক পরিবেশ সমীক্ষা প্রণয়ন ইত্যাদি সবকিছুই প্রমাণ করে যে, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় দেশী- বিদেশী গোষ্ঠী মরিয়া। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র একসময় শুধু পুরো বাংলাদেশকেই অরক্ষিত করে ফেলবে না, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের জন্য গলার ফাঁসে পরিণত হবে। এসব কেন্দ্র চালাতে তখন বিদেশ থেকে আমদানি করা কয়লার পরিবর্তে দেশীয় কয়লাই মুখ্য হয়ে উঠবে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, পৃথিবীর যেসব দেশে কয়লা খনি রয়েছেÑ ওইসব দেশে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হয় খনির কাছাকাছি। যাতে করে উত্তোলনকৃত কয়লা সহজেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে নেয়া যায়। কিন্তু আমাদের কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এসব জায়গায় হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে সরকারের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দেবে।
দেশীয় কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা তপন চৌধুরী বলছেন, কয়লানীতি না হওয়ায় দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাই জাতীয় স্বার্থেই রাজনীতিকদের কয়লানীতি চূড়ান্ত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, শুধুমাত্র আমদানিনির্ভর কয়লার ওপর নির্ভর করে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা ঠিক হবে না।
এ ব্যাপারে এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার ম্যাগাজিন সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন বলেন, শতভাগ আমদানিনির্ভর হয়ে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে ভবিষ্যতে এসব প্রকল্প সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দেবে। তার মতে, কয়লা আমদানিতে যেকোনো সময় সমস্যা ও সঙ্কট দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশীয় কয়লাকেও বিকল্প হিসেবে রাখতে হবে। এ জন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে ৫০ ভাগ দেশীয় এবং ৫০ ভাগ আমদানিনির্ভর কয়লায়। আর তা করতে হলে দেশীয় কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে।
মোল্লাহ আমজাদ বলেন, কোন পদ্ধতিতে দেশীয় কয়লা উত্তোলন হবে এ সম্পর্কিত একটি কমিটির আমি সদস্য। আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ রেখেছি দ্রুত বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হোক। এছাড়া ফুলবাড়িয়া থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের যে প্রস্তাব রয়েছে সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হোক। আর খালাশপীড় এবং দীঘিপাড়ার খনি থেকেও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারে সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমাদের এসব প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেখছে বলে মনে হয় না।
জানা যায়, জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায়, খালাসপীর, দীঘিপাড়া ও ফুলবাড়ী এলাকায় কয়লার সন্ধান পাওয়া গেলেও একমাত্র বড়পুকুরিয়া থেকেই কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। তাও নানা প্রতিবন্ধকতা ও দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে এই কয়লা খনিটি চলছে। এই খনি থেকে প্রাক্কলিত মজুদ ৩২৫ মিলিয়ন মেট্রিক টনের বিপরীতে ওপেন কাস্টে ৯০ ভাগ বা ২৯০ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবস্থায় ২৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন বা মাত্র ৭ দশমিক ২ ভাগ কয়লা তোলা যাবে।
বর্তমানে প্রতিদিন বড়পুকুরিয়া থেকে ১২ শ’ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। আর খসড়া জাতীয় কয়লা নীতিমালাটি অনুমোদিত না হওয়ায় দেশের অন্যান্য খনি থেকে কয়লা উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে না। আর সে কারণেই সরকারকে বাইরে থেকে কয়লা আমদানি করে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৫৯ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে ৭টি প্রধান আন্তঃভূপৃষ্ঠীয় কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়। এই ৭টি খনিতে সর্বশেষ পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, কয়লার মজুদের পরিমাণ হচ্ছে ৩ হাজার ৭২০ মিলিয়ন টন।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সম্ভাবনা নয় সঙ্কট বাড়বে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ