Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নদী বাঁচাতে হবে

প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ এনামুল হক খান

বাংলাদেশের প্রধান নদী বলতে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা (ব্রহ্মপুত্র), কর্ণফুলী, তিস্তাকেই বুঝায়। ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ৫৪টি এসেছে ভারত থেকে, আর ৩টি এসেছে মিয়ানমার থেকে। তথ্যমতে, বাংলাদেশে নদ-নদী ও উল্লেখযোগ্য খালের সংখ্যা ছিল ৭০০টির মতো, যা নিয়ে আমরা গর্ব করে এসেছি। এখন আর গর্ব করার মতো অবস্থা নেই। ইতোমধ্যেই অনেক নদ-নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সবগুলোর অস্তিত্বই হুমকির মধ্যে পড়েছে। এমনি অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সব নদ-নদীই নিঃশেষ হবে। নদ-নদী, খাল-বিলের দেশ বাংলাদেশ এই কথাটি যেন আমরা ভুলেই যাচ্ছি। যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৌপথকে আমরা প্রাধান্য দেইনি, দিয়েছি সড়ক পথকে। বিদেশি টাকার সিংহভাগ সড়ক পথে খরচ করেছি। তাই আমাদের এই দুরবস্থা। ক্ষতির পরিমাণকে বাড়িয়ে তুলেছে দেশের ফুডফর ওয়ার্কসের বিনিময়ে যত্রতত্র রাস্তা নির্মাণের বিষয়টি। দীর্ঘ সময় পরিকল্পনাহীনভাবে গ্রাম থেকে গ্রামে, বাড়ি থেকে বাড়িতে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। পানি সরার বা নৌচলাচলের জন্য প্রয়োজন মতো ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ না করায় এমনটি হয়েছে। বর্তমানে এ অবস্থা কমেছে। দেশের নদ-নদীগুলো দুরবস্থায় পড়তে আরো যে কারণটি রয়েছে তাহলো প্রতিবেশী দেশের নির্বিচারে পানি প্রত্যাহার।
আমরা জানি, বাংলাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে ছিল নদী-নালা, খাল-বিল। এগুলোর মধ্যে তলদেশ ভরাট হয়েছে, চর পড়ে এখনো কিছু রয়েছে আধমরা অবস্থায়। এদের রক্ষার পদক্ষেপ না নিয়ে সর্বনাশ করা হয়েছে। ফলে বর্ষাকালে বন্যা নামের দুর্যোগ আসে, মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। কয়েক দিন বৃষ্টি হলেই দেশে বন্যায় রূপ নেয়। গত ক’বছর বন্যা কম হলেও অতীতে বেশি পরিমাণে বন্যা হয়েছে ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৫ এবং ২০০৭ সালে। বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দেশের। বন্যা থেকে রক্ষার জন্য পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। নদ-নদী, খাল-বিলের গভীরতা বৃদ্ধির বিষয়ে শুধু পরিকল্পনা নিলেই চলবে না, বাস্তবায়নে কঠোরতা অবলম্বন দরকার। ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরগুলোর গভীরতা বৃদ্ধির দায়িত্ব দিতে হবে পুকুরের মালিকদের। আর খাল-বিল, নদী-নালার গভীরতা বৃদ্ধির দায়িত্ব হবে সংশ্লিষ্ট দফতরের। কারণ এগুলো হচ্ছে পানির অন্যতম আধার। পানিকে পুরাতন ভূমি নকশা মোতাবেক তার নিজের জায়গায় স্থান করে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের। নির্ধারিত জায়গায় তাকে স্থান দিতে না পারলে সে আমার বাড়িঘর দখল করবে এটাই স্বাভাবিক।
তথ্য মতে, বর্ষাকালে নদী প্রবাহের ৭% দেশের বৃষ্টির পানি, সীমান্তের ওপার থেকে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে আসে ৫১%, গঙ্গার মাধ্যমে আসে ২৮%, মেঘনার মাধ্যমে আসে ১৪%। মোট কথা, বর্ষাকালে পানির ৯৩% আসে সীমান্তের ওপার থেকে। এই পানি নদ-নদীতে ঠাঁই পায় না বলে ফসলের জমি, বাড়িঘরে আঘাত হানে, সবকিছু ভাসিয়ে দেয়। দেশের নদ-নদীর নাব্যতা নেই বলে এমনটা হচ্ছে। আবার এদের সাথে যুক্ত হয়েছে নাব্যতা হারানো শত শত খাল-বিল। এই খাল-বিলগুলো ভরাট হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, হাকালুকি হাওর, চলনবিলের মতো অসংখ্য বিল আমরা অযতœ-অবহেলায় নিঃশেষ করতে চলেছি। এ বিল দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করছি। হাওর, বাঁওড়গুলো প্রকৃতির সৃষ্টি। প্রকৃতিকে বাধা দেয়া অন্যায়। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রকৃতি অন্যায়ের শোধ নিচ্ছে। এর সাথে আরো যে বিষয়টি যুক্ত হচ্ছে নির্বিচারে পাহাড় টিলা কর্তন, গাছপালা নিধন। ফলে দেশের ওপর পড়ছে পরিবেশের বিরূপ প্রভাব। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সবার সচেতনতা বৃদ্ধি, আর দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বন্যা থেকে রক্ষায় নিতে হবে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ।
এই পদক্ষেপের অন্যতম হচ্ছে নদ-নদীর গভীরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নকশা মোতাবেক দুই তীর উঁচু করে বেঁধে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা। যাদের বসতবাড়ি, জায়গা-জমি ভেঙে নদীতে বিলীন হয়েছে তা তাদের ফিরিয়ে দেয়া। নদীর দেশ বাংলাদেশে নৌপথকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। কারণ নৌপথ, সড়ক পথের চেয়ে অনেক আরামদায়ক। মালামাল পরিবহন ও ভ্রমণে খরচ অনেক কম, এ কথা আন্তর্জাতিকভাবে সত্য। দেশকে মরুভূমির হাত থেকে রক্ষায় নৌপথের উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিগত দিনে নৌপথকে অবহেলা করেছি বলে নদীতে চর পড়েছে, ভরাট হয়েছে, নদী আজ খালে পরিণত হওয়ার উপক্রম। ফলে প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হওয়ার পথে। গ্রীষ্মকালে ২-৪টা নদী ছাড়া সবই প্রায় শুকিয়ে যায়। মাছ থাকার জায়গা কোথায়? পানির অভাবে দেশের মানুষ? আরো একটি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তাহলো ইরিগেশনে পর্যাপ্ত পানি না পাওয়া। গ্রীষ্মকালে নদীতে পানি না থাকা মানে খাল-বিলে পানি না থাকা। ফলে এর প্রভাব পড়ে পরিবেশে। তাই দেশকে রক্ষা করতে হলে নৌপথকে রক্ষা করা প্রয়োজন। লঞ্চ, স্টিমার সার্ভিস চালু করা প্রয়োজন। মালামাল পরিবহনে সাশ্রয়ী পথটিকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। তবেই হবে নদ-নদীর সংস্কার কাজটি সহজতর। দেশের প্রাচীন নগর, বন্দর, ব্যবসা কেন্দ্রগুলো সেভাবেই গড়ে উঠেছে। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত নগরগুলো হয়তো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এদের নৌবন্দরের সাথে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। আরো যে কাজটি দরকার তাহলো নদীকে বিজ্ঞানভিত্তিক শাসন। নদীর গভীরতা বৃদ্ধির কাজটি গুরুত্বের সাথে হাতে নেয়া। এ কাজটি বর্ষার ¯্রােতে করা সহজ। দেশে যে স্বল্প সংখ্যক ড্রেজার রয়েছে এগুলোর মাধ্যমে অব্যাহত ড্রেজিং কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। বর্ষাকালে নদীর তলানী পানির ¯্রােতের মধ্যে ঘেঁটে দিতে হবে, যাতে তলানী সহজে চলে যায়। প্রথমে এই কাজটি পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মতো মূল নদীগুলোতে শুরু করতে হবে। পরবর্তীতে অন্যান্য নদীতে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ড্রেজার সংগ্রহ দরকার হবে।
শুধু নদী ড্রেজিং করলেই সমস্যা সমাধান হবে না, দেশের খাল-বিলগুলো খননের কাজটিও জরুরি। কারণ দেশে পানি আসে পানি যায় এই গতানুগতিক ধারার পরিবর্তন দরকার। দেশের স্বার্থে খাল-বিল, নদী-নালার সার্ফেস ওয়াটারকে পরিকল্পিত ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া দরকার। তৈরি করতে হবে প্রয়োজন অনুযায়ী স্লুইস গেট, রাবার ডেম। আরো যে কাজটি করা প্রয়োজন তাহলো নদীর বাঁক কেটে সোজা করা। এতে পানির প্রবাহে বাধা হ্রাস পাবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমবে, নদীতে পানি থাকবে। তবেই দেশে মৎস্য সম্পদ বাড়বে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, জীব-জন্তুর মহামারীর প্রকোপ কমবে। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হবে, বেকারত্ব হ্রাস পাবে, দেশে ফসল উৎপাদন বাড়বে। ইরিগেশনের জন্য পানি প্রাপ্তি সহজ হবে। বন্যার আক্রমণ থেকে রক্ষা মিলবে, দেশ অর্থনৈতিকভাবে সুদৃঢ় হবে।
লেখক : প্রকৌশলী, বিশিষ্ট সংগঠক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী বাঁচাতে হবে

১১ অক্টোবর, ২০২১
আরও পড়ুন