Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভোট ডাকাতি করে হারানো হয়েছে

সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভোট ডাকাতি করে বিএনপিকে হারানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত নির্বাচন উল্লেখ করে তিনি অবিলম্বে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। গতকাল (সোমবার) সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা এই নির্বাচন যেটা নজিরবিহীন সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং ভোট ডাকাতি বলা যেতে পারে, এই ভোট ডাকাতির ফলে আমরা এই নির্বাচনের ফলাফলকে পুরোপুরি প্রত্যাখান করেছি। আমরা মনে করি, এই কলঙ্কজনক নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় অনুষ্ঠিত করতে হবে এবং এটা অনতিবিলম্বে করতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই নির্বাচনে শুধু আওয়ামী লীগই নয়, পুরো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিএনপিকে লড়তে হয়েছে। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী সকলের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। নজিরবিহীনভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচন করেছে সরকার। অতীতে কোন নির্বাচনে এধরণের ঘটনা দেখা যায়নি। একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে, তিন-চার দিন আগে থেকে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। ভোটের মাধ্যমে এই নির্বাচনের ফলাফল হয়নি। পূর্ব নির্ধারিত ফলাফলের প্রতিফল হয়েছে এখানে। এই ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। ৩০ ডিসেম্বর শুধু তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তাই আমরা এ নির্বাচনের ফলাফল সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে এই নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার পুনঃনির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয় বলেছেন সেক্ষেত্রে আপনারা কিভাবে এগুবেন প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার সবচাইতে পক্ষপাতদুষ্ট একজন ব্যক্তি এবং আপনারা জানেন যে, প্রথম থেকে তার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে আসছিলাম। তিনি একজন দলীয় ব্যক্তি, তার সমস্ত কার্যকলাপ ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। উনি যেভাবে কথা বলেন তাতে সম্পূর্ণভাবে সরকার যে কথা বলতে চায় তার প্রতিধ্বনি করেন। সে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। তবে কিভাবে বিএনপি এগুবে তার ‘সময়মত’ জানাবেন বলে জানান তিনি।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে রোববার। এই নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য এজন্য যে, এই নির্বাচনে যে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে না পারে সেজন্য নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই ভৌতিক মামলা, গায়েবি মামলা করা হয়েছে। প্রত্যেকটা আসনভিত্তিক মামলা করা হয়েছে। সেই মামলা ধরে ধরে নেতাকর্মীদের নির্বাচনের দিন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেই মামলায় বিরোধী দলকে আটকানোর জন্য গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়েছে। সারা দেশে সরকার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুরু করে। এর মাধ্যমে গোটা দেশে ভীতির পরিবেশ তৈরি করে। এমন নির্বাচন অতীতে আর কখনো হয়নি এ দেশে। এমনকি সারা দেশে টার্গেট করে এজেন্টদের আটক করা হয়েছে। নির্বাচনের আগের দিন সন্ধ্যা থেকে জাল ভোট দিয়ে কারচুপি করা হয়েছে। এর সাথে র‌্যাব-পুলিশ সহায়তা করেছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ভোটের আগের রাতে কেন্দ্রগুলোতে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সহায়তায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের লোকজন সিল মেরেছে। যার প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। যে কেউ চাইলে আমরা তা দেখাতে পারি। প্রিজাইডিং অফিসাররা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। শুধু আগের রাতেই নয়, ভোটের দিন সকালেও কেন্দ্র দখল করেছে সরকার দলীয় লোকেরা। কোন কোন কেন্দ্রে ১১টা পর্যন্ত পরিবেশ ভাল থাকলেও ১১টার পর পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল সরকার দলীয়দের হাতে। সব কেন্দ্র থেকে বিএনপির প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়। ভোটারদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি। বরং তারা সব সময় বিরোধী দলকে তাড়ানোর কাজে নিয়োজিত ছিল। অনেক জায়গায় তারা আমাদের নেতাকর্মীদের গুলি করেছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত ছিলো সেই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলো। অর্থাৎ আমরা যেটা বলে আসছি যে দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক যে সংস্কৃতি আছে সেই সংস্কৃতিতে এখানে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট আসেনি আমি কি করবো? প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এমন বক্তব্যের বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, উনি (সিইসি) বলেছেন, এজেন্ট না আসলে আমি কি করব? আরে এজেন্ট না আসতে দিলে আমরা (বিএনপি) কী করবো। এজেন্টকে তো আপনারা আসতে দেননি। এই সরকার তার রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ও নির্বাচন কমিশনের যোগসাজসে আমাদের এজেন্টদেরকে কেন্দ্রে যেতেই দেননি। যেখানে যেখানে গেছেন সেখানে যেমন আমার নির্বাচনী এলাকায় একশ ভাগ এজেন্ট ছিলো কিন্তু তাদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে। আমাদের দলের নেতা গয়েশ্বর বাবুর (ঢাকা-৩) ওখানে একশ ভাগ এজেন্ট ছিলো, তাদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে। আমাদের নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাহেবের নির্বাচনী এলাকায় এজেন্ট ছিলো তাদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে। এভাবে স্টাফিং করা হয়েছে। এজেন্টদের বিরুদ্ধে আগে থেকে মামলা দিয়ে রেখেছে, অনেকে গ্রেপ্তার করেছে এবং নির্বাচন এজেন্টদের মনোনীত করবার যে কাগজটা প্রার্থী দেবে সেই কাগটাকে ওরা ছিঁড়ে ফেলেছে বহু জায়গায়। তিনি আরো বলেন, এ নির্বাচনে আগেই পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছে। এ নির্বাচনে ভোট কারচুপির বিষয়টি আগে থেকেই ছিল সুপরিকল্পিত। ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে ভোটের আগের রাতে। এ নির্বাচনে জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এ নির্বাচনে ভীতি ছাড়া কিছু ছিল না।
নির্বাচনে কোন বিদেশী পর্যবেক্ষক ছিল না মন্তব্য করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, এ নির্বাচনে কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষক ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকদের আসতে দেওয়া হয়নি। আর ইইউ তাদের কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। যারা এসেছে তারা সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত ‘স্পন্সরড’। সরকার নিজের টাকায় তাদের নিয়ে এসেছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে ফখরুল বলেন, আমরা জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি জুলুম নির্যাতন সত্তে¡ও। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের যে ৭জন বিজয়ী হয়েছেন তারা শপথ নেবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তো এ নির্বাচনের ফলাফলই প্রত্যাখ্যান করছি। যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা কিভাবে নির্বাচিত হলেন জানতে চাইলে বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, এটা নির্বাচন কমিশনকে জিজ্ঞেস করুন, তারা কিভাবে এই কয়জনকে বিজয়ী করলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা অবিলম্বে তাদের মুক্তির দাবি করছি।’ তিনি আরো বলেন, আমরা দাবি আদায়ে আইনি ও আন্দোলনের দুটোই চেষ্টা চালিয়ে যাব। আমাদের আন্দোলনের কর্মসূচি থাকবে। দল ও জোটের সাথে আলোচনা করে সেটি জানিয়ে দেওয়া হবে।
ভোটের পর বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীনরা সহিংসতা চালাচ্ছে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনের আগে সহিংসতা হয়েছে, নির্বাচনের দিন হয়েছে। এখন ভোটের পরে পরেই শুরু হয়েছে সহিংসতা। বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আক্রমণ চালানো হচ্ছে, নেতাকর্মীদের বাড়িতে আক্রমণ চালানো হচ্ছে, তাদের সমর্থকদের আক্রমণ চালানো হচ্ছে এবং বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। যেমন আমার নিজের নির্বাচনী এলাকায় বেগুন বাড়ি ইউনিয়নের দানারহাট কেন্দ্রে আমার নেতাকর্মী-সমর্থকদের বাড়ি পুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, ভেঙে ফেলা হচ্ছে। নির্বাচনের দিন ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ কেন্দ্রে আমার প্রধান এজেন্টের বাড়িতে আক্রমণ করে ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমার স্ত্রীকে ঘটনাস্থলে যেতে দেয়া হয়নি। আমি নিজে গিয়ে ওই কেন্দ্রে দেখেছি ৪/৫ টা বুথে কোনো এজেন্ট নেই। ভয়ভীতি তৈরি করা হয়েছে যাতে কেউ না আসে। এটা শুধু উদাহরণ দেয়ার জন্য বললাম, সারাদেশেই এই একইরকম চিত্র ছিল।
এসময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সংবাদ সম্মেলনের পর ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে হয় এতে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য নজরুল ইসলাম খান। বৈঠকে এলপডিপির সভাপতি কর্ণেল (অব.) অলি আহমেদ ছাড়া জামায়াতসহ বিভিন্ন শরিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।#



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ