Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

তরুণদের হাতে তুলে দিচ্ছে মাদক আর অস্ত্র

প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ হাফিজুর রহমান মিন্টু, নারায়ণগঞ্জ থেকে : আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের ছত্রছায়ায় শিল্প-বাণিজ্য ও বন্দর নগরী নারায়ণগঞ্জে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে কক্সবাজার ও কুমিল্লার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মাফিয়া চক্রের ডনেরা। এরা মাদক পাচারে নিত্যনতুন কৌশল ও নিত্যনতুন রুট বদলে কখনো যাত্রীবাহী বাস, মালবাহী ট্রাক, মালবাহী কাভার্ড ভ্যান, নদীপথে বিভিন্ন নৌযানে আবার কখনো নিজেরাই গাড়িতে করে বড় বড় চালান পৌঁছে দিচ্ছে নারায়ণগঞ্জে। সহযোগীদের দিয়ে গড়ে তুলেছে ইয়াবা পাচার ও বিপণনের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। তরুণ যুবকদের আলোর পথ থেকে সরিয়ে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে তাদের মাঝে পৌঁছে দিচ্ছে মরণনেশা। এই মাফিয়া ডনেরা তরুণÑযুবকদের মাঝে শুধু মরণনেশা মাদকদ্রবই তুলে দিচ্ছে না, তুলে দিচ্ছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রও। নেশা করার টাকা না থাকলে খুন-ছিনতাই-রাহাজানি করে যাতে নেশার টাকা জোগাড় করতে পারে। কোথা থেকে কোন পথে কারা এই মরণনেশা ও আগ্নেয়াস্ত্র আমদানি করছে, তা সাধারণ আমজনতা না জানলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইন শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনী জানে। আর সাধারণ আমজনতা জানে এবং চেনে এলাকার ক্রেতা-বিক্রেতা আর খাদকদের। তবে মুখ খুলতে ভয় পায়Ñনা জানি কখন হামলা, উল্টো মিথ্যা মামলা আর অপঘাতে যেন প্রাণ দিতে না হয়। গত ২ মে সোমবার ফতুল্লায় মধ্য ইসদাইর এলাকায় সন্ত্রাসী জামাল প্রধান ও মাসুম প্রধানের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী এলাকার মাদক ব্যবসার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় ফতুল্লার মধ্য ইসদাইর প্রাইমারি স্কুলসংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফতুল্লার মধ্য ইসদাইর প্রাইমারি স্কুলসংলগ্ন এলাকায় মালেক প্রধানের ছেলে জামাল প্রধান এবং মাসুম প্রধান এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই মাদকের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অনেকটা প্রকাশ্যেই মাদকের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় উল্লিখিত মাদক ব্যবসায়ীদের সেল্সম্যানদের প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করাকালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকাবাসী মাদক ব্যবসায় বাধা প্রদান করেন এবং স্কুলের সামনে মাদক ব্যবসা না করার জন্য নিষেধ করেন। এ সংবাদে মাদকের গডফাদার জামাল প্রধান এবং মাসুম প্রধান বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে স্থানীয় এলাকাবাসীকে ধাওয়া করে। একপর্যায়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। বর্তমানে এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে কয়েকটি বড় চালান ধরা পড়লেও গ্রেফতারকৃতরা কেউ বহনকারী আবার কেউবা বিপণনের দায়িত্বে রয়েছে। তবে রহস্যজনক কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে শীর্ষ পাচারকারী মাফিয়া চক্রের ডনেরা। মাদকদ্রব্য বহনকারী ও ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্বে থাকা বেশিরভাগই কক্সবাজার ও কুমিল্লার অধিবাসী। যারা নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, সিদ্ধিরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছে সর্বনাশা ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকের কারবার। আর এদের রক্ষাকবজ হিসাবে দায়িত্ব পালন করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু অসাধু অর্থলোভী ব্যক্তি ও সরকারদলীয় ক্যাডার।
জানা গেছে, ১৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড ও জালকুড়ি এলাকা থেকে ৬৬ হাজার ৮শ ইয়াবাসহ ৩ পাচারকারীকে গ্রেফতার করে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ। যার মধ্যে বহনকারী ফোরকানউদ্দিন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকার বাসিন্দা। সে টেকনাফের বাসিন্দা শাহজাহান ও হারুনের কাছে ইয়াবার এই চালানটি পৌঁছে দিতে এসেছিল। শাহজাহান ও হারুন সিদ্ধিরগঞ্জর জালকুড়ি এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে ইয়াবা ডিষ্ট্রিবিউশনের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল। তারা মূলত কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে বিভিন্ন পন্থায় নারায়ণগঞ্জ ও এর আশপাশে ইয়াবার চালান আনতো।
গত ১৯ এপ্রিল শহরের জামতলা ধোপাপট্টি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ফতুল্লা থানা পুলিশ ১৪ হাজার পিছ ইয়াবাসহ ২ নারী মাদক ব্যবসায়ী শাপলা বেগম (৩০) ও আমেনা বেগম রিতােেক (২৫) গ্রেফতার করেছে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ফতুল্লা থানার দারোগা নাহিদ আহমেদ ও সহকারী দারোগা কামরুল হাসানের নের্তৃত্বে ধোপাপট্টি এলাকার শফিকুর রহমানের ৩ তলা ভবনের নীচ তলায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ এদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা ৪৭/৫ জামতলা ধোপাপট্টী এলাকার শফিকুল ইসলামের বাড়ীর ভাড়াটিয়া মৃত আমির আলীর কণ্যাদ্বয়। তাদের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর জেলার বলরামপুর গ্রামে। গ্রেফতারকৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে, জব্দকৃত ইয়াবার চালানটি জামতলা এলাকার মাদক ব্যবসায়ী গালকাটা মাসুদের। মূলত সেই এই চালানের মূল মালিক।
২০ ফেব্রুয়ারী সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ডে রিনালয় সিএনজি পাম্পের সামনে থেকে সাড়ে ১৪ হাজার পিছ ইয়াবা, ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৩২ টাকাসহ কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার নিলাবাজার এলাকার ইসমাইল ও কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর জোনায়েদ বাগদাদীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১১। জানা গেছে, ইসমাইল নিয়মিত ভাবে কক্সবাজার হতে ইয়াবা এনে এই এলাকায় ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। মাসে সে প্রায়ই এরকম ৪-৫ বার বড় ধরনের ইয়াবার চালান নিয়ে এসে এখানে তার মাদক ব্যবসা অব্যাহত রেখেছিল। সে মাদানীনগর এলাকার বাপ্পী ট্রেডার্সের মালিক শফিকুল ও গাজী কালু ট্রান্সপোর্টের মালিক পান্নার কাছে ইয়াবা সরবরাহ করতো। পরে ইসমাইলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী শফিকুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল মাদানীনগর এলাকা থেকে শফিকুল ইসলাম ও সহযোগী দেলোয়ারকে ৫০ হাজার পিছ ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব। শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী শফিকুল ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার নবীনগর থানার ইব্রাহিমপুর গ্রামের শুক্কুর মিয়ার ছেলে। সে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে বড় বড় ইয়াবার চালান এনে নারায়ণগঞ্জ ও রাজধানীসহ এর আশপাশের এলাকায় পাইকারী সরবারহ করে আসছে। ইয়াবা ব্যবসার বদৌলতে সে একজন মটর পার্টস বিক্রেতা থেকে কয়েক বছরের ব্যবধানে ২৭টি কাভার্ডভ্যানের মালিক বনে গেছে। শফিকুল ও পান্না মিজমিজি মৌচাক এলাকায় বিভিন্ন বাসা ভাড়া নিয়ে মাদকের আখড়া গড়ে তুলেছে বলেও অভিযোগে জানা গেছে।
চলতি সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী রাতে সোনারগাঁ উপজেলার নয়াবাড়ি এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি কাভার্ডভ্যান থেকে ৫৮ হাজার ৭শ ৭৫ পিছ ইয়াবা, ইয়াবা বিক্রির সাড়ে ১২হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল সহ কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম এলাকার ওলি আহমেদ ও সহযোগী আবদুল জলিলকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১১। আসামীরা জব্দকৃত কাভার্ডভ্যানটির ড্রাইভিং সীটের পিছনে ডান পাশে বিশেষ পদ্ধতিতে লুকিয়ে ইয়াবার এতবড় চালানটি এনেছিল। টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালানটি আসার পথে কুমিল্লায় ভাগাভাগি হয়ে একটি অংশ নারায়ণগঞ্জে আনা হচ্ছিল। গত ১৮ জানুয়ারী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কামতাল এলাকায় বনলতা ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে ট্রাকে তল্লাশী করে ২০ হাজার পিছ ইয়াবা ও মাদক বিক্রির ৯৭ হাজার ৫শ’ টাকাসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১ এর একটি টিম। গ্রেফতারকৃত ৪ জন হলো কক্সবাজার সদর থানার এমদাদুল হকের ছেলে ট্রাক চালক হযরত আলী, মৃত ইসহাক মিয়ার ছেলে মাদক ব্যবসায়ী জলিল, একই জেলার উখিয়া থানার সোবহান মিয়ার ছেলে মোঃ আলী ও মৃত আবুল কাশেমের ছেলে শাহজাহান।
২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি টোলপ্লাজা এলাকায় একটি কাঠ বোঝাই ট্রাকে তল্লাশী চালিয়ে ৯৮ হাজার পিস পিছ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে র‌্যাব-১১। গ্রেফতারকৃতরা হলো কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার উত্তর পুকুরিয়া এলাকার মকবুল আহম্মদের ছেলে ট্রাক চালক ইউসুফ ও একই থানার হরিনমারা এলাকার মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে হেলপার জাফর। তারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে পরিবহনের সঙ্গে জড়িত। তারা প্রায়ই পরিবহনের ছত্রছায়ায় ইয়াবা স্থানান্তর করে আসছিল। র‌্যাব জানায়, কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার হারিশা এলাকার মাহাছুনের ছেলে কবির (৫০) মূলত ইয়াবা ব্যবসায়ী। একই জেলার ও একই থানার মরিচ্চা এলাকার আব্দুল জালালের ছেলে ফরিদুল আলম ওরফে ফরিদ কোম্পানী (৫০) আটককৃত ট্রাকের মালিক। ট্রাকের মালিকের যোগসাজসেই কবির নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় ইয়াবার বড় চালান সরবরাহ করে আসছিল। এদের সঙ্গে আরও দু’ ব্যক্তি জড়িত রয়েছে। গ্রেফতার হওয়ার ১৫ দিন পূর্বে ইউসুফ ও জাফর আরো একটি চালান ঢাকায় পৌছে দেয় বলে জানায় র‌্যাব। ২১ সেপ্টেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৫ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-২-এর সদস্যরা। গ্রেফতার করা হয় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বাসিন্দা শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী মনজুর আলম, সেলিম, মহিউদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, আব্দুল মান্নান ও জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় তাদের কাছ থেকে ইয়াবা ছাড়াও নগদ ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৮ টাকা, একটি প্রাইভেটকার, পাঁচটি পাসপোর্ট ও ৯টি মোবাইল ফোন সেট জব্দ করা হয়েছে। ২৮ আগষ্ট সিদ্ধিরগঞ্জের সাহেবপাড়া এলাকা থেকে ২ হাজার ৪৯০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও ইয়াবা বিক্রির ৩৯ হাজার ৯৭০ টাকাসহ পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার পশ্চিম হাজীপুর এলাকার মোঃ মহিউদ্দিনের ছেলে মাদক ব্যবসায়ী কাউসার আহম্মেদ পান্না, কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার রংগীখানা এলাকার শওকত আলীর ছেলে কামাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম জেলার কোতয়ালী থানার ইকবাল পাথরঘাটা এলাকার মোঃ বাবুল হোসেনের ছেলে আক্তার হোসেন ও ফতুল্লা থানার দেলপাড়া চেয়ারম্যান বাড়ীর মোঃ আউয়ালের ছেলে সেলিমকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে সিদ্ধিরগঞ্জের সাহেবপাড়া এলাকায় খুচরা ও পাইকারীভাবে বিক্রি করে আসছিল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তরুণদের হাতে তুলে দিচ্ছে মাদক আর অস্ত্র
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ