পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শফিউল আলম : চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির হৃৎপি-। আর প্রধান এই সমুদ্র বন্দরেরই প্রাণপ্রবাহ হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। কর্ণফুলী নিছক একটি নদীর নাম নয়, ‘অর্থনৈতিক’ নদী এটি। তবে লুসাই পাহাড় থেকে উৎসারিত সেই খরস্রোতা পাহাড়ি নদী কর্ণফুলী আজ ‘অসুস্থ’। চট্টগ্রামের প্রাণভোমরা কর্ণফুলী নদী রয়েছে চরম সংকটে। বেপরোয়া দখল-বেদখল, দূষণ ও ভরাটে বিপন্ন হয়ে উঠেছে কর্ণফুলী নদী। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর। কর্ণফুলীর মোহনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সীমানায় (পোর্ট লিমিট), আশপাশে ও বাইরে নদীকে গিলে খাচ্ছে প্রায় ২ হাজার অবৈধ বাড়িঘর স্থাপনা। নেপথ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের নামধারী ভূমিদস্যুদের সিন্ডিকেট। অবৈধ স্থাপনাগুলোর সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে উচ্ছেদের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রশাসনের আশ্বাস ও কথিত ‘পরিকল্পনা’।
কর্ণফুলী নদীর উভয় তীরকে ঘিরে চলছে ভরাট ও দখলের প্রতিযোগিতা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমিতে অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে। এ জমির আনুমানিক বাজার মূল্য অন্তত ৩৪০ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ চলাচলের চ্যানেল ঘেঁষে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বিস্তীর্ণ ভূমি বেদখল হয়ে আছে। গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। কর্ণফুলীর উভয় তীরের অবৈধ দখল হওয়া জমি উদ্ধার করে অচিরেই সরকারের আয়ত্তে আনার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে ‘দৃঢ় প্রত্যয়ে’র কথা ব্যক্ত করা হলেও এখন কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ নির্বিকার। অপরিকল্পিত বালি তোলার কারণেও নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চাক্তাই রাজাখালী, চর পাথরঘাটা, সিডিএ মাঠ এলাকার কাছে নতুন চরের জমির দাবিদার সেজে, আবার কেউ নদীর বালি তুলে ডুবোচর ভরাট করে কর্ণফুলী দখলে মেতে উঠেছে। এসব নিয়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ নিত্যনতুন অপরাধমূলক কর্মকা- প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়েছে।
তাছাড়া নদীর উভয় তীরে কমপক্ষে সাড়ে ৫শ ছোট-বড় শিল্প-কারখানা, প্লান্ট, অবৈধ ডক-জেটি-ইয়ার্ড, দেশি-বিদেশি জাহাজ কোস্টার নৌযান ট্রলারের বিষাক্ত বর্জ্য-ময়লা-জঞ্জাল ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে কর্ণফুলী নদী। নৌ-চলাচলের মূল (নেভিগেশনাল) চ্যানেল, বহির্নোঙ্গরসহ সমগ্র বন্দর এলাকায় অব্যাহত দূষণে চলছে শোচনীয় অবস্থা।
ক্রমেই বিষিয়ে উঠেছে কর্ণফুলী নদী। নদীর পানির স্বাভাবিক রঙ, গন্ধ ও স্বাদ আর নেই। ৬০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত চট্টগ্রাম নগরী ও শহরতলীর বিশাল অংশের নগর-বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলীতে। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এ নদীর হাজারো জীববৈচিত্র্য। এককালে হরেক প্রজাতির চিংড়িসহ সুস্বাদু মাছের খনি কর্ণফুলী নদী এখন বলতে গেলে প্রায় মাছশূণ্য হয়ে পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, একসময় কর্ণফুলী নদীতে মিঠা পানির ৬৬ প্রজাতির, মিশ্র পানির ৫৯ প্রজাতির এবং সামুদ্রিক পরিযায়ী ১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো। ভয়াবহ দূষণের কারণে মিঠা পানির অন্তত ২৫ প্রজাতির এবং মিশ্রপানির ১০ প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তপ্রায়। এছাড়া আরও ১০ থেকে ২০ প্রজাতির অর্থকরী মাছ বিপন্ন। ডলফিন-শুশুকসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী হারিয়ে যাওয়ার সম্মুখীন।
কর্ণফুলী নদী গবেষক অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া বলেছেন, দেশের অন্যকোন নদ-নদীর তুলনায় কর্ণফুলীর রয়েছে আলাদা ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান ও কিছু বৈশিষ্ট্য। এসব দিক অটুট রেখে কর্ণফুলী রক্ষার জন্য নদীর তীররেখা চিহ্নিত করা এবং তীর বাঁধানো প্রয়োজন। কর্ণফুলী বাঁচলেই চট্টগ্রাম বন্দর বাঁচবে। নদীর উভয় তীরে নগরায়নের ধারা, ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও হাজার বছর ধরে মানবসভ্যতা বিকশিত হয়েছে। মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। কাপ্তাইয়ে রয়েছে পানিবিদ্যুৎ মহাপ্রকল্প। নদীটির দুই তীরজুড়ে ৭৫ লাখ মানুষের বাস। বিস্তার লাভ করেছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, মাঝিরঘাট, সদরঘাটসহ বিশাল সওদাগরী পাড়া। সভ্যতার মেলা। প্রকৃতির অপার দান কর্ণফুলী। এ নদীটি মানুষকে সবই দিয়েছে উদারভাবে। কিন্তু সেই নদী দিন দিন ভরা যৌবন হারিয়ে ফেলছে। তাই কর্ণফুলী নদীর সুরক্ষায় সমন্বিতভাবে ও কার্যকর উদ্যোগ সময়ের দাবি।
একদিকে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা গ্রাস করে নিচ্ছে নদীতীরের জমি, পলি ভূমি, সদ্য জেগে ওঠা চর, তলদেশের বালি-মাটি। আর অন্যদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৪টি খাল দিয়ে আবর্জনা নিষ্কাশন, ৫’শ কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও শত শত জাহাজের তেলবর্জ্য বা পোড়াতেল নিঃসরণের কারণে কর্ণফুলী পরিণত হয়েছে অঘোষিত এক ভাগাড়ে। বিষিয়ে উঠছে নদীর পানি। বাড়ছে লবণাক্ততার মাত্রা। এহেন নাজুক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালে হাইকোর্ট কর্তৃক জাতীয় অর্থনীতির প্রাণভোমরা কর্ণফুলী নদী সুরক্ষায় কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়। নদীজুড়ে দখল, মাটি ভরাট ও যেকোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ রাখার জন্য সরকারের প্রতি এবং কর্ণফুলী নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিল করতে জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালক ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি কর্ণফুলী সুরক্ষা সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো আজ অবধি পরিপূরণ করা হয়নি।
কর্ণফুলীর বুক প্রতিনিয়ত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বন্দরের লাইটারেজ জেটির ঘাট ও বার্থিং-মুরিংয়ের পয়েন্টগুলো প্রতিনিয়ত নদীর বুকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ সংকুচিত হয়ে আসছে। নাব্যতা ও গতিপথ রক্ষায় নদীশাসন, নিয়মিত ড্রেজিং ও দুষণরোধ জরুরি হলেও দীর্ঘদিন ধরে তা উপেক্ষিত। বরং জমির দাম বাড়ার সাথে সাথে চলছে ভরাট ও দখলের প্রতিযোগিতা। চওড়ায় ও গভীরতায় নদীটি ছোট হয়ে আসছে। পানি প্রবাহ ও ধারণক্ষমতা হারিয়ে বর্ষায় কাদা-পানির জোয়ারে ডুবে যাচ্ছে বন্দরনগরী এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পাঞ্চল। এককালে বন্দরের কর্মব্যস্ত বন্দর এলাকা ওমর আলী ঘাট, অভয়মিত্র ঘাটে, মনোহরখালী মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও এর আশপাশে চর জেগে নদী ভরাট ও মরা বন্দরে রূপ নিয়ে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। জাপানি সহায়তায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৭ বছর আগে নির্মিত মনোহরখালী মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে এখন আর মাছের ট্রলার-নৌকা ভিড়তে পারে না। বন্দরের মূল ১নং জেটি অতিক্রম করে ক্রমেই পলিবালির আস্তর বিস্তার লাভ করছে।
কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল তথা পাহাড়ি অববাহিকার একটি প্রধান নদী। আসামের লুসাই পাহাড় থেকে ২৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর উৎপত্তি। ভারতে এর বিস্তৃতি খুবই কম। এ নদীর মোহনায় বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর সুবিধা গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম মহানগরীকে অর্ধচন্দ্র আকারে বেষ্টন করে রেখেছে কর্ণফুলী নদী। তীরজুড়ে বিস্তীর্ণ ভূ-সম্পত্তির মালিক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিগত ১/১১ সরকারের আমলে চট্টগ্রাম বন্দর ও বিভিন্ন প্রশাসন কর্তৃক অবৈধ দখলদারদের কঠোরভাবে উচ্ছেদের ফলে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি উদ্ধারে যে সাফল্য আসে তারও কিছু কিছু ফের বেদখল হয়ে গেছে। বন্দরের মূল্যবান জমি হাতছাড়া হয়ে গেছে। জোয়ারে প্লাবিত ভূমি থেকে ৫০ গজ দূর পর্যন্ত পোর্ট লিমিট হিসেবে গণ্য করা হয়। সেখানে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন স্থাপনা নির্মাণ বেআইনি। কিন্তু গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। নদীর গতিপথ বদল ও নদী ভাঙনের সাথে মিল রেখে সঠিক ও নিয়মিতভাবে তীরভূমি রেখা চিহ্নিত করা হয়নি। এর পুরো সুযোগ নিচ্ছে ভূমিগ্রাসী চক্র। আবার অনেকে অনুমোদনের আড়ালে জায়গা বাড়িয়ে অবৈধ কাঠামো বানাচ্ছে। যা কর্ণফুলী নদীর অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে বালু ও মাটি তুলে নদীতীর ভরাট করে প্রকাশ্যে অবৈধ প্লট ব্যবসা চলছে দীর্ঘদিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।