Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দাভুতোগলুর পদত্যাগ এরদোগানের কর্তৃত্বকে জোরদার করবে

প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন বলে বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি দেশের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্টকে তাকে কম চ্যালেঞ্জকারী কাউকে নিয়োগের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর এ ঘটনা প্রভাব ফেলতে পারে। খবর এপি।
ন্যাটো সদস্য তুরস্ক ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের লড়াইয়ে তুরস্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং ইউরোপে অভিবাসী ¯্রােত ঠেকাতেও দেশটি বড় ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু কুর্দিদের সাথে আবার লড়াই শুরু, এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ৬টি বড় ধরনের আত্মঘাতী হামলা এবং অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান নাজুক অবস্থা মিলিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান অশান্তির মধ্যে ২২ মে দাভুতোগলু পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা করেন।
প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ইতিমধ্যেই তুরস্কের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। কিন্তু দাভুতোগলুর পদত্যাগ দেশকে উদার এক নেতা থেকে বঞ্চিত করল। এ ঘটনাকে এরদোগানের সাথে তার সমঝোতার অতীত মতপার্থক্যের ফল হিসেবেই ব্যাপক ভাবে দেখা হচ্ছে। এরদোগান দেশকে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করতে চাইছেন। কিন্তু তার একদা বিশ্বস্ত সহযোগী দাভুতোগলু আড়ালে থাকতে অস্বীকৃতি জানান।
এরদোগান মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তিন দশকের লড়াইয়ে ক্রমেই কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছেন। তিনি তার পাশ্চাত্য বিরোধী কথাবার্তা জোরদার করেছেন। মিত্রদের বিরুদ্ধে তুরস্কের উত্থানকে বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ এনেছেন।
প্রেসিডেন্ট তাকে অপমান করার অভিযোগে লোকজনের বিরুদ্ধে ২ হাজার মামলা করেছেন। পন্ডিত, সাংবাদিকও আইনপ্রণেতাসহ যারা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সমর্থন করে বা তাদের পক্ষে কথা বলে এ রকম যে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি সন্ত্রাসবাদীর সংজ্ঞা সম্প্রসারিত করতে চান যা মানবাধিকার কর্মী ও পশ্চিমা কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন করেছে।
এক দশকের নির্বাচনী বিজয় ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দীর্ঘ অধ্যায় এরদোগানকে শক্তিশালি করেছে। বহু তুর্কির কাছেই তার আবেদনের অংশ শক্তিমান ব্যক্তিত্বের প্রকাশ বলে গণ্য।
২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগের জন্য এরদোগান সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাভুতোগলুকে মনোনীত করেন। তিনি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে একজন সহজ ও অধিকতর কূটনৈতিক অংশীদার উপহার দেন, কিন্তু মিত্ররা তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন।
অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডব্লিউ. রবার্ট পিয়ারসন ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তুরস্কে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্কে তিনি বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন আশা করছেন না, কারণ দাভুতোগলু পররাষ্ট্র বিষয়ে সুস্পষ্ট ভাবে এরদোগানের নেতৃত্ব অনুসরণ করেছেন। আর তাদের মধ্যকার বিরোধ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে।
তবে একটা ঝুঁকি আছে যে রাজনৈতিক গোলযোগ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন সংশয় যোগ করতে পারে এবং একটি বৃহত্তর ঝুঁকি রয়েছে যে তুরস্ক কুর্দিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বেশি ও ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কম মনোযোগ দেবে।
ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জোশ আর্নেস্ট যুক্তরাষ্ট্রের একজন ভালো অংশীদার বলে দাভুতোগলুর প্রশংসা করেন। তবে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না যে তার পদত্যাগ দু’দেশের একসাথে কাজ করার সক্ষমতায় প্রভাব ফেলবে।
এ ঘটনা তুরস্ক-ই ইউ সম্পর্কে বৃহত্তর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। গ্রিস ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে অভিবাসীদের গমন রোধে উচ্চ-পুরস্কার চুক্তির প্রধান আলোচক ছিলেন দাভুতোগলু। ইউরোপীয় নেতারা তুরস্কের ভবিষ্যত মনোভাব মূল্যায়নে আগ্রহী হবেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থার দিকে তুরস্ককে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার করার চেষ্টা করবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এরদোগান মন্ত্রীসভার বৈঠকগুলোতে সভাপতিত্ব করার মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যেই প্রচলিত প্রেসিডেন্সিয়াল ম্যান্ডেট অতিক্রম করেছেন।
ওয়াশিংটনে মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটে তুরস্ক অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক গোনাল টোল বলেন, এ ঘটনা এরদোগানের ক্ষমতা সংহত এবং তার কর্তৃত্ববাদী কর্মসূচিকে আরো জোরদার করবে।
দাভুতোগলুর উত্তরসুরি প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন এরদোগানের অনুগত পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রী বাইনালি ইলদ্রিম ও বিচার মন্ত্রী বাকির বোজদাগ, এরদোগানের জামাতা জ্বালানিমন্ত্রী বেরাট আলবেরাক। ২২ মে দলের এক জরুরি সম্মেলনে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (এ কে পি) নয়া নেতা মনোনীত করা হবে যিনি পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন।
এরদোগান অতীতে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করতে কোনো দ্বিধা প্রদর্শন করেননি। তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ছিলেন দলের দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল এবং সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী বুলেন্ট আরিঙ্ক।
ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে শীর্ষ তুরস্ক বিশ্লেষক রবার্ট ও’ডালি বলেন, সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যাতে প্রেসিডেন্টকে দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকার কথা বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট এরদোগান দলের ভিতরে ও বাইরে অপ্রতিহত জনসমর্থন নিয়ে শাসক দল একেপির কার্যত নেতা হিসেবে রয়েছেন।
দাভুতোগলু পদত্যাগের কথা ঘোষণার পাশাপাশি এরদোগানের সাথে তার বিরোধের মাত্রা হ্রাস করে প্রদর্শনের লক্ষ্যে বলেন, তিনি এ কে পি-র একজন আইন প্রণেতা হিসেবে তার লড়াই অব্যাহত রাখবেন। তিনি প্রেসিডেন্টের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন।
এদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বুধবার দাভুতোগলু পদত্যাগ করতে পারেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর ডলারের বিপরীতে তুর্কি মুদ্রা লিরার মান ৪ শতাংশ হ্রাস পায়। বৃহস্পতিবার সে ক্ষতির কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।
কিছু পর্যবেক্ষকের আশংকা যে প্রধানমন্ত্রী পদে পরিবর্তন অর্থনীতির ক্ষতি করতে পারে। ও’ডালি বলেন, উদ্বেগের অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে অর্থনৈতিক নীতি পদ। বর্তমানে এ পদে রয়েছেন এরদোগানের চেয়ে দাভুতোগলুর ঘনিষ্ঠ উপ প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ সাইমেস্ক।
তুরস্কের দক্ষিণপূর্বে কুর্দি জঙ্গিদের সাথে লড়াই নিয়ে এরদোগান ও দাভুতোগলুর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। দাভুতোগলু কুর্দি বিদ্রোহীদের সাথে শান্তি আলোচনা শুরুর সম্ভাবনার কথা বলার পর এরেদোগান তার নিন্দা করেন।
দাভতোগলু গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে সাংবাদিক এবং কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে)-র বিদ্রোহীদের সমর্থনের জন্য অভিযুক্ত শিক্ষাবিদদের বিচার পূর্ব আটকের বিরোধিতা করায় এ ব্যবধান আরো বৃদ্ধি পায়। এরদোগান এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করেন ও বলেন যে চরমপন্থীদের সমর্থক যে কারোরই নাগরিকত্ব বাতিল করা উচিত।
তবে দাভুতোগলুর বর্তমান অবস্থার মূল কারণ হল একটি শক্তিশালি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির প্রতি তার ইষদুষ্ণ সমর্থন।
পেলিক্যান ব্রিফ নামে একটি অজ্ঞাত পরিচয় তুর্কি ব্লগ যাতে এরদোগানের ঘনিষ্ঠ লোকরা লেখালেখি করেন বলে মনে করা হয়, সেখানে দাভুতোগলুর ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট শিবিরের হতাশার কথা বলা হয়েছে।
পদত্যাগের কথা ঘোষণা করে দাভুতোগলু জোর দিয়ে বলেন, তিনি কখনো তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। তিনি স্মরণ করেন যে এরদোগান যখন ২০১৪ সালে তার কাছে দলের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন তখন বলেছিলেনÑএটা হচ্ছে শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট ও শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রীর যুগ। দাভুতোগলু বলেন, এটা ছিল সঠিক কথা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দাভুতোগলুর পদত্যাগ এরদোগানের কর্তৃত্বকে জোরদার করবে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ