Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিজামীর মৃত্যুদন্ড বহাল

জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে : এটর্নি জেনারেল, কালো আইনে বিচার : খন্দকার মাহবুব

প্রকাশের সময় : ৬ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:১৭ পিএম, ৫ মে, ২০১৬

মালেক মল্লিক : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর করা রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করেছেন আপিল বিভাগ। ফলে তাঁর মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রইল। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এই রায়ের মধ্য দিয়ে নিজামীর এ মামলার সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলো। বাকি থাকল প্রেসিডেন্টের কাছে নিজামীর প্রাণভিক্ষার বিষয়টি। এদিকে রায়ের পর হরতাল ডেকেছে জামায়াত। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৪ সদস্যের বেঞ্চ এজলাসে বসেন। এরপর এক শব্দের এ রায় ঘোষণা করেন। প্রধান বিচারপতি শুধু বলেন, “ডিসমিসড”। রায় ঘোষণার সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির ও মুরাদ রেজা। অন্যদিকে আসামি পক্ষে ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান। এছাড়া মিডিয়ার শতাধিক সংবাদকর্মী নিজামীর রায়ের খবর সংগ্রহের জন্য আদালতের এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। নিজামীর মামলাটি রিভিউ রায় ঘোষণার জন্য কার্যতালিকায় ১(এ) নম্বরে ছিল। এর আগে একই বেঞ্চে গত মঙ্গলবার নিজামীর রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের ওপর উভয় পক্ষে যুক্তিতর্ক শেষ হয়। পরে আপিল বিভাগ আদেশের জন্য ৫ মে তারিখ ধার্য করেন।
রায় ঘোষণার পর আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, নিজামীর ফাঁসির রায় সর্বোচ্চ আদালত বহাল রাখায় শহীদদের আত্মা একটু হলেও শান্তি পেয়েছে। এ রায়ে আজ আমরা কিছুটা হলেও ভারমুক্ত। রিভিউ রায় ঘোষণা পর এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, সর্বোচ্চ শাস্তিই ছিল নিজামীর প্রাপ্য। এই রায়ে দেশবাসীর মতো আমরাও আনন্দিত। অন্যদিকে আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, আমার কিছু বলার নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ আইনে বিচার কতটা সঠিক হয়েছে, তা নিরূপণ করবে। কালো আইনে বিশেষ উদ্দেশ্যে এই বিচার। রায়কে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্টের ভেতর ও বাইরে কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের মূল প্রবেশদ্বারসহ অন্য প্রবেশ দ্বারগুলোতে সুপ্রিম কোর্টে আগতদের চেক করে ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। এ ছাড়া এজলাসে ঢোকার সময় সাংবাদিকসহ অন্যদের আইডি কার্ড প্রদর্শন করে ভেতরে প্রবেশ করানো হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য
রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে মতিউর রহমান নিজামীর রায়ের মধ্য দিয়ে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। আলবদর ও আলশামস বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিজামী ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যায় সহযোগী হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিজয়ের অন্তিম মুহূর্তে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছেন। তাই সর্বোচ্চ শাস্তিই ছিল নিজামীর প্রাপ্য।  মাহবুবে আলম বলেন, রিভিউর পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে। কারা কর্তৃপক্ষ এটি নিজামীকে পড়ে শোনাবে। এর পর তিনি যদি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন, তাহলে শুধু একটি সুযোগই বাকি থাকবে। তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি বের না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রকাশ হওয়ার পর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে কবে রায় কার্যকর হবে।
আসামি পক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য
নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, যে আইনে নিজামীর বিচার হচ্ছে, সেটি ছিল কালো আইন। ১৯৭২ সালে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর জন্য এ আইন তৈরি করা হয়েছিল। পরে এ আইনকে বেসামরিক লোকদের জন্য এনে নিজামীকে তার আওতায় বিচার করা হয়েছে। সে অনুযায়ী আদালত রায় দিয়েছেন। তাই এ নিয়ে কিছু বলার নেই। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট ওই আইন অনুযায়ী রায় দিয়েছেন, বিচার করেছেন। তাই আমাদের বলার কিছু নাই। তবে আমি বলে যাচ্ছি, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ আইনে বিচার কতটা সঠিক হয়েছে, তা নিরূপণ করবে। তখন হয়তো দেখা যাবে, যেভাবে এ আইনে বিচার করা হয়েছে, তা সঠিক হয়নি। মানবতাবিরোধী অপরাধে একের পর এক ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। এটিও বিশেষ উদ্দেশ্যে দেয়া হচ্ছে। কেননা, ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের দেয়া বানানো ও শেখানো সাক্ষীর ভিত্তিতে এ বিচার করা হচ্ছে। আদালত এখানে অসহায়। তিনি বলেন, প্রাণভিক্ষা চাওয়া নিজামীর নিজস্ব ব্যাপার। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর তিনি নিজেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
যে তিন অভিযোগে মৃত্যুদন্ড
অভিযোগ-২: একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে ১৪ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।
অভিযোগ-৬: নিজামীর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে যায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। তারা গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে।
অভিযোগ-১৬: মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।
ট্রাইব্যুনালের রায়
প্রসিকিউশনের আনা ১৬ অভিযোগের মধ্যে আটটিতে নিজামীকে দোষী সাব্যস্ত করে বাকিগুলোতে খালাস দেয়া হয়। এর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর ঘটনায় নিজামীর ফাঁসির রায় আসে। ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে জামায়াত আমিরকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদ-।
আপিল বিভাগের রায়
২, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে হত্যা, ধর্ষণ ও বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল থাকে। যাবজ্জীবন কারাদ-ের সাজা বহাল রাখা হয় ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে।  ১, ৩  ও ৪ নম্বর অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দেয় আপিল বিভাগ।
বিচারের প্রক্রিয়া
২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করার পর একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ২৮ মে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ২৬ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। নিজামীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন। বিচার শেষে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল যে রায় দেয় তাতে প্রসিকিউশনের আনা ১৬ অভিযোগের মধ্যে আটটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এই আট অভিযোগের মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর ঘটনায় নিজামীর ফাঁসির রায় হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর আপিল করেন নিজামী। নিজামীর করা আপিলে ১৬৮টি যুক্তি তুলে ধরে সাজার আদেশ বাতিল করে খালাস চাওয়া হয়। এই আপিলের ওপর ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শুনানি শুরু হয় চলে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। দ্বাদশ দিনে শুনানি নিয়ে ৮ ডিসেম্বর আদালত রায়ের দিন ঠিক করে দেয়। ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি আপিল বিভাগেও ফাঁসির রায় বহাল থাকে। ১৫ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। পরদিন তা নিজামীকে পড়ে শোনানো হয়। ২৯ মার্চ নিজামী রিভিউ আবেদন করলে ৩ মে শুনানি হয়। গতকাল রিভিউ খারিজ করে আপিল বিভাগ।
পরের ধাপ প্রাণভিক্ষা
দন্ড কার্যকরের আগে যুদ্ধাপরাধী নিজামীর শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়েছে। এখন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে শেষ সুযোগে দন্ডাদেশ পাওয়া আসামি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। আসামি তা না চাইলে বা প্রেসিডেন্টের ক্ষমা না পেলে সরকার দিনক্ষণ ঠিক করে কারা কর্তৃপক্ষকে ফাঁসি কার্যকরের নির্দেশ দেবে। তার আগে স্বজনেরা কারাগারে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারবেন।
২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে। আর ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ।  তাদের দু’জনের রিভিউ আবেদন একদিনের মধ্যে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারা প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা চাননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় জানানো হয়, পরে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এরপর জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয় একই দিনে, গতবছর ২১ নভেম্বর। তারা প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেও প্রেসিডেন্ট তা নাকচ করে দেন বলে সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এর বাইরে যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামিদের মধ্যে কেবল জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় এসেছে আপিল বিভাগে। ট্রাইব্যুনালে তাকে দেয়া সর্বোচ্চ সাজার রায় কমিয়ে আপিল বিভাগ আমৃত্যু কারাদন্ডর যে রায় দিয়েছে, তার রিভিউ চেয়েছে দুই পক্ষই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিজামীর মৃত্যুদন্ড বহাল
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ