Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার সবুজ

প্রকাশের সময় : ৫ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফারাহ নাজ কাদের

হায়! ঢাকার সবুজ শ্যামলিমা আজ কোথায়? কোথায় তার সৌন্দর্য? এক সময় কেমন অপরূপই না ছিল ঢাকার রূপ। কয়েক বছর আগেও আমাদের প্রিয় এই ঢাকা শহর ছিল সবুজে সুশোভিত। পার্কে, সড়কের পাশে ছিল সারিবদ্ধ গাছ। অফিসগুলো ছিল ফুলগাছে শোভিত এবং বাড়িতে ছিল বাগান। আজ ২০১৬ সালে শহরে দেখছি প্রশংসনীয় সব স্থাপত্যশৈলী। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসনের জন্য নির্মিত সুউচ্চ ভবন এবং দৃষ্টিনন্দন বাণিজ্যিক টাওয়ারগুলোর সঙ্গে অতীতের সতেজ সবুজের সহাবস্থান যদি ধরে রাখা যেত তাহলে কি সুন্দর সমাহারই না হতো!
এই লক্ষ্য অর্জন কি একেবারেই অসম্ভব? পৃথিবীতে এমন অনেক উদাহরণই রয়েছে। নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের মতো অনেক উদাহরণই পৃথিবীর সামনে রয়েছে। এমনকি দুবাইয়ের মতো মরুভূমিকেও বিস্ময়করভাবে আকাশছোঁয়া ভবন নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম একটি বড় সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে এবং গোটা শহরটি বাগানে পরিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। এর ফলে মরুশহরটির বিস্ময়কর রূপান্তর ঘটেছে। আর পুরস্কার বিজয়ী সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তো ইনডোর গার্ডেনের এক অনুপম আধার এবং গোটা শহরটি বিভিন্ন জাতের অর্কিড আর বাগানে পরিপূর্ণ।
তাহলে স্থাপত্যশৈলীর অগ্রগতির পাশাপাশি ঢাকার সবুজ শ্যামলিমা কেন টিকিয়ে রাখা যাবে না? নির্বিচার বৃক্ষ নিধনের বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যে ঢাকায় অনুভূত হওয়া শুরু হয়েছে। নগরবাসীকে রেকর্ড ভঙ্গকারী উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে হচ্ছে। গবেষকদের মতে, ঢাকা শহরের তাপমাত্রা গড়ে ৪ ডিগ্রি বেড়েছে। এতে নগরবাসীকে মারাত্মক ধকল পোহাতে হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের অসহনীয় তাপপ্রবাহে পুড়তে হচ্ছে। এটা কেবল ঢাকার নাগরিকদের জন্যই দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে না, এমনকি আমাদের ইকোসিস্টেমের অংশ পাখ-পাখালী ও জীবজন্তুকেও তীব্র তাপপ্রবাহের ধকল সহ্য করতে হচ্ছে। এই অসহনীয় তাপমাত্রার পেছনের কারণ কি? এটা বিষুবীয় ঘটনাবলীরই ফলাফল। নিরক্ষরেখার ওপর সূর্যের সরাসরি অবস্থানের কারণে এটা ঘটছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের অনেকেই বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব সম্পর্কে অবগত। এখন এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মূল কারণ কি হতে পারে? কারণ হচ্ছে, মূল বিষয়টি সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। প্রতিদিনই বায়ুম-লে কার্বন-ডাইঅক্সাইড বাড়ছে এবং বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে। আমরা আমাদের জীবনরক্ষাকারী সম্পদ ধ্বংস করে ফেলছি। নগরায়নের নামে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে চলছি। এটা কি কোনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারে? অথচ সূর্যের প্রখর তাপ থেকে রক্ষায় গাছ আমাদের ছায়া দেয়। পরিবেশকে শীতল রাখতে সাহায্য করে। শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
নগর ভা-ারের সম্পদ বৃক্ষরাজি নিধন সম্পর্কে নগরবাসী হিসেবে আমরা বিনয়ের সঙ্গে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, পাঁচ শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই শহরের বারিধারা, গুলশান-১, পূর্বাচল ও অন্যান্য এলাকায় একের পর এক বৃক্ষ নিধন হচ্ছেই। বৃক্ষ নিধন বন্ধ করা এবং ইতোমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে আরো অনেক গাছ লাগানো শুরু করতে একটি আবেদন ঢাকার মেয়রদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। যেসব এলাকায় গাছ কাটা হয়েছে সেখানে প্রতিটি গাছের জন্য তিনটি করে গাছ লাগানোর জন্য আমরা সরকার এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে আন্তরিক অনুরোধ জানাচ্ছি।
বৃক্ষরাজি বোবা-বধির সন্তানদের মতো। তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করে না বরং তারা অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং বায়ুম-লে ক্ষতিকর কার্বন-ডাইঅক্সাইড হ্রাস করে। এভাবে তারা উষ্ণতা কমায় এবং পৃথিবীকে স্বল্প তাপমাত্রায় রাখে। ঢাকা গত ২০ বছর আগেও কখনো এ ধরনের তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হয়নি। আগে প্রচুর গাছপালা ছিল। যানবাহনের সংখ্যা কম ছিল এবং জনসংখ্যাও ছিল কম। বায়ুম-লে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে দ্রুত নগরায়ন। যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে। এ অবস্থায় আমরা সবাই এখন হিটস্ট্রোকের মতো নতুন এক উপসর্গের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। মানবদেহ যখন অতিরিক্ত মাত্রার তাপ সহ্য করতে পারে না তখন হিটস্ট্রোকের আক্রমণ ঘটে। এ অবস্থায় জরুরি চিকিৎসা দরকার। হিটস্ট্রোকের চিকিৎসা না হলে এতে দ্রুত মস্তিস্ক, হৃৎপি-, কিডনি ও মাংসপেশীর ক্ষতি হতে পারে। চিকিৎসায় যত বিলম্ব হবে ক্ষতি তত বেশি হবে এবং মারাত্মক জটিলতার ঝুঁকি বাড়বে এমনকি মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে।
এটা মনে রাখতে হবে যে, সবাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বসবাস করার মতো ভাগ্যবান নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অসহনীয় তাপের যন্ত্রণা সহ্য করছে। অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে দুর্ভোগের শিকার মানুষের সংখ্যা কেবলই বাড়বে।
তাপের বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়া বৃক্ষ ওষুধ তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাম্প্রতিক সময়ে ওধুধের দাম অনেক ব্যয়বহুল হয়ে গেছে এবং এটা দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
কবি-সাহিত্যিকরা প্রকৃতি থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেন। প্রকৃতির সৌন্দর্য তারা তাদের কবিতা-সাহিত্যে ফুটিয়ে তোলেন। এটা মানুষের মনেরও খোরাক জোগায়। অথচ আমরা শিল্প কারখানার স্বার্থে বৃক্ষ নিধন করেই চলেছি। অবশ্য শিল্পায়ন আমাদের প্রভূত সাহায্য করে। বেকারত্ব দূর করা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে স্থানীয়ভাবে মানসম্পন্ন পণ্যের চাহিদা মেটানোর মতো চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলাসহ আমাদের প্রভূত সাহায্য করে। এভাবে শিল্পায়ন জিডিপি ও জিএনপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সে কারণে শিল্পায়নের পাশাপাশি বন সৃজনের ওপরও আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।
সর্বোপরি বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। তাহলে আমাদের কাক্সিক্ষত রাজধানীতে এর প্রতিফলন নেই কেন?
ঢাকায় দৃষ্টিনন্দন আকাশছোঁয়া ভবনসমূহের প্রশংসা করি। তবে প্রকৃতিকে ত্যাগ করার বিনিময়ে আমরা এটা চাই না। আমরা স্বাস্থ্যসম্মত জীবন চাই যা সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা একটি শহরই আমাদের তা দিতে পারে।
রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের কাছে আমাদের আন্তরিক অনুরোধ ভবন নির্মাণের সময় গাছ কেটে ফেলবেন না। ভিন্ন উপায় বের করার চেষ্টা করুন। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে নির্মাণের জন্য জমি তৈরিতে যদি গাছ কাটা একেবারেই জরুরি হয় তাহলে এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রাঙ্গণের ভেতরে কিছু গাছ লাগানোর সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে হবে। আইন অনুযায়ী কানাডায় একটি গাছ অপসারণ করলে একই প্রাঙ্গণে তিনটি গাছ লাগাতে হবে সেটা বেসরকারি সম্পত্তি, পার্ক বা বুলেভার্ড যাই হোক না কেন। একই প্রাঙ্গণে সকল গাছ লাগানো সম্ভব না হলে কাছাকাছি স্থানসমূহে গাছ লাগাতে হবে। দৃশ্যত এটা এমন এক ব্যাপকভিত্তিক ধারণা যাতে গাছ অপসারণকারী এবং সমাজ উভয়েই উপকৃত হয়।
ঢাকায় সবুজ শ্যামলিমা রক্ষায় এ ধরনের একটি আইন করার জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকার এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে বিনীত প্রস্তাব রাখছি। ঢাকার সবুজ মরে যাচ্ছে। আসুন, আমরা একে বাঁচতে দেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার সবুজ
আরও পড়ুন