Inqilab Logo

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ছয় মাস ডকইয়ার্ডে পড়ে আছে এমভি বাঙ্গালি

প্রকাশের সময় : ৪ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম : বিআইডব্লিউটিসি’র জন্য প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সংগ্রহ করা দুটি শ্বেতহস্তীর মধ্যে এমভি বাঙালি নৌযানটি কথিত সংস্কারের নামে গত ছয় মাসাধিককাল নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ডকইয়ার্ডে পরে থাকলেও তা যাত্রী পরিবহনে ফিরিয়ে আনার জোরালো উদ্যোগ নেই।
এমনকি সাগর উপকূলে অশান্ত মৌসুম শুরু হওয়ায় অভ্যন্তরীণ নৌপথের এ নৌযানটি কর্ণফুলীর মোহনা থেকে সন্দ্বীপ ও হাতিয়া চ্যানেল হয়ে ভাটি মেঘনা উপকূল অতিক্রম করে বরিশাল বা ঢাকায় পৌঁছতে পারবে কিনা সে বিষয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। অথচ দু’মাসের মধ্যে সংস্থাটির চাহিদা মাফিক সংস্কার কাজ সম্পন্ন করার শর্তেই গত ২৮ অক্টোবর ‘এমভি বাঙালি’কে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্সের ডকইয়ার্ডে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু নৌযানটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছানের টানা এক মাস পরে ২৯ নভেম্বর ডকিং করা হয়। তলা ও খোলের কিছু সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে এক মাসের মধ্যেই তা পুনরায় কর্ণফুলী নদীতে ভাসানোর কথা থাকলেও নৌযানটি কর্ণফুলীতে ভাসানো হয় প্রায় ৩ মাস পরে গত ২৪ ফেব্রুয়ারী। ইতোমধ্যে বিআইডব্লিউটিসি’র চেয়ারম্যান ও পরিচালক-কারিগরি সহ প্রকল্প পরিচালক একাধীকবার নৌযানটি পরিদর্শন করে কিছু পরামর্শ ও পর্যবেক্ষন প্রদান করেন। সে আলোকে নানা সংস্কারও করা হয়েছে বলে দাবী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল মহলের।
কিন্তু নৌযানটি ৩১ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্থাটির কাছে হস্তান্তরের কথা থাকলেও ওয়েষ্টার্ণ মেরিন থেকে একমাস সময় বৃদ্ধি করে ৩১জানুয়ারীরর মধ্যে এমভি বাঙালিকে হস্তান্তরের ওয়াদা করে। কিন্তু তা নির্মান প্রতিষ্ঠানের ডকইয়ার্ডের স্লীপওয়ে থেকে নদীতে ভাসানো হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি। এর পরে থেকেই নৌযানটি কখনো নৌ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটির জেটিতে আবার কখনো সংলগ্ন নদীতে নোঙরে রাখা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিসি’র পক্ষ থেকে নৌযানটির উপরীকাঠামো রং করার দাবী করা হলেও তাতে প্রথমে রাজী হয়নি ওয়েস্টার্ন মেরিন। পরে বিষয়টি নিয়ে একটি সমঝোতার ভিত্তিতে অতি সম্প্রতি এসব কাজও শেষ করেছে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি। আর এসব সংস্কার কাজে নির্মান প্রতিষ্ঠানটি আরো প্রায় সোয়া ২ কোটি টাকা দাবী করছে। অপরদিকে নানা অজুহাতে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর এমভি বাঙালির সার্ভে সনদ প্রদান করেনি এখনো। ফলে সরকারী নৌ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের এ নৌযানটি ইতিপূর্বে অনেকটা অবৈধভাবেই চলাচল করেছে।
কিন্তু ওয়াকিবাহাল মহলের মতে, উপরিকাঠামোর রঙ করার কাজটি সংস্থার ঢাকা বা বরিশালে নিজস্ব ঘাটে রেখেও করা সম্ভব হত। কিন্তু ঐ রঙ করার অজুহাতে দীর্ঘ কালক্ষেপনের পরে এখন অশান্ত মৌসুমের মধ্যে এমভি বাঙালি চট্টগ্রামের সাগর মোহনা অতিক্রম করতে পারবে কিনা সে ব্যপারে সন্দেহ রয়েছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর নৌযানটি চট্টগ্রাম থেকে সাগর মোহনা অতিক্রমের অনুমোদন দেবে কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে। ফলে আসন্ন রমজান ও ঈদুল ফিতরের সময় এ নৌযানটিতে যাত্রী পরিবহনে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা সষ্টি হয়েছে বলেও মনে করছেন ওয়াকিবাহাল মহল।
অপরদিকে নৌযানটির তলা ও খোলে দু’বছর আগে যে মেরিন পেইন্ট করা হয়েছে তার বেশীরভাগই ইতোমধ্যে বিনষ্ট হয়েছ বা কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। সেক্ষেত্রে নৌযানটির তলা ও খোলে মেরিন পেইন্টের কাজটি বেশী জরুরী ছিল। উপরন্তু গত প্রায় ছয় মাসের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ মাসই নৌযানটি চট্টগ্রামের নোনা পানিতে ভাসমান থাকায় এর খোল ও তলার পুরনো পেইন্ট আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন ওয়াকিবাহাল মহল। কিন্তু সে বিষয়টির প্রতি বিআইডব্লিউটিসি’র কারিগরি পরিদফতর বা মেরিন বিভাগ সচেতন ছিলেন না।
প্রায় এক হাজার টন ওজনের ঐ নৌযানটি চট্টগ্রাম ছাড়া ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জে কোথাও ডকিং করার সুবিধা বর্তমানে নেই। এতেকরে নৌযানটি খোল, হাল বা তলার যেকোন সমস্যার জন্য চট্টগ্রামের ওপরই নির্ভর করতে হবে। উপরন্তু এ ধরনের নৌযান চট্টগ্রামে আনা নেয়ার সময়কালও বছরে মাত্র ৭ মাস, মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত। এসব বিবেচনায় নৌযানটির তলা ও খোলের অধিকতর নিরপত্তার স্বর্থেই ঐসব অংশে মেরিন পেইন্ট লাগানো বিশেষ জরুরী ছিল বলে মনে করছেন ওয়াকিবাহাল মহল।
এসব বিষয়ে বিঅইডব্লিউটিসি’র চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি দেশের বাইরে থাকায় তা সম্ভব হয়নি। তবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও পরিচালক-প্রশাসনের সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, চেয়ারম্যান দেশে ফিরলে তিনি এসব বিষয় তাকে অবহিত করে যতদ্রুত সম্ভব নিরাপদে নৌযানটি ঢাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কথা বলবেন। তবে ১৫মার্চের মধ্যে বাঙালিকে ঢাকা বা বরিশাল ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে মেরিন বিভাগের তৎপড় হওয়া উচিত ছিল বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, সরকার ও বিঅইডব্লিউটিসি’র যৌথ অর্থায়নে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ব্যায়ে ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা নৌপথে যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যে ‘এমভি বাঙালি’ ও ‘এমভি মধুমতী’ নামের দুটি যাত্রীবাহী নৌযান তৈরী করা হয়। নির্ধারিত সময়ের প্রায় ছয় মাস পরে ২০১৪-এর মার্চের প্রথম ভাগে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘এমভি বাঙালি’কে বিআইডব্লিউটিসির কাছে হস্তান্তর করে। ঐ বছরই ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা-বরিশাল রুটের জন্য নৌযানটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী মোঃ শাহজাহান খান ১০ এপ্রিল প্রথম বাণিজ্যিক যাত্রায় বাঙালিকে নিয়ে বরিশাল আসেন।
কিন্তু নৌযানটি মোটেই যাত্রীবান্ধব না হওয়ায় তাতে যাত্রীদের ভ্রমণে অনীহা লক্ষ করা যায়। নৌমন্ত্রী নিজেও বিষয়টি সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ ব্যাপার সংস্থার কারগরি, মেরিন ও বাণিজ্য পরিদফতরের ১২ জন কর্মকতাকে তখন কৈফিয়তও তলব করা হয়। এমনকি নৌমন্ত্রী ২০১৪-এর ২৫ এপ্রিল বরিশালে এক অনুষ্ঠানে বিষয়টি স্বীকার করে নৌযানটিকে যাত্রীবান্ধব করে সংস্কারের ওয়াদাও করেন। তবে সে কাজটি বিগত দুবছরেও সম্পন্ন হয়নি। অপারদিকে নির্ধারিত সময়েল প্রায় দেড় বছর পরে গত বছর জুন-এর শেষভাগে এমভি মধুমতী জাহাজটি বিআইডব্লিউটিসি’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নৌযানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
এদিকে মাত্র সাড়ে ৭শ যাত্রী বহনক্ষম প্রায় আড়াইশ ফুট দৈর্ঘ্যরে দ্বিস্তর তলা বিশিষ্ট নৌযানটিত প্রতি ঘন্টায় জ্বালানী পুড়ছে প্রায় ২শ লিটার। যা প্রায় শত বছরের পুরনো প্যাডেল জাহাজগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ। প্যডেল জাহাজগুলোতে যাত্রী বহন ক্ষমতা ৯৬০ জন।
এসব কারণেই প্রায় ৫৫ কোটি টাকা ব্যায়ে ‘এমভি বাঙালি ও এমভি মধুমতী’ নামের নবনির্মিত নতুন দুটি যাত্রীবাহী নৌযান যাত্রী পরিবহনের চেয়ে বসিয়ে রাখলে লোকশানের পরিমান কমে বলে জানা গেছে। তবে মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানী ব্যায়ের এসব নৌযান স্বল্প দূরত্বের ঢাকা-বরিশাল রুটে পরিচালনা করলে এর লোকশনের রেশ অনেকটাই হ্রাস করা সম্ভব হলেও বিষয়টি বুঝেও বিআইডব্লিউটিসি’র দায়িত্বশীল মহল প্রকল্প নির্ধারিত ঢাকা-বরিশাল রুটটি বন্ধ করে দীর্ঘতম দূরত্বের ঢাকা-মোড়েলগঞ্জ রুটে তা পরিচালনা করছেন। ফলে প্রতি ট্রিপে এসব নৌযান তিন লক্ষাধিক টাকা লোকসান গুনছে। এসব বিষয়ে একাধিকবার সংস্থাটির জিএমের (বাণিজ্য) সাথে আলাপ করা হলে, তিনি ‘এমভি বাঙালি সংস্থার বহরে ফেরার পরে যাত্রী সুবিধা বিবচনা করে লোকশান এড়িয়ে পরিচালন’-এর কথা জানিয়েছেন।
তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে লোকসান থেকে উত্তরণের পথে হাঁটছে না বিআইডব্লিউটিসি’র দায়িত্বশীল মহল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ছয় মাস ডকইয়ার্ডে পড়ে আছে এমভি বাঙ্গালি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ