Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

সাগরে মাছের আকাল

তেল ও বর্জ্যে মারাত্মক দূষণ : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারের এখন ভরা মৌসুম। অথচ সাগরে মাছ মিলছে খুবই কম হারে। দেশীয় ট্রলার নৌযানবহর নিয়ে সাগরে গিয়ে জেলেরা অনেক সময়ই হতাশ হয়ে ফিরছে। কেননা হরেক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ আশানুরূপ ধরা পড়ছে না। সামুদ্রিক মাছের এলাকা বৃহত্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ সমুদ্র উপকূলের সর্বত্রই মাছের আকাল চলছে। ফিশারি ঘাট, মাছের আড়ত, মোকাম ও বাজারগুলো অনেকটা ফাঁকা। বাজারে মাছ অপ্রতুল। সামুদ্রিক মাছ যাও আসছে দাম আকাশছোঁয়া। বাজারে এখন বেশিরভাগই পুকুর-খামারের মাছ। বিভিন্ন জাতের সুস্বাদু সামুদ্রিক মাছের দাম বলতে গেলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। স্বাদ ভুলতে বসেছে অনেকেই। চিংড়ি-লবস্টার, ইলিশসহ লাক্ষা, কোরাল, পোয়া, রূপচাদা, কালাচাঁদা, সুরমা, ছুরি, সুন্দরী, কাইক্কা, লইট্টা, মাইট্টাসহ সবধরনের সামুদ্রিক মাছের আহরণ এবং সরবরাহ দুই-ই দিন দিন কমে এসেছে। সেই সাথে মূল্যও অনেক বেড়ে গেছে। তাছাড়া জেলেরা জানান, সাগরে অনেক প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাওয়ার মুখে।
গভীর সমুদ্রে মাছ আহরণকারী ট্রলার-নৌযানের জেলেরা আরো জানান, সাগরে হরেক জাতের মাছের আকাল চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। তবে বর্তমানে সামুদ্রিক মাছের সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। গত ডিসেম্বর’১৫ইং মাস থেকে এ যাবত বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ-নিম্নচাপ ও ঝড়ের ঘনঘটা নেই। এরফলে সাগর-উপকূলে ও সমুদ্রবন্দরে কোন সতর্কতা সংকেতও দেখানো হচ্ছে না। এবার টানা বেশিদিন ধরে সমুদ্র শান্ত থাকার সুবাদে বাংলাদেশের সুবিস্তীর্ণ একান্ত পানিসীমায় মাছ শিকারের জন্য দেশীয় ট্রলার, নৌযান নিয়ে জেলেরা দলে দলে মাছ শিকারের জন্য ছুটছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ট্রলার নৌযানগুলো একেকটি ট্রিপে ৭/৮ দিন সাগরে হন্যে হয়ে ঘুরেও ২/৩ টনের বেশি মাছ শিকার করতে সক্ষম হচ্ছে না। আগে যেখানে ৫/৭ টন মাছ ধরা সম্ভব ছিল। সামুদ্রিক মাছের বিচরণ এলাকাগুলোতেও তেমন মিলছে না মাছ। অনেক ক্ষেত্রে ট্রলার নৌযানের জ্বালানি তেলের খরচও পুষিয়ে তোলা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক সমুদ্রসম্পদ বিজ্ঞানীরা সামুদ্রিক অর্থনীতির (ব্লু-ইকোনমি) গুরুত্বপর্ণ ধারক বঙ্গোপসাগরকে ‘সুসমৃদ্ধ খনি’ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছেন। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষিসংস্থার (এফএও) ষাটের দশকের এক নিবিড় জরিপে বঙ্গোপসাগরকে বলা হয়েছে ‘মৎস্য খনি’। বঙ্গোপসাগর ধারণ করে আছে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি। আর অর্থকরি ৪৭৬ প্রজাতির মাছ। প্রাণিজ প্রোটিনের বিরাট অংশের যোগান আসে সামুদ্রিক মাছ থেকেই। এক সময় ব্যাপক হারে মৎস্য সম্পদে বঙ্গোপসাগরের খুবই সুসমৃদ্ধ ছিল মূল তিনটি মৎস্যচারণ এলাকা। যা ‘সাউথ প্যাসেচ’, ‘মিডলিং’ বা ‘মিডল গ্রাউন্ড’ এবং ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ হিসেবে পরিচিত। বঙ্গোপসাগরে সর্বাপেক্ষা বেশি মাছের ঘনত্ব ও বিচরণ ছিল সেসব জায়গায়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সাগরে বাংলাদেশের পানিসীমায় মাছের বিচরণশীলতা, ঘনত্ব এবং সম্ভাব্য মজুদ বা স্থিতি, সর্বোচ্চ আহরণসীমা (এমএসওয়াই) সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জরিপ পরিচালনা না করার কারণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কি হারে কমে যাচ্ছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যাচ্ছে না।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগর ধীরে ধীরে মৎস্যশূণ্য উপসাগরে পরিণত হতে চলেছে। সাগরে পোড়া তেল ও বর্জ্যরে দূষণ প্রক্রিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সেই সাথে আবহাওয়া-জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দ্রুত পড়ছে সামুদ্রিক পরিবেশের উপর। এতে করে সাগরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বংশ বৃদ্ধি ও দ্রুত বর্ধনের উর্বর ক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে। তাছাড়া বেপরোয়া হারে মাছ শিকার (ওভার ফিশিং) নিয়ন্ত্রণ ও মাছের পোনা নিধন বন্ধ হচ্ছে না। মাছের বিচরণ এলাকা বা অভয়াশ্রম সংরক্ষণ করার নেই কোন কার্যকর উদ্যোগ। ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও শ্রীলংকার অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ট্রলার নৌযান নির্বিচারে সাগরে মাছ নিধন করছে। অপরিণত বা পোনা মাছ শিকার চলছে। এসব বিষয়ে তদারকি ও মনিটরিং ব্যবস্থার গোড়ায় রয়েছে গলদ।
সাগরে মাছ শিকারী জেলেরা জানান, দেশী-বিদেশী জাহাজগুলো সাগরে তেল বিশেষত পোড়া তেল এবং হরেক রকমের বর্জ্য ফেলছে বেপরোয়াভাইে। বঙ্গোপসাগরে মাছের প্রধান বিচরণ জায়গাগুলো পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর, কুতুবদিয়া বহির্নোঙ্গরসহ সাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবাধে জাহাজের তেল ও বর্জ্য নিঃসরণ করা হচ্ছে। এতে করে সামুদ্রিক পরিবেশ ক্রমাগত বিষিয়ে উঠছে। হরেক প্রজাতির মাছ মারা যাচ্ছে। মাছের বিচরণ, প্রজনন প্রক্রিয়াও ব্যাহত হচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে মাছের কম প্রাপ্তি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে গতকাল (শনিবার) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস এন্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. মোঃ এম মারুফ হোসেন ইনকিলাবকে বলেছেন, মাছ কমে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এক্ষেত্রে দূষণ অবশ্যই বড় কারণ। শিল্প-কারখানাগুলোতে ইটিপি না থাকায় বিষাক্ত বর্জ্য সাগরে গিয়ে মিশছে। শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোর ক্ষতিকর তেল বর্জ্য সাগরে পড়ছে। তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবও রয়েছে সামুদ্রিক মাছের বিচরণ পরিবেশের উপর। তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। সামুদ্রিক পানিতে লবণাক্ততার হার বা মাত্রায় অস্বাভাবিক তারতম্য ঘটলে সামুদ্রিক মাছ বাঁচতে পারে না। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে সুন্দরবন উপকূলে মাছের বিচরণশীল পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। তিনি সামুদ্রিক মাছের মজুদ বা স্থিতি সম্পর্কে দীর্ঘদিন কোন বৈজ্ঞানিক জরিপ পরিচালনা না হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, এর জন্য পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তাছাড়া নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সামুদ্রিক মৎস্য বিজ্ঞানী-গবেষকদের অবদান রাখার সুযোগ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সাগরে মাছের আকাল
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ