ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আফতাব চৌধুরী
নিজের নাম প্রচারের আলোয় আসুক, ব্যাপক আলোচিত হোক-এ অভিলাষ অনেক মানুষের সাধারণ, স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি। এর জন্য কেউ সৃজনশীল কর্মকা-ের আশ্রয় নেন এবং সার্থক হলে প্রকৃত কৃতী হিসেবে জনমানসে পরিচিতি লাভ করেন। এটি কঠিন কাজ। এ পন্থায় যথার্থ মেধাবী ও উদ্যমীরা সাফল্য লাভ করেন। কেউ আবার ঝুঁকিপূর্ণ অচিরাচরিত কিছু করে নিজেকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসতে চান। এ ক্ষেত্রে দৃঢ় সংকল্প আর লক্ষ্যে পৌঁছার তীব্র জেদ সাফল্যের চাবিকাঠি। আবার এমন মানুষ আছেন-যারা নিভৃতে নীরবে নিরলস কর্মতৎপরতা চালিয়ে যান এবং তাদের অন্তর্মুখিতা ও প্রচার-বিমুখতা সত্ত্বেও স্বাভাবিকভাবে প্রচারের আলোয় চলে আসেন। অপরদিকে এমন এক শ্রেণির মানুষ দেখা যায়, যারা নিছক ‘চমক’ সৃষ্টি করে আকস্মিক প্রচারের আলোয় আসার চেষ্টা করেন এবং এসে যান। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত মেধা-সংকল্প গৌণ, চমক সৃষ্টির চাতুর্য মুখ্য। এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করে রাতারাতি প্রচারের আলোয় আসার ঘটনা যদিও সাম্প্রতিক কোনো প্রবণতা নয় তবে ইদানীং এর আধিক্য দৃশ্যমান। অবশ্য এ ক্ষেত্রে যে ঝুঁকি থাকে না তা নয় তবে প্রচারভিলাষী ব্যক্তি সে ঝুঁকি অগ্রাহ্য করতে প্রস্তুত থাকেন।
চমক কৌশল অবলম্বনে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অভিনেতা, মডেল, রাজনীতিক কেউ পিছিয়ে নেই। সাহিত্যের লোক সলমন রুশদির কথা দিয়ে শুরু করা যাক। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এ বিতর্কিত লেখক দীর্ঘ দু’দশক ধরে ইংল্যান্ডে আশ্রিত এবং সুরক্ষিত। প্রায় দু’দশক পূর্বে রাতারাতি সারা বিশ্বে তার নাম ছড়িয়ে পড়ার পিছনে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম নয়। স্যাটানিক ভার্সেস নামক বইয়ে ইসলাম ও কুরআন নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য তাকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে। রুশদি যে এরূপ স্পর্শকাতর বিষয় কত তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে তা জানতো না এমন ভাবার কোনো অবকাশ নেই। তা সত্ত্বেও তিনি এরূপ লিখতে উদ্বুদ্ধ হন। উদ্দেশ্য অবশ্য ‘চমক’ সৃষ্টি করা, তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়ে বিপুল প্রচার লাভ। তিনি আশাতীতভাবে সফল হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে নিরাপত্তাহীন বেষ্টনীর মধ্যে ‘বন্দি’ জীবন অতিবাহিত করলেও সীমাহীন প্রচার পেয়েছেন। চমক সৃষ্টি করে বিতর্কিত রূপে প্রচার লাভ তার চারিত্রিক যে বৈশিষ্ট্য, সেটি তার জীবনশৈলী থেকে প্রকাশ্যে এসেছে। এ পর্যন্ত চারবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, যে তালিকায় কন্যাসম মেয়েরাও রয়েছে। সম্প্রতি স্বল্পবয়সী ভারতীয় এক ফিল্ম অভিনেত্রীর প্রেমে পড়েছেন। এরূপ প্রেমকাহিনী বিভিন্ন দেশের সংবাদ মাধ্যমে হুলস্থুল ফেলে দিয়েছে।
রুশদির চারিত্রিক দিক দিয়ে ইদানীং কিছু নতুন উদ্ভট তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রাক্তন গোয়েন্দা রণ ইভান্স রুশদিকে কৃপণ, ঔদ্যত ও অভদ্র বলে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া, তার আরো নানা চমকপ্রদ ঘটনা ও তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। চমক-বিতর্ক যে রুশদির জীবন শৈলীর প্রধান ও অপরিহার্য অঙ্গ এসব তার ইঙ্গিতবাহী।
রুশদির পর আরেক সাহিত্যের লোক (পড়–ন মহিলা)তসলিমা নাসরিনের প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য। সলমন রুশদির সঙ্গে তসলিমার সাদৃশ্যের ব্যাপার হল, দু’জনই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগে অভিযুক্ত, যদি তাদের লেখার বিষয়বস্তু অনেকটি আলাদা। তসলিমা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর অমানবিক নির্যাতন ও দেশের কট্টর মৌলবাদীদের অমানুষিক কার্যকলাপের বীভৎস চিত্র তুলে ধরেছেন তার লেখা ‘লজ্জা’ বইতে যা ছিল কাল্পনিক। কারণ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা অত্যন্ত নিরাপদ এবং তারা চমৎকার জীবন-যাপন করছেন। লেখার বিষয়বস্তুর সত্যতা কতটুকু সেটা এক ব্যাপার, কিন্তু সেটাকে যেভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে, যে অশিষ্ট ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে-তা সুশীল সমাজে সত্যি লজ্জার বিষয়। লেখাটিতে সাহিত্যধর্ম কতটুকু রক্ষিত হয়েছে তা-ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তসলিমা শিক্ষিতা, সমাজসচেতন মহিলা। ‘লজ্জা’ বইটি কতটুকু তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং ফলসরূপ তার যে দেশে থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়বে, আর দেশান্তরিত হলে যে দেশের এসব সমস্যা সমাধানে তেমন প্রভাবী ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে না-এসব তার বোধগম্য না হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। সমাজ সংস্কারের বাস্তবধমী ও কম ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা অবলম্বন না করে যেভাবে তিনি খড়গহস্ত হয়ে উঠেন তা এক ধরনের ‘চমক’ সৃষ্টির অভিপ্রায় বলতে হবে। পরিণতি হলো তাই। তার উল্লেখিত কাল্পনিক কোনো সমস্যার সমাধান হল না বরং তিনি নিজে আজ ছিন্নমূল, ঠাঁইহীন।
এবার এক প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীর কথা। মকবুল ফিদার শিল্পী হিসেবে হাতেখড়ি অবশ্য ‘চমক’ দিয়ে নয়। মেধা ও শিল্প নৈপুণ্য তাকে ব্যাপক পরিচিতি ও খ্যাতি এনে দিলে বৃদ্ধ বয়সে তিনি প্রচার লিপ্সায় তাড়িত হয়ে চমক কৌশল অবলম্বনে মেতে উঠেন। তার চমক সৃষ্টির ধরন আরো চমকপ্রদ। তুলির টানে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে একে ফেললেন হিন্দু ধর্মের সরস্বতী দেবীর ছবি। তার শিল্প-বিদ্যার চরম উৎকর্ষ ও নৈপুণ্য প্রদর্শনের উপায় হিসেবে বেছে নিলেন একেবারে সরস্বতীকে, যিনি কোটি কোটি হিন্দুর কাছে মাতৃরূপে বন্দিতা। পরিণাম যা হবার তাই হল। এটিকে ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’র নামে যথার্থ প্রমাণ করার অপচেষ্টা করা রুশদি-তসলিমার মতো মকবুল ফিদা সমাজচ্যুত হলেন। ফিদা কর্তৃক সরস্বতীর অশ্লীল প্রদর্শন হিন্দুদের মধ্যে যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে তা মকবুল ফিদার অনুমান-বহির্ভূত ছিল। এমন চিন্তা করাটা বোকামি নিশ্চয়ই। বরং বুঝে-শুনে এ ‘চমক’ এর আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি ব্যাপক প্রচারের আলোয় আসার আশায়।
মডেল-অভিনেত্রী আদি গ্ল্যামার জগৎ বিহারিণীদের কাছে চমক কৌশলের আশ্রয়ে প্রচার মাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসার প্রবণতা সর্বকালের। নিজের প্রেমকাহিনী, পার্টনার পরিবর্তন ইত্যাদি ঘটনাকে কৌশলে মিডিয়ায় ‘লিক’ করে দিয়ে হইচই ফেলে দেয়া এদের স্বভাবসিদ্ধ আচরণ। সম্প্রতি পপ গায়িকা ম্যাডোনা যখন কোনো সাহিত্যিকের ঔরসে সন্তান জন্ম দেয়ার বাসনার কথা প্রকাশ্যে মিডিয়ায় চাউর করলেন, তুমুল হইচই শুরু হয়ে গেল। দেশ-বিদেশের যাবতীয় প্রচারমাধ্যম ফলাও করে এ মুখরোচক কাহিনীর প্রচারে মেতে উঠল। কিছুদিন পূর্বে এ দেশের এক তরুণী ফিল্ম অভিনেত্রী প্রথম সাক্ষাতে পিতৃসম বিতর্কিত লেখক সলমন রুশদির প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেন। এ ধরনের রোমান্টিক ঘটনা কি মিডিয়ার নজর এড়িয়ে থাকতে পারে? ব্রিটিশ মিডিয়ার যাবতীয় নামিদামী ট্যাবলয়েড ম্যাগাজিনের কভারে স্থান পেল ফটোসহ দু’জনের রোমাঞ্চ-কাহিনী। একগাদা ভাল ফিল্ম করেও যে প্রচার পাওয়া সম্ভব হয় না, একজন সেলিব্রেটির সঙ্গে প্রেমের চমক এক তৃতীয় শ্রেণির অভিনেত্রীকে তাৎক্ষণিকভাবে তা করে দিল। অনুরূপ আরেক ঘটনায় নেপালের কুড়ি বছরের তরুণী নিহিতা বিশ্বাস একাধিক নারী-হত্যায় অভিযুক্ত ‘বিকিনি কিলার’ নামে খ্যাত চৌষট্টি বছরের চার্লস শোভরাজের সঙ্গে জেলে দেখা করেন। প্রথম দর্শনে নাকি তরুণীটি শোভরাজের সঙ্গে নিজের কাক্সিক্ষত মানুষটিকে খুঁজে পান আর তাকে বিয়ে করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। প্রচার মাধ্যমের শিরোনামে চলে আসল এক অখ্যাত মেয়ে নিহিতা বিশ্বাসের নাম।
চমক-কৌশলের আশ্রয় অবলম্বন করা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দৈনন্দিনতায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতিকরা চমক সৃষ্টির শিরোমণি। ভোটার-নাগরিকের মন ভোলাতে তাদের কথায় কথায় চমক। ভারতের বর্তমান রাজনীতির এক চর্চিত নাম লালুপ্রসাদের নানান চমক কাহিনী সর্বস্তরের মানুষের কাছে দারুণ উপভোগ্য। নিজের গুণমুগ্ধদের দিয়ে ‘লালু চালিশা’ রচনা, পাঠ্যসূচিতে নিজের কীর্তি কাহিনীর অন্তর্ভুক্তি, রাজনীতি ছেড়ে লেখক-সাহিত্যিক হবার বাসনা, বলিউড ফিল্মে অভিনয়ের ইচ্ছা, নিজের সুহৃদ-সমর্থকদের নিয়ে হোলির আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে অন্তর্বাস নিয়ে টানাহেঁচড়া-এসব লালুপ্রসাদের চমক সৃষ্টির স্বকীয় কৌশল।
ভারতে কংগ্রেস দলের সবচেয়ে নন্দিত পরিবারের যুবনেতা রাহুল গান্ধী ‘চমক’ সৃষ্টিতে পিছিয়ে নেই। কংগ্রেসদের কাছে যুবরাজ বলে খ্যাত এবং তথাকথিত ভাবী প্রধানমন্ত্রী রাহুল গান্ধীর মুখ থেকে দেশের জ্বলন্ত সমস্যাবলী সম্পর্কে সারগর্ভ কোন ভাষণ বা সুচিন্তিত মতামত শোনা না গেলেও বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি চমক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। কিছুদিন পূর্বে তার উত্তর প্রদেশ সফরকালে হঠাৎ করে কোনো দলিত-দুঃখী পরিবারে হাজির হওয়া, সেখানে খাওয়া-দাওয়া সারা রাত্রিযাপন করার মতো ঘটনা ভাল সাড়া ফেলেছিল। সম্প্রতি সংসদে পরমাণু বিতর্কে ভাগ নিয়ে ‘পরমাণু শক্তি ও দারিদ্র দূরীকরণ’ গোছের এক গল্প উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শশিকলা ও কলাবতী নামক দুই নিঃস্ব হতদরিদ্র মহিলা। এমন মর্মস্পর্শী কাহিনী বিরোধীদের মর্মস্পর্শ করতে না পারলেও স্বদলীয়রা টেবিল চাপড়ে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন এবং রাহুল গান্ধীর দরিদ্র প্রেমের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। রাহুল গান্ধী উপলব্ধি করেছিলেন এ সহায়-সম্বলহীন নিঃস্ব মহিলার অভাবের মূলে রয়েছে বিদ্যুতের অভাব। তাই পরমাণু শক্তি ব্যবহারে বিদ্যুৎ উৎপাদন দারিদ্র্য মোচনে অত্যাবশ্যক। অবশ্য পরমাণু শক্তির ব্যবহারে মোট চাহিদার মাত্র কয়েক শতাংশ সম্ভাব্য উৎপাদিত মহার্ঘ বিদ্যুতের ছিটেফোঁটাও কি শশিকলা-কলাবতীর মতো কোটি কোটি হতদরিদ্র পরিবারের ভাগ্যে জুটবে, সেটি অন্য কথা। তবে এ চমক কাহিনী সংবেদনশীল মানুষের মর্মে কিছুটা হলেও ছাপ ফেলতে সক্ষম তা অস্বীকার করা যাবে না। তাই ঐ যুবনেতা পরমাণু চুক্তির টেকনিক্যাল বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ কঠিন-কর্কশ আলোচনায় না গিয়ে এ ইমোশন্যাল গল্প উপস্থাপন করে চমক দিতে চাইলেন। সংবাদমাধ্যমকে এ নেতার বক্তব্যের প্রচার পৃথক শিরোনামে করতে দেখা গেল। রাজনৈতিক নেতাদের চমক কাহিনী অফুরন্ত।
বর্তমান যুগ ‘শর্টকার্ট’-এর যুগ। কম পরিশ্রমে অধিক লাভ করার প্রবণতার যুগ। চমকের দ্বারা ‘সাফল্য’ লাভের অভিলাষের যুগ। তাই চমক কাহিনীর নিরন্তরতা বজায় থাকবে। অন্তত আমাদের মনে হচ্ছে তাই।
লেখক - সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।