Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তাপদাহে বিদ্যুৎ ভোগান্তি

প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৬ পিএম, ২৭ এপ্রিল, ২০১৬

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : একদিকে প্রচ- তাপদাহ, আরেকদিকে দিনে ও রাতে সমান তালে বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলা। দুয়ে মিলে প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত সব বয়সী মানুষের। অফিস, আদালত, বাসা-বাড়ি, শিল্প-কারখানা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান Ñ সর্বত্রই লোডশেডিংয়ের যাতনা। ঢাকাতেই বিদ্যুৎ নিয়ে যেখানে সীমাহীন ভোগান্তি চলছে, সেখানে জেলা শহরগুলোর অবস্থা আরও অমানবিক, এটা অকপটেই বলা যায়।
লোডশেডিংয়ের যাতনায় অতিষ্ঠ বাসাবো কদমতলার বাসিন্দা মো. আক্কাস বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমার পরও বিদ্যুতের দাম কমেনি। বরং বেশি দামেই বিদ্যুৎ কিনে ব্যবহার করছি। তারপরও বিল দিতে দেরি হলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। অবস্থা যেখানে এরকম, সেখানে বিদ্যুৎ নিয়ে তো ভোগান্তি হওয়ার কথা নয়।
অপরদিকে গাজীপুরে একটি কুটির শিল্পের মালিক আক্তার হোসেন বলেন, অল্প পুঁজি নিয়ে আমার লেদ মেশিনের ব্যবসা। বিদ্যুৎ ভোগান্তির কারণে গত কয়েকদিন যাবৎ ব্যবসা লাটে ঊঠেছে। তিনি বলেন, এভাবে চললে ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, ব্যবসা গুটিয়ে পালাতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক কম। প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াটের ওপর ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি মোকবিলা করতেই এতটা লোডশেডিংয়ের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। ঢাকায় যে হারে লোডশেডিং চলছে, জেলা শহরগুলোতে এই চিত্র আরও ভয়াবহ।
এমন দুরবস্থায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়েছে নৌশ্রমিক ধর্মঘটের কারণে। তবে, এই ধর্মঘট প্রত্যাহার হওয়ায় আশা করছি, বৃহস্পতিবার থেকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
পিডিবি’র দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে না পারায় গতকাল তারা ৮শ’ মেগাওয়াট লোডশেডিং রেখেছে। মঙ্গলবার লোডশেডিং ছিল ৫শ’ মেগাওয়াটের উপরে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পিডিবি’র পরিচালক (জনসংযোগ) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, গতকাল বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াট। আর উৎপাদন ছিল ৭ হাজার ৬শ’ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ধরা হয়েছে ৭শ’ মেগাওয়াট।
পিডিবি’র তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে জ্বালানি তেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনেকগুলোই জ্বালানি তেলের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না। মেঘনায় সামিট পাওয়ারের একটি কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে তেলের কারণে। জ্বালানি তেল বহনকারী বেশ কয়েকটি জাহাজ বিভিন্ন বন্দরে খালাশের অপেক্ষায় বসে রয়েছে। ধর্মঘট প্রত্যাহার হওয়ায় গতকাল নৌযান শ্রমিকরা এসব জাহাজ থেকে তেল খালাস শুরু করেছে।
তবে শুধু নৌযান শ্রমিক ধর্মঘটের কারণেই বিদ্যুতের উৎপাদনে বিঘœ ঘটছে এমনটি মানতে রাজি নন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, চাহিদার সাথে উৎপাদনের যে ফারাক দেখানো হয়, তাতে যথেষ্ট শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। পিডিবি এই অসহনীয় গরমেও চাহিদা ৮ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াট দেখালেও কার্যত চাহিদা কোনোভাবেই সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াটের নিচে নয়। এক্ষেত্রে চাহিদার সাথে উৎপাদনের ঘাটতি রয়েছে কমপক্ষে ২ হাজার মেগাওয়াট।
এদিকে, গত এক মাস ধরেই দেশে গরমের প্রকোপ বেড়েছে। চলছে তীব্র তাপদাহ। একারণে বিদ্যুতের ব্যবহারও বেড়ে গেছে। এতে করে লোডশেডিং বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ নিয়ে ভোগান্তির কারণে দেশের অধিকাংশ শিল্প-কারখানার উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। হচ্ছে শ্রমঘণ্টারও অপচয়। এমন পরিস্থিতিতে মালিকরা কিভাবে শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করবেন, তা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন। বিদ্যুতের লুকোচুরির কারণে অফিস-আদালতেও ঠিকমত কাজ করতে পারছেন না কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিদ্যুৎ এই যায় এই আসে, এভাবেই কেটে যায় অফিসের সময়। লোডশেডিংয়ে সবচেয়ে অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে হাসপাতালগুলো।

বিদ্যুৎ বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চাহিদার অনুপাতে লোডশেডিং সবচেয়ে কম হয় ঢাকা অঞ্চলে চাহিদার শতকরা ১২ ভাগ। আর ন্যাশনাল গ্রিড ডেসপাচ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ছাড়া দেশের অন্যন্য অঞ্চলে মোট চাহিদার ১৬ শতাংশ করে লোডশেডিং হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎ বিভাগ কাগজে-কলমে উৎপাদন ও লোডশেডিংয়ের যে হিসাবই দিক না কেন গ্রাহক পর্যায়ে পরিস্থিতি ভিন্ন। দিনে চাহিদার ১২ বা ১৬ শতাংশ লোডশেডিং হলে প্রতি ৬ বা ৮ ঘণ্টা পর এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হওয়ার কথা; কিন্তু এখন দিনে সাত থেকে ৮ বার লোডশেডিং হচ্ছে এলাকাভেদে। বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টদের মতে সরকারিভাবে বিদ্যুতের চাহিদা এবং লোডশেডিংয়ের যে হিসাব দেয়া হয় তা সঠিক নয়।
জানা যায়, বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগজ্ঞ, সিরাজগজ্ঞ, পাবনা, টাঙ্গাইল, মানিকগজ্ঞ, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, নিলফামারী, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জসহ দেশের প্রতিটি এলাকাতেই চলছে লোডশেডিং।
পিডিবি জানায়, গতকাল ঢাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৩২৪৯ মেগাওয়াট, আর লোডশেডিং ছিল ৩৫০ মেগাওয়াট। চট্টগ্রাম এরিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৯১৬ মেগাওয়াট, আর লোডশেডিং ছিল ৬৪ মেগাওয়াট। খুলনা এরিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৯২৩ মেগাওয়াট, আর লোডশেডিং ছিল ৯৬ মেগাওয়াট। রাজশাহী এরিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৮৯৪ মেগাওয়াট, আর লোডশেডিং ছিল ৯১ মেগাওয়াট। কুমিল্লা এরিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৭৮ মেগাওয়াট, আর লোডশেডিং ছিল ৬৪ মেগাওয়াট। ময়মনসিংহ এরিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৫১৪ মেগাওয়াট, আর লোডশেডিং ছিল ৪৯ মেগাওয়াট। সিলেট এরিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৩২৬ মেগাওয়াট, আর লোডশেডিং ছিল ৪১ মেগাওয়াট। বরিশাল এরিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৮০ মেগাওয়াট, আর লোডশেডিং ছিল ১৬ মেগাওয়াট এবং রংপুর এরিয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৫০০ মেগাওয়াট, আর লোডশেডিং ছিল ৬১ মেগাওয়াট। তবে পিডিবি’র দেয়া এই তথ্যের চেয়ে চাহিদা এবং লোডশেডিংয়ের পরিমান আরও অনেক বেশি ছিল বলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান।
গরমের কারণে রাজধানীতে ওয়াসার পানি সঙ্কটও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। গতকাল রাজধানীর অনেক এলাকাতেই ওয়াসার পানি নিয়ে নগরবাসীকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। এ ব্যাপারে ওয়াসার বক্তব্য হচ্ছে-অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ না থাকা এবং লো-ভোল্টেজজনিত কারণে পাম্পগুলোতে ঠিকভাবে পানি উঠছে না। এছাড়াও পানির স্তর নেমে যাওয়ার বিষয়তো রয়েছেই।
দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের কারণে জনভোগান্তি হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, নৌশ্রমিক ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে জ্বালানি তেল সরবরাহে বিঘœ সৃষ্টি হয়। এতে করে তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অনেকগুলোই উৎপাদনে যেতে পারেনি। এর প্রভাবে লোডশেডিং কিছুটা বেড়েছে। তবে বৃহস্পতিবার থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এ ব্যপারে ডিপিডিসি’র এক কর্মকর্তা জানান, চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ না পাওয়ায় তাদেরকে লোডশেডিং বাড়াতে হয়েছে। এই কর্মকতার মতে, গরমে ট্রান্সফরমার গরম হয়ে যাওয়া; মাটির নিচ দিয়ে নেয়া ক্যাবল এবং ওপর দিয়ে নেয়া বৈদ্যুতিক লাইন গরম হয়ে যাওয়ায় নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এতে করেও বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। গরমের কারণে এসি, ফ্যান, পানির মটর যেভাবে চলছে; তাতে করেও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। আর ইজিবাইকের পাশাপাশি দেশের সর্বত্র যেভাবে রিকশায় বিদ্যুৎখেকো ব্যাটারি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে করেও বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে, বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে সরকার কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ভর্তুকি দিয়ে বছরের পর বছর চালু রাখলেও এর সুফল কতটুকু পাওয়া যাচ্ছে-তা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলো কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না।
খরচ বেশি হওয়ায় কম দামে বিক্রিও করতে পারছে না। চুক্তি মোতাবেক সরকার এদের কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ ক্রয় করছে। ফলে এই বাড়তি টাকা যোগান দিতে যেয়ে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। জ্বালানি তেলের দাম কমলেও বিদ্যুতের দাম না কমানোর পেছনে এটিও একটি বড় কারণ বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

***********



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তাপদাহে বিদ্যুৎ ভোগান্তি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ