Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১১ জুন ২০২৪, ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ভাগ্য বদলের নীল অর্থনীতি

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

‘নীল অর্থনীতি’ (ব্ল-ইকোনমি)। এ কথাটার ব্যাপক প্রচলন সাম্প্রতিক মাত্র কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী। সামুদ্রিক সম্পদের ব্যবহারকে ঘিরে যে অর্থনীতি বিকশিত হয় তাই ‘ব্ল-ইকোনমি’ বা ‘নীল অর্থনীতি’। বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণ প্রান্তজুড়ে আছে বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগর। খনিজ, প্রাণিজ, জীববৈচিত্র্য, শৈবাল, স্পিরুলিনা, প্রবাল-মুক্তা, সৈকত খনিজ ভারী বালি, পোর্ট-শিপিং, পর্যটনসহ অর্থকরী অযুত সম্ভাবনা ও সম্পদরাজির ধারক বঙ্গোপসাগর। সামুদ্রিক সম্পদের পরিকল্পিত আহরণ, সদ্ব্যবহার ও উন্নয়ন এবং অপার সুযোগ-সম্ভাবনা কাজে লাগানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে একটি সবল অর্থনীতি গড়ে তোলা অনায়াসেই সম্ভব। যা দেশ ও জাতির ভাগ্য বদলের সোপান হয়ে দাঁড়াতে পারে। সমুদ্র বিজ্ঞানী, বন্দর-শিপিং বিশেষজ্ঞগণ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বঙ্গোপসাগরের মৎস্যসম্পদ, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সম্পর্কে গত আগস্ট মাসে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে গেছে জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহায়তাপুষ্ট নরওয়ের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জরিপ-গবেষণা জাহাজ ‘আরভি ড. ফ্রিডজফ নেনসেন-৩’। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে জরিপ-গবেষণার ফলাফল সম্বলিত প্রতিবেদন এবং সুপারিশমালা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে পেশ করার কথা রয়েছে। সেই সাথে বঙ্গোপসাগরে নাইট্রাস দূষণের কারণে মৎস্যসহ প্রাণিজগতের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ যে অক্সিজেন-শূন্য জোন তৈরি হয়েছে সে এলাকাটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার ভেতরে নাকি বাইরে পড়েছে তাও জানা যেতে পারে ‘আরভি ড. ফ্রিডজফ নেনসেন-৩’ গবেষণায়।
দক্ষিণে বিস্তৃত সুনীল বঙ্গোপসাগর। দ্য বে অব বেঙ্গল। ‘বাংলা’ বা ‘বেঙ্গলে’র (অবিভক্ত বাংলা) কোলে এই উপসাগর। বঙ্গোপসাগরের কিনারভাগ ঘেঁষে আছে উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চল, ব-দ্বীপমালা ও বেশ কয়েকটি উপদ্বীপ। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে সুবিধাজনক ও কৌশলগত এক ভৌগোলিক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রবেশদ্বার। মানুষের জীবনধারণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অফুরন্ত সম্ভাবনার ধারক বঙ্গোপসাগর।
বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তীর্ণ পানিসীমায় এবং ২শ’ নটিক্যাল মাইল মহিসোপান নিয়ে একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইইজেড) ওপর অধিকার তথা সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একান্ত অর্থনৈতিক পানিসীমা (এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন-ইইজেড) ও মহিসোপানের বাইরে সম্মুখভাগে সম্প্রসারিত বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের উপর নিরঙ্কুশ অধিকার, কর্তৃত্ব হয়েছে স্বীকৃত। বিশাল সমুদ্র থেকে সুফল পেতে হলে মৎস্যভান্ডার ও বিভিন্ন সম্পদরাশির মজুদ, প্রাপ্তি ও বিচরণশীলতা সম্পর্কে নিরবচ্ছিন্ন জরিপ এবং গবেষণার বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞগণ।
সাগর উপসাগর মহাসাগর পরিবেষ্টিত দেশগুলো সামুদ্রিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদল করেছে। পাল্টে দিয়েছে নিজেদের অর্থনীতির চেহারা। কিন্তু স্থল পরিবেষ্টিত (ল্যান্ড লক্ড) দেশগুলো এ ক্ষেত্রে ভাগ্যবঞ্চিত। আন্তর্জাতিক সমুদ্রসম্পদ গবেষকগণ বঙ্গোপসাগরকে হরেক ধরনের ‘সম্পদের খনি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশ শুধুই নয়, সারাবিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষের অর্থনীতি, জীবন-জীবিকায় অন্যতম প্রধান নিয়ামক উপাদান উপসাগর, সাগর, মহাসাগর এবং তাদের সাথে যুক্ত হাজার হাজার নদ-নদী, হ্রদ, বিল-হাওর-বাওর। পৃথিবীর মোট আয়তনের চারভাগের তিনভাগই পানিরাশি, একভাগ মাত্র স্থল। মানুষের খাদ্য, বাসস্থান, আয়-রোজগার, ঔষধি উপাদান, প্রেটিন ও পুষ্টির উৎস, পর্যটন ও পরিভ্রমন, পণ্য পরিবহন ছাড়াও সমগ্র অর্থনীতির বিরাট অংশ জুড়ে আছে নদী-সাগর ও তার সুবিশাল অববাহিকা। সুবিশাল বঙ্গোপসাগরকে একপাশে রেখে জালের মতো ছড়িয়ে পড়া অসংখ্য নদীঘেরা বাংলাদেশের অবস্থান এশিয়ার মধ্যে একটু স্বতন্ত্র, ভিন্নতর। ভূ-প্রাকৃতিক কৌশলগতভাবে অনুকূল জনপদ।
নদীমেখলা সাগরকুন্তলা বাংলাদেশের মাঝেই আদি প্রকৃতির চিরায়ত রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, সুখ-দুঃখ, সৌভাগ্য কিংবা ভাগ্য বিপর্যয়ের অনেককিছুই তার এই স্বতন্ত্র ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে ছড়িয়ে আছে। সঙ্কটে কিংবা আনন্দে মানুষের সাথে নদী ও সাগরের গভীর মিতালী হাজার বছর ধরে। দেশের সমগ্র দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল প্রকৃতির নিপূণ হাতে গড়া শুধুই তাই নয়, এটি সম্পদের বিশাল আধার। এর বহুমুখী সম্ভাবনাকে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগানোর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হয়নি কখনোই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিউটের অধ্যাপক ড. হোসেন জামাল বলেন, বঙ্গোপসাগর আমাদের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাবনার ভান্ডার। এর সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি হবে শক্তিশালী। পৃথিবীর অনেক দেশের সফল মডেল অনুসরণ এবং উপকূলবাসীর বাস্তব জীবন থেকে নেয়া হাজারো অভিজ্ঞতাকে যদি কাজে লাগানো হয় তাহলে কক্সবাজারের টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ-সেন্টমার্টিন দ্বীপ এলিফেন্ট পয়েন্ট থেকে খুলনার দুবলার চর-হিরণপয়েন্ট পর্যন্ত ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র উপকূলীয় তটরেখা এবং দেশের ভাটিঅঞ্চলের সমগ্র দক্ষিণভাগ জুড়ে থাকা ১৮শ’ কিমি দীর্ঘ নদী অববাহিকা মানুষের জীবিকার সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সোপান হয়ে দাঁড়াতে পারে দেশের বিস্তীর্ণ সাগর উপকূলভাগ।
সুদূর অতীতে বঙ্গোপসাগর উপকূল ও নদ-নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠে হরেক কৃষি-খামার, শিল্প, নির্মাণ ও মেরামতি কাজের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, আমদানি-রফতানি, সওদাগরী বাণিজ্য। এরমধ্যে রয়েছে চিংড়ি, লবণ, পান, জাহাজ-নৌযান নির্মাণ ও মেরামত শিল্প, সামুদ্রিক মৎস্য ও শুঁটকি মহাল, পর্যটন ইত্যাদি খাত। আজও অনুদঘাটিত খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেল, গ্যাস, তেজস্ক্রিয়তার ধারক ও বিকিরণকারী খনিজ ভারী বালি প্রভৃতি। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক জোনের (ইইজেড) কিনারে বিস্তীর্ণ ভূমি কোটি কোটি মানুষের আয়-রোজগার ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের ঠিকানা হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য প্রয়োজন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থনীতি

৩ জানুয়ারি, ২০২৩
২১ নভেম্বর, ২০২২
১৭ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ