Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইউপি নির্বাচনে আ’লীগে বাড়ছে অসন্তোষ

সভানেত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগের স্তূপ

প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

তারেক সালমান : দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের অভিযোগের শেষ নেই। অভিযোগ উঠেছে মনোনয়ন বাণিজ্যে অযোগ্যরা যেমন দলীয় প্রার্থী হচ্ছেন, তেমনি কোথাও কোথাও সুযোগ পাচ্ছে রাজাকার যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যরাও। এমন কি আওয়ামী লীগ না করেও নিচ্ছে দলীয় মনোনয়ন। আওয়ামী লীগের বেশ কিছু এমপি জেলা-উপজেলার নেতার বিরুদ্ধে তৃণমূল থেকে আসা অসংখ্য অভিযোগ প্রতিদিনই জমা পড়ছে সভানেত্রীর কার্যালয়ে।
এর মধ্যে রাজাকার যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্য, স্বজনপ্রীতি ও অর্থ লেনদেনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষার জন্য বিএনপি থেকে আসা নব্য আওয়ামী লীগারদের মনোনয়ন দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগের তালিকায় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা, স্থানীয় এমপি, এমনকি কেন্দ্রীয় নেতাদের নামও চলে আসছে। এর মধ্যদিয়ে দলটির তৃণমূলের রাজনীতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিভক্তি। মূলত এ কারণে শুধু বিদ্রোহী প্রার্থীই সৃষ্টি হয়নি, দলের মধ্যে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে অন্তর্কলহ। এতে দলটির তৃণমুলে বাড়ছে অনিয়ম-অসন্তোষ আর হানাহানি।
তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের দাবি, দলীয় ব্যানারে প্রথমবার ইউপি নির্বাচন সবার জন্যই নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে এ ধরনের ছোটখাটো সমস্যা থাকবে। তারপরও সব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
রাজাকার পুত্রের হাতে নৌকা প্রতীক দেয়ার অভিযোগ এসেছে সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু এমপির বিরুদ্ধে। পেশীশক্তি প্রয়োগ, তৃণমূলের ভোটে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট প্রদানে বাধ্য করা ও আর্থিক অনৈতিক লেনদেন করে তৃণমূল ভোটে রাজাকার পুত্র ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মীর মঞ্জুর এলাহীকে জেতানো হয়েছে। এ অভিযোগ পাবনার কাশিনাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. খোরশেদ আলমের। তিনি অভিযোগ করেন, এ বিষয়ে পাবনা প্রেসক্লাবে ভিআইপি অডিটোরিয়ামে তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন।
খোরশেদ আলম বলেন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐতিহাসিক ডাববাগান যুদ্ধে পাকিস্তানীবাহিনীর সঙ্গে ওঁৎপ্রতভাবে মরহুম মীর মোহাম্মদ আলী (ঠান্টু মিয়া) জড়িত ছিলেন। তিনি পাকিস্তানী হানাদারবাহিনীকে তথ্য ও মুক্তিকামীদের অবস্থান সম্পর্কে জানান দিতেন।
অপরদিকে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে একাত্তরের কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পরিচিত চাঁদ আলি শিকদারের ছেলে মিজান শিকদারকে। তার বাবা একাত্তরের রাজাকারদের কমান্ডার ছিলেন। বড় ভাই স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। আর ছোট ভাইয়ের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে শেখ হাসিনার নৌকা প্রতীক। ইতোমধ্যেই যার মনোনয়নকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও বাদ-প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এমনকি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ-মানববন্ধনও করা হয়েছে। অথচ দলের হাইকমান্ড পালন করছেন নিরব ভূমিকা। এ বিষয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোল্লা নবুয়ত আলি বলেন, চাঁদ আলি শিকদার একজন কুখ্যাত রাজাকার ছিলেন এটি সত্য। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তিনি জেলও খেটেছেন। আবার জেল থেকে মুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করেন।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন শান্তি কমিটির সদস্য প্রয়াত আজাহারুল ইসলাম তালুকদারের ছেলে আ ন ম শওকত হাবিব লজিক এবং পুনট ইউনিয়নে মনোনয়ন পেয়েছেন আরেক শান্তি কমিটি সদস্যের ছেলে আব্দুল কুদ্দুস ফকির। তার পিতা মৃত মোহাম্মদ আলী ফকির। সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীর ইউনিয়নে পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আবদুল হামিদ। তিনি বালাগঞ্জ থানার (ওসমানীনগর উপজেলা আগে বালাগাঞ্জ থানার অংশ ছিল, পরবর্তীতে নতুন উপজেলা হয়েছে) রাজাকারের তালিকায় আবদুল হামিদের অবস্থান ১৫ নম্বর তালিকাভুক্ত রাজাকার। নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার শিমলবাড়ী ইউনিয়নে ৫ম ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মো. হামিদুল হক। তিনি ইউনিয়ন জামায়াতের উপদেষ্ঠা পরিষদের সদস্য। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ উপজেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশ বিশেষ সুবিধা নিয়ে তার নাম নৌকার জন্য সুপারিশ করে কেন্দ্রে পাঠিয়েছিল। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষুদ্ধ হয়েছেন।
সত্তর দশক থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাকিম চৌধুরী। যিনি এখনও রাজনীতি করছেন তৃণমূলেই। সাতকানিয়ায় চরটিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি। প্রার্থী বাছাই দায়িত্বও প্রাথমিকভাবে তার হলেও তিনিই জানেন না কেন্দ্রে পাঠানো তালিকা সম্পর্কে।
শুধু সাতকানিয়াই নয়; দক্ষিণ চট্টগ্রামের, বাঁশখালি, বয়ালকালি, পুটিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে প্রার্থী মনোনয়নে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ উপেক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনে সম্পৃক্ত হয়ে উঠছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরাও। আবার ইউনিয়ন, থানা, কিংবা উপজেলার সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে জেলা কমিটি কেন্দ্রে নিজেদের পছন্দের নাম পাঠাচ্ছে এমন অভিযোগও আছে। প্রতিদিনই এমন অভিযোগ জমা পড়ছে দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে। কিন্তু এসব অভিযোগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছায় কিনা তা নিয়েও সন্ধিহান তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
এদিকে অভিযোগ আছে যোগ্যতা থাকলেও নারী প্রার্থী বলে মনোনয়ন পাননি অনেকেই। এমন মানুষ মনোনয়ন নিচ্ছে যে হয়তো কখনও আওয়ামী লীগই করেনি। অথচ সুযোগে দলীয় মনোনয়ন হাতিয়ে নিচ্ছে।
এদিকে নীতি নির্ধারকদের দাবি সব অভিযোগই যাচাই বাছাই করছে তারা। অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠনও করছেন বলে জানান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি জানান, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে, আর্থিক লেনদেনসহ অন্য কোন অভিযোগ আওয়ামী লীগের কাছে আসেনি। এ ধরণের অভিযোগ পাওয়া গেলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেয়া হবে। মনোনয়ন নিয়ে যে অভিযোগগুলো উঠছে, সেই অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন বলেও জানান তিনি। তবে প্রার্থীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সাংগঠনিক শাস্তি বহিষ্কার সিদ্ধান্তে কিছুটা কৌশলী আওয়ামী লীগ।
এদিকে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থিতা পেতে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ স্বীকার না করলেও দলীয়ভাবে তা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। এ তদন্ত কমিটিতে সদস্য রয়েছেন ৩ জন। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলটির সভাপতিমন্ডলীর কয়েকজন নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কমিটির সদস্যরা হলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামান ভুঁইয়া ডাবলু ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজিত রায় নন্দী। দলীয় সূত্র জানায়, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল বলেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলে নানা ধরনের মানুষ, নানা ধরনের মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত শতভাগ সঠিকভাবে হয়েছে, এটা আমি বলব না। তবে জেলা-উপজেলা এবং ইউনিয়ন থেকে যাদের নামের তালিকা কেন্দ্রে এসেছে, তাদের মধ্য থেকেই মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে। তারপরও আমরা সবার অভিযোগ জমা নিচ্ছি। সেগুলো সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইউপি নির্বাচনে আ’লীগে বাড়ছে অসন্তোষ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ