Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অর্থ ফেরত নিয়ে এখনো ধূম্রজাল

প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর প্রায় ৩ মাস হতে চলছে। ফিলিপাইনের সিনেট শুনানিতে চুরি হওয়া রিজার্ভের আংশিক অর্থ বাংলাদেশ ফেরত পাচ্ছে বলা হলেও এখনো কোনো অর্থ উদ্ধার করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তাই চুরি হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধার নিয়ে এতদিন বিভিন্ন মহল সংশয় প্রকাশ করলেও গতকাল খোদ অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান ফিলিপাইন থেকে অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এর আগে শুনানিতে তৃতীয় কোনো পক্ষ না থাকায় একতরফাভাবেই মামলা চলছে বলে ফিলিপাইন দাবি করে। যদিও অর্থ ফেরত পেতে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ফিলিপাইনের অ্যান্টি মানিলন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে এখনো কোনো অর্থ আসেনি। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডি কর্মকর্তারা ফিলিপাইন গেলেও তারা আংশিক টাকা উদ্ধারে এখনো কিছুই করতে পারেনি। এই টাকা ফেরত আনার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তও হয়নি। এদিকে গত বুধবার রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদন্তে সরকার গঠিত সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। রিপোর্টে কী আছে, সেসব বিষয়ে এখনো কেউ মুখ খোলেননি। যদিও রিপোর্টে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের চরম গাফিলতির বিষয়টি উঠে এসেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চার কর্মকর্তার নামও উঠে এসেছে। এদিকে রিজার্ভ চুরি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন ও কবে নাগাদ টাকা ফেরত পাওয়া যাবে সে বিষয়ে জাতির সামনে বিশদ ব্যাখা দাবি করেছেন পিরোজপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডা: রুস্তম আলী ফরাজী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সব অর্থ ফেরত পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংককে অর্থ ফেরত পেতে এক যুগেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে বলে মত দিয়েছেন।
রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে একটি অনুষ্ঠানে সংশয় প্রকাশ করে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপাইন থেকে ফিরিয়ে আনতে সময় লাগতে পারে। ফিলিপাইন একবার বলে টাকা কালকেই দিয়ে দেবে, আবার বলে সময় লাগবে, এটা নিয়ে প্রথম থেকেই আমার মনে একটা সন্দেহ ছিল। এর হয়তো ব্যাখ্যা আছে, এটা হয়তো তাদের ইচ্ছাকৃত নয়, সিস্টেমটাই হয়তো এ রকম। অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির বিষয়টি সরকার খতিয়ে দেখছে, তবে সেটা ফিলিপাইনের মতো হয়তো নয়। আমরা আমাদের মতো করে ফলোআপ করছি। আমার ধারণা, বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা টাকা উদ্ধারে নিউইয়র্ক ও কলম্বোতে ঘোরাঘুরি করছেন।
এর আগে ফিলিপাইনে পাচার হওয়া রিজার্ভের অর্থ ফিরে পেতে দেরি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ম্যানিলায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ। দেশটির গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, আদালত পর্যন্ত গড়ানোয় এই জটিলতা। তবে অর্থ পেতে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ শিগগিরই দেশটির বিচার বিভাগে জমা দেয়ার কথাও জানান রাষ্ট্রদূত।
এদিকে রিজাল ব্যাংকের সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক দাবি করেছেন, পাচার হওয়া অর্থের বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানতে চাইলেও তা উদ্ধারে কোনো নির্দেশনা ছিল না। ফিলিপাইনে পাচার হওয়া রিজার্ভের বড় অংশ এখনো উদ্ধার হয়নি। তবে আশার কথা পুরো অর্থই ফিরিয়ে দিতে আন্তরিক দেশটির সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় শেষ হয়েছে সিনেটে ষষ্ঠ দফার শুনানি। শুনানি শেষে মুদ্রা পাচারবিরোধী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এবং সিনেট প্রেসিডেন্ট নতুন সরকার গঠনের আগেই এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া অর্থ ফেরত দেয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে এ সময়ের মধ্যেও অর্থ পাওয়া নিয়ে আশঙ্কার কথা শোনালেন ম্যানিলায় বাংলাদেশরে রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ। দেশটি গণমাধ্যমকে জানান, পাচার হওয়া অর্থ পেতে বিলম্বের আশঙ্কা করছেন তিনি। বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এপ্রিল বা মে’র মধ্যে অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা ছিল বাংলাদেশের।
এএমএলসির মাধ্যমে এ অর্থ স্থানান্তরের কথা। কিন্তু মামলা হওয়ায় তা এখন গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। উদ্ধার হওয়া অর্থ ফিরে পেতে তাই অপেক্ষা আদালতের সিদ্ধান্তের। গোমেজ জানান, পুরো এবং জব্দ করা অর্থ পেতে বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি শিগগিরই ফিলিপাইন বিচার বিভাগে তথ্য-প্রমাণ জমা দেবে। এ নিয়ে কাজও এগিয়েছে অনেক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, টাকার একটা বিরাট অংশ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে গেছে, ক্যাসিনোতে খরচ হয়ে গেছে। তাই এটাকে ফিরিয়ে আনা বেশ কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোলে হয়তো এ টাকা ফেরত পেতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, সহজে এ টাকা ফেরত আনা যাবে না। বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের আদালতের রায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে এলে অর্থ ফেরত পেতে তিন থেকে সর্বোচ্চ ১২ বছর সময় লাগতে পারে বলে ওই সূত্র মনে করছে।
ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) জানিয়েছে, বেহাত থাকা ৬৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩৬১ কোটিই ফিলিপাইনের জুয়ার আসর ক্যাসিনোতে খরচ হয়ে গেছে। বাকি টাকা ফিলিপাইন থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর করা হয়েছে। এএমএলসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশটির সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এটা খুবই অস্পষ্ট যে, চুরি হওয়া অর্থের মধ্য থেকে এএমএলসি কতটা জব্দ করতে পারবে বা কী পরিমাণ অর্থ আমরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে ফেরত দিতে পারব, তা বলা সম্ভব নয়।
রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া সব ডলার ফেরত পাওয়া নিয়ে এর আগে সংশয় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেছেন, চুরি যাওয়া পুরো ডলার ফেরত নাও পাওয়া যেতে পারে।
এদিকে গত রোববার সংসদ সদস্য ডা: রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লোপাটের ঘটনায় অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী এর দায়িত্বে আছেন। তাকেই এ ব্যাপারে জাতির সামনে বিশদ ব্যাখ্যা দিতে হবে। তিনি বলেন, এই ঘটনায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী কী ব্যবস্থা নেবেন, তা তিনি সংসদকে জানাবেন। এটা জাতি জানতে চায়। কারণ যদি বারবার দেশের টাকা যায়, তাহলে সরকারের ভাবমর্যাদা নষ্ট হয়। ডা: রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, এটা নিয়ে অর্থমন্ত্রী ক্ষুব্ধ, আমরা জানি। কিন্তু জাতিকে আশ্বস্ত করতে হবে, আমরা কত দিনের মধ্যে চুরি হওয়া রিজার্ভ ফিরে পাব। আর ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, উদ্ধার হওয়া অর্থ ফেরতের বিষয়ে ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের সহযোগিতা করছে। তাই টাকাটা পাব বলে আশা প্রকাশ করছি।
টাকা ফেরত পেতে কতদিন সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, এটা বলা কঠিন। তবে মনে করি না বেশি সময় লাগবে। যদিও সবকিছু ফিলিপাইনের আইন ও নিয়ম অনুযায়ী হবে। তাই পুরো বিষয় ফিলিপাইনের ওপর নির্ভর করছে।
উল্লেখ্য, গত ৫ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে সঞ্চিত বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার (প্রায় ৮০০ কোটি টাকা) চুরি হয়। এর মধ্যে শ্রীলংকায় একটি শব্দের বানান ভুলে ২ কোটি ডলার লেনদেন আটকে যায়। ওই অর্থ ছাড়া এই সময়ের মধ্যে কোনো অর্থই ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। যদিও টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে ফিলিপাইন বেশ আন্তরিকতা দেখাচ্ছে। এ পর্যন্ত ৬ বার সিনেটে শুনানি করেছে। জড়িতরা অর্থ ফেরত দেয়ার কথাও বলেছে। কিন্তু তা কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থ ফেরত নিয়ে এখনো ধূম্রজাল
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ