পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
॥ এ এম এম বাহাউদ্দীন ॥
লেখালেখি তেমন করি না। চোখ-কান খোলা রাখায় মাঝে মাঝে বিবেক তাড়া দেয়। তারপরও সময়ের অভাবে লেখা হয় না। বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীরা তাড়া দেন, বিশ্বরাজনীতির খবর রাখেন। আপনার লেখালেখি করা উচিত। বিপন্ন মানুষকে অভয় দেয়া আপনার নৈতিক দায়িত্ব। সেই তাড়না থেকে এই লেখা। পৃথিবীর দেশে দেশে চলছে হানাহানি। পশ্চিমাদের কূটচালে মুসলমানরা পর্যুদস্ত। আরবের পেটের ভিতর ‘বিষফোঁড়া’ ইসরাইল ছড়ি ঘোরাচ্ছে; অথচ মুসলিম দেশগুলো কলহ-বিবাদ করছে। নিজেরাই যেন নিজেদের ধ্বংস করবে। কিছু মুসলিম শাসকের অপরিণামদর্শী কর্মকা-ের মধ্যেও ‘টানেলের শেষ প্রান্তে আশার আলো’র মতোই আমি মুসলিম সম্প্রদায়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার যে গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে স্পষ্ট, বিধর্মীরা যত জ্ঞানী-মেধাবী হোক আগামীতে মুসলমানরাই পৃথিবী শাসন করবে। আল্লামা ইকবাল লিখেছেন ‘পাশ্চাত্যের যাঁতাকলে (পিষ্ট হয়ে) মানবতা ক্রন্দন করছে/ পাশ্চাত্যের অভিশাপে মানবজীবন বিপর্যস্ত/ হে, প্রাচ্যের জাতিসমূহ! তোমরা কি জান আজ আমাদের করণীয় কী?/ প্রাচ্যের দিনগুলো পুনরায় আলোকিত হতে যাচ্ছে/ এর (প্রাচ্যের) হৃদয়ে বিপ্লব দানা বেঁধে উঠছে/ রাত্রি অতিক্রান্ত হয়েছে এবং সূর্য উদ্ভাসিত হয়েছে/ তার (পাশ্চাত্য) কারণেই মানুষের যাবতীয় সমস্যা/ আর তার কারণেই মানবতার যত ভোগান্তি।’ মুসলমানদের এই অন্ধকার হয়তো থাকবে না। বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি যখন মুসলমানদের হাতে আসবে তখন ইসলামের ঝা-া পশ্চিমা দেশগুলোতেও উড়বে। আলামত ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
আমি দেখছি ধীরে ধীরে পৃথিবীর পুরো দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। এ যেন মহাকবি ইকবালের কবিতার মতো। যেখানে তিনি বলেছেন, ইসলাম ধর্মাবলম্বী জাতিসমূহের অবস্থা এ পৃথিবীতে সূর্যের মতোই। পশ্চিম দিগন্তে ডুবে গেলেও একটি সময় পার হওয়ার পর তা আবার পূর্ব দিগন্তে উদিত হবেই। বিশ্ব মুসলিমের দেড় হাজার বছরের পথপরিক্রমার সার-সংক্ষেপ মোটামুটি তাই-ই। এখন চারদিকে হতাশার চিত্র। মুসলমানদের জন্য ভাল খবর নেই বললেই চলে। কেবলই ধ্বংস আর বিপর্যয়ের খবর। গভীর পর্যবেক্ষণ ও দূরদৃষ্টি দ্বারা চলমান ঘটনাবলীর ভেতর মঙ্গলের ইশারা খুঁজে পাওয়া সাধারণের জন্য সহজ কাজ নয়। যারা বোঝার চেষ্টা করেন তারা ঠিকই বুঝতে পারছেন। অবশ্য কোরআন-সুন্নাহ, ইতিহাস ও দর্শন আমাদের এ কাজটিই করতে বলে। দুনিয়ার বাস্তবতাও নিঃসন্দেহে এমনই।
৬৫৬ হিজরিতে হালাকু খানের হাতে ইসলামী বিশ্বসাম্রাজ্যের রাজধানী বাগদাদ ধ্বংস হয়। মুসলিম জাতির ওপর আপতিত ইতিহাসের বৃহত্তম বিপর্যয়ের একটি ছিল এটি। আটশ’ বছর আগেকার পৃথিবীতে ১০ লাখ মানুষ নিহত হওয়া মানে আধুনিক সময়ে ১০০ কোটির জনসংখ্যা ধ্বংস হওয়ার সমান। হালাকু-চেঙ্গিসি হামলায় দজলা ও ফোরাত নদীর পানি প্রথমে লালবর্ণ ধারণ করে মুসলমানের রক্তে। এরপর তা কালো রং ধারণ করে যখন বাগদাদের গবেষণাগার ও গ্রন্থাগারগুলো জ্বালিয়ে কয়লা, ছাই ও কালি নদী দুটোতে নিক্ষেপ করা হয়। ইতিহাসবিদরা লেখেন, দজলা-ফোরাত নদীর পানি ব্যবহার উপযোগী হতে প্রায় ছ’মাস সময় লেগেছিল। এই বিপর্যয়ের পরও মুসলিম জাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিছুকাল পর তুরস্কে ওসমানী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মিশর ও শ্যামে ইসলামী শাসন অটুট থেকেছে। ইয়েমেন ও হিজাজে পেয়েছে দ্বীনি কার্যক্রমের পূর্ণ গতিময়তা। সিন্ধু ও হিন্দুস্থানে মুসলিম শাসন পূর্ণ প্রতাপে প্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত হয়েছে।
অধ্যাত্মিক দার্শনিক মনীষীদের মূল্যায়নে, তাতারিদের হাতে নিহত ১০ লাখ মুসলমান মজলুম অবস্থায় শাহাদাত বরণের মাধ্যমে জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে আল্লাহর দরবারে নাজাত ও উচ্চমর্যাদা লাভ করেছেন। আর বাগদাদ ও পারস্যের অসংখ্য প্রতিভা বাধ্য হয়ে অন্য কোনো দেশে হিজরত করে স্থায়ী আবাস গ্রহণ করে। এতে উপমহাদেশ, দূরপ্রাচ্য ও উত্তর মেরু পর্যন্ত ইসলামের অনুসারী বাগদাদ ও পারস্যভিত্তিক নেতৃস্থানীয় মানুষ মুসলিম বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। তাছাড়া ঈমান, বিশ্বাস, চেতনা, জীবন-দর্শন ও মনোজাগতিক বিপ্লবের পথ ধরে উলামা-পীর-মাশায়েখ-ইসলাম প্রচারকদের হাত ধরে লাখো মানুষ ইসলামে প্রবেশ করে। আফগানিস্তান থেকে থাইল্যান্ড পর্যন্ত ৮০ কোটি মুসলমান বলতে গেলে বাগদাদের বিপর্যয়েরই প্রতিদান। ১০ লাখ লোক জীবন দিয়ে যে বিপ্লবের ধারা তৈরি করে গিয়েছিলেন তারই প্রভাব বিস্তারিত হয়ে এখন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ১৭০ কোটি মুসলমানের অভিলাষকে উদ্দীপ্ত করছে। বিপর্যয়ের কিছুকাল পরেই দরবেশ শায়খ জামালউদ্দীন ও তাঁর পুত্র শায়খ আরশাদ উদ্দীনের দ্বীনি প্রচেষ্টায় তাতার যুবরাজ খসরু কায়খান তার গোটা সম্প্রদায়সহ একদিনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাতারি জাতি পরিণত হয় ইসলামের সেবক ও সৈনিকে। এরপর তাদের উত্তর-পুরুষেরাই বিশ্বের বুকে মুসলিম সাম্রাজ্য কায়েম করে ইতিহাসে খ্যাতিলাভ করেন। মহাকবি ইকবাল এ বিষয়টিও তার কবিতায় এনেছেন। কবির ভাষায়, তাতারিদের ইতিহাস থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, শত্রুর ঘরেও ইসলামের প্রহরী জন্মাতে পারে। দেবালয়েও তৈরি হতে পারে পবিত্র কাবা’র ভক্ত ও রক্ষী।
বলছিলাম দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যাওয়ার কথা। এই তিন-চার মাসেই দেখুন, পৃথিবীর দেশে দেশে কত কী ঘটে যাচ্ছে। আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ভারত মন্ত্রী মোখতার আব্বাস নকভীকে মিশর পাঠানোর পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দমোদর মোদী গিয়েছেন সউদী আরব সফরে। এর আগে তিনি পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে আজান শুরু হওয়ায় মাইকে বক্তৃতা বন্ধ রেখেছেন। বলেছেন, সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে হবে, আজান হচ্ছে ভারতের ঐতিহ্য বা পরম্পরা। তিনি আজমির শরীফে গিয়ে চাদর চড়িয়েছেন গায়ে। দলীয় নেতৃবর্গের সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি সদলবলে পাকিস্তান সফরে গিয়ে লাহোরে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের বাড়ি পর্যন্ত ঘুরে এসেছেন; আবুধাবীর বড় মসজিদ পরিদর্শনে গিয়েছেন। এসময় তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে গিয়েছিলেন। এবারকার সফরে সউদী আরবের সাথে ভারতের সম্পর্ক আরো ব্যাপক ও গভীর করার জন্য সব রকমের কূটনৈতিক প্রক্রিয়া জোরদার করেন। সউদী আরবের সঙ্গে ভারতের অনেকগুলো সমঝোতা ও চুক্তি সম্পাদন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কী পরিমাণ সখ্য এখন ভারতের তা ভেবে পর্যবেক্ষক মহল হয়রান। বর্তমান আরএসএসের ভাবশিষ্য বিজেপির ক্ষমতারোহণ ও দেশ শাসন সবই নতুন বিশ্বরাজনীতির প্রভাব। যারা বিশ্বরাজনীতির খবরাখবর রাখেন সউদী আরব-পাকিস্তান সম্পর্ক তাদের সবারই জানা। এরই মধ্যে চীনের সাথে পাকিস্তানের অধিক মাখামাখি যুক্তরাষ্ট্রকেও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের সর্বশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতি আমেরিকা ও ভারতকে পাকিস্তান ও সউদী আরবের সাথে হিসেব করে চলার তাগিদ দিতে পেরেছে বলে মনে করা হয়। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক আচরণ যে রকমই হোক রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকার মুসলমানদের সাথে ইতিবাচক ভাব বজায় রাখাকেই ভারতের জন্য কল্যাণকর মনে করছে। ২০৫০ সাল পর্যন্ত আইএসের আদি খোরাসান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চিন্তা গোটা অঞ্চলের জন্যই দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দেবে। তাছাড়া আইএসের উদ্গাতা বা চালিকাশক্তি নিয়ে এখনও অস্পষ্টতাই বিরাজ করছে। অতি সম্প্রতি চীন মন্তব্য করেছে যে, ভারত সুন্দরী তরুণীর মতোই সব পুরুষের পছন্দের হয়ে থাকার চেষ্টার মতো আচরণ করছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর বলয়সংশ্লিষ্ট থাকা আবার কারো বৃত্তে পূর্ণ যুক্ত না হওয়ার কঠিন কাজটিই ভারতকে করতে হচ্ছে। এ ধরনের অস্থির কূটনীতি আর সতর্ক রাজনীতির ভেতর দিয়ে বিকশিত হচ্ছে ভারতের অভ্যন্তরীণ অবস্থা। আগামী ২০৫০ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মুসলমানের দেশ হতে চলেছে ভারত। এমনকি ইন্দোনেশিয়ার চেয়েও অধিক মুসলমান থাকবে তখন ভারতে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি মিলিয়ে তখন বিশ্বের অর্ধেক মুসলমানই এ অঞ্চলে বাস করবে। বিশ্ব রাজনীতির চিন্তাশীল নেতারা ইসলামের অগ্রগতি রোধে মিশনারি তৎপরতা, ধর্মবিদ্বেষী এনজিও, হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির প্রসার, নাস্তিকতা প্রচার, সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক উস্কানি, মুসলিম জন্মহার কমানো, নাগরিকত্ব বাতিলসহ নানাবিধ কার্যক্রমের কথা ভেবে থাকেন। জনসংখ্যা বা উঠতি শক্তি বাধাগ্রস্ত করার জন্য গণহত্যার মতো কর্মসূচিও সংঘটিত হয়ে থাকে। যুগে যুগে আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ ও দূরপ্রাচ্যে এসব দেখা গেছে। এ অঞ্চলেও মুসলমানদের সবদিক বিবেচনা করে তাদের মূল পরিচয়ে অটল থাকতে হবে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও চীনের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল প্রভৃতির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষক মহলের নজরে আশাপ্রদ হয়েই ধরা পড়ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিদেশি শক্তির শক্তিমত্তা প্রদর্শনে বহু দেশ ধ্বংস হলেও রাজনৈতিক মেরূকরণ ভালো রকমেই হয়েছে। লিবিয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য ঠিক ইরাকেরই মতো। রাশিয়ার আফগানিস্তান অভিযানের মতোই আমেরিকার আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া প্রভৃতি অভিযান কোনোটাই আখেরে লাভজনক হয়নি বলেই তারা দেখতে পাচ্ছে। সময়ে সবই আরো স্পষ্ট হতে থাকবে। ভিয়েতনামে আমেরিকার পরিণতি কে না জানে?
আমেরিকা তোষণনীতির চর্চায় অভ্যস্ত সউদী আরবকেও সচেতন করছে বিপদের অশনি সংকেত। ১০০ ডলারের তেলের মূল্য ৩০ ডলারে নেমে আসায় দেশটির বাজেট এখন ঘাটতির মুখে। এই প্রথম সউদী আরব ঋণ নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করল। সিরিয়া-ইয়েমেন পরিস্থিতি তাদের নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতির সাথে প্রতিরক্ষা বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহযোগিতা চুক্তির পর এখন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মাঝে ঐক্য, সংহতি ও সমন্বয়ের কাজ চোখে পড়তে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক বিষয়ে তেলনির্ভরতা কমানোর প্রেক্ষিতে সউদী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও উপ-যুবরাজ প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান ১৩ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন, ৮ বছরের মধ্যে যা ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হবে। মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যাপল ও আমাজনের মতো চারটি কোম্পানি কিনে নেয়ার মতো সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে প্রিন্স মুহাম্মদ সউদী আরবের অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যে ইসলামিক আর্মি গঠিত হয়েছে। রিয়াদে এর হেডকোয়ার্টার্স হচ্ছে। ৩৪টি মুসলিম দেশের সশস্ত্র বাহিনী ঐক্যবদ্ধভাবেই সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য মোকাবিলায় পারস্পরিক সহযোগিতার সমঝোতায় এসেছে। এর আওতা ও কর্মপরিধি আরো বাড়বে।
সর্বশেষ সউদী বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সউদ তাঁর কায়রো সফরে মিশরীয় প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির সাথে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন। মিশর সীমান্তে সউদী মানচিত্রভুক্ত দু’টি দ্বীপ সউদী আরবকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুহম্মদ মুরসি ও ইখওয়ান নেতাদের বিষয়ে একটি সমঝোতামূলক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সে অঞ্চলে অস্থিরতা কমিয়ে আনার ধারণা করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি সাধারণ মানুষের নজর কেড়েছে সেটি হল, সউদী আরব মিশরকে প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে কাছাকাছি আনার জন্য সমুদ্রের উপর ১৭ মাইল দীর্ঘ সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা, যা বাস্তবায়িত হলে সত্যিকার অর্থেই মধ্যপ্রাচ্যের দু’টি প্রভাবশালী শক্তির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হবে। মিশর, তুরস্ক ও সউদী শক্তি অল্প সময়ের মধ্যেই ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিতে পারবে। আরো আশার কথা হচ্ছে, যে ঐতিহ্যবিরোধী চিন্তা নিয়ে তুরস্কের খিলাফত ধ্বংসে কিছু সম্প্রদায় কাজ করেছিল তারাই এখন খিলাফতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছেন। এরপর সউদী বাদশাহ সালমান তুরস্ক সফর করেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের সাথে সউদী বাদশাহর সাক্ষাৎ ও আলোচনা বরাবরই মুসলিম বিশ্বকে আশাবাদী করে তোলে। এসব নেতার সম্মিলিত একটি আহ্বান গোটা পরিস্থিতির রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম। সিরিয়া প্রশ্নে রাশিয়ার একগুঁয়েমি কত কঠোরভাবেই না তুরস্ককে মোকাবিলা করতে হয়েছে। সউদী নেতৃত্বের সাথে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তাতে খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে ছিল একই প্রত্যয়। আঞ্চলিক সন্ত্রাসপ্রবণ শক্তির মোকাবিলায় ওআইসি ছিল সোচ্চার। সংস্থাটির নতুন চেয়ারম্যান তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ওআইসিকে আরো কার্যকর করতে সক্ষম হবেন বলেই সউদী বাদশাহ সালমানসহ বিশ্ব মুসলিম শীর্ষ নেতারা গিয়েছেন সুলতান মুহাম্মদ, সুলায়মান, মুরাদ ও আবদুল মজিদের তুরস্কে। নতুন বিশ্বশক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা ও সম্ভাবনার রূপকার তুরস্ক এখন বিশ্বমুসলিমের দৃপ্ত আশাবাদ। এ সপ্তাহেই ‘থ্যাংকস টার্কি’ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় মুসলিম বিশ্বের ৫০ জন শীর্ষ ইসলামী চিন্তাবিদ ও আধ্যাত্মিক নেতাকে তুরস্কে দাওয়াত করে নিয়ে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ সাধনের কর্মপন্থা বিষয়ে মিটিং করেছে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোর মন্তব্য ছিল, তুরস্ক তার বহুমুখী কাজের সূচনা করেছে এবং সিমেন্ট জমাট বাঁধার অপেক্ষায় কিছু সময় পার করছে।
সউদী আরব ঘুরে গেলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসাইন ওবামা। তিনি উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের সম্মেলনে শীর্ষ আরব নেতাদের বৈঠকে যোগ দেন। ৯/১১ ট্র্যাজেডিতে সউদী নাগরিক জড়িত থাকায় সউদী আরবকে সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত করার আইনগত বিধান জারির প্রতিবাদে সউদী বাদশাহ বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী সুস্পষ্ট ভূমিকা সত্ত্বেও যদি তার দেশকে দায়ী করা হয় তাহলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বন্ডে ৭৮১ বিলিয়ন ডলারসহ অন্যান্য সউদী পুঁজি তুলে নেবেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সউদী আরব সফরে আসেন বারাক হোসাইন ওবামা। এরপর আরব দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে গালফে মিলিত হন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। পরদিন তিনি সিরিয়া ও ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে কুয়েতে বৈঠক করেন। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণায় এবারকার সফরে মার্কিন নেতা ছিলেন কৌশলগত বেকায়দায়। সউদী টিভি চ্যানেল আখবারিয়ার রিপোর্টে বাদশাহ সালমান ও প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও আলোচনায় এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। বিশেষ করে বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য ওবামার সউদী আরব আগমনের সময়কার পরিবেশ ও বর্তমান সফরের পরিবেশে পার্থক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি, ইরান, ইরাক, ইয়েমেন, মিসর, সিরিয়া, আইএস প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার কার্যপদ্ধতির প্রভাবেই এ পরিবর্তন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ (চঊড) রিসার্চ সেন্টার বিশ্ব জনসংখ্যার ধর্মভিত্তিক হার ২০১০-২০৫০ শীর্ষক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তার বিবরণ খুবই প্রণিধানযোগ্য। এতে দেখা যাচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ইউরোপে সামগ্রিকভাবে মুসলিম জনসংখ্যা পৌঁছে যাবে দ্বিতীয় স্থানে। জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ উল্লেখযোগ্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মূল নিয়ন্তা ও চালিকাশক্তি হবে নতুন মুসলিম শক্তি। আমেরিকার অবস্থানও একই। পিউ সেন্টারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০৫০ সালে ইসলাম হবে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রধান জনসংখ্যার ধর্ম।
সিরিয়ায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, বছরের পর বছর ধরে গণহত্যা ও দেশত্যাগের দুঃখ মুসলমানদের অন্তরকে রক্তাক্ত করলেও এর মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে কী ধরনের পরিকল্পনা কার্যকর হচ্ছে তা ভবিষ্যতেই স্পষ্ট হবে। যে পরিমাণ সিরীয় আরব মুসলমান পশ্চিমা দেশসমূহ বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় শরণার্থী হয়ে প্রবেশ করেছেন, তারা একদিন সেখানে সমাজ ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠবেন, এটাই স্বাভাবিক। একটি ভূখ-ে একজন মুসলিমের উপস্থিতিও মহান ইসলামেরই বার্তা প্রেরণ (এ উপমহাদেশে যা ঘটেছে)। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে প্রথম এক-দু’জন ব্যক্তিই ইসলামের মুক্তির বাণী নিয়ে গিয়েছিলেন। ইউরোপে হাজার হাজার মুসলমানের অভিবাসন অদূর ভবিষ্যতে সে ভূখ-ে বড় ধরনের সাংস্কৃতিক বিবর্তন আনবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও হিজরতকারী আরব মুসলমানরা ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এ পরিবর্তনের বিষয়টি ইউরোপীয় গবেষক ও চিন্তাবিদরা অনুধাবন করেন বলেই মুসলমানদের প্রতি অসহিষ্ণুতা উস্কে দেয়া হচ্ছে। মুসলমানদের ঠেকিয়ে রাখতে সন্ত্রাস-মৌলবাদী তকমা দিচ্ছেন। সন্ত্রাস দমনের নামে সারাবিশ্বে মুসলিম নিধন কর্মপন্থা চালাচ্ছেন। মুসলমান শাসকদের মধ্যে কেউ বুঝে কেউ না বুঝে তাতে শামিল হচ্ছেন। আমেরিকা ইউরোপের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ইসলামের প্রতি দরদ বাড়ছে। ওই সব দেশের মসজিদ ভরে যাচ্ছে মুসল্লিতে। তারপরও রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্দা, হিজাব, টুপি, দাড়ি, আরবি ভাষা ইত্যাদি নিয়ে সংকীর্ণ মনোবৃত্তির পরিচায়ক বহু ঘটনা ইদানীং পশ্চিমা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে। মহিলা শিক্ষিকার সাথে করমর্দন না করার ফলে সুইজারল্যান্ডে মুসলিম স্কুলছাত্রকে হেনস্থা করা হয়েছে। ‘ইনশা আল্লাহ’ বলায় বিমান থেকে মুসলিম যুবককে এবং অপরিচিত অসংযত যাত্রীর পাশে বসতে না চাওয়ায় হিজাবপরিহিতা মুসলিম নারীকে আমেরিকায় বিমান থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ায় মাঝে মাঝেই মসজিদে হামলা, মুসলিম পথচারীর ওপর হামলা প্রভৃতি ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে, যা আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্থানের পথে অগ্রসর মুসলমানের অগ্রযাত্রা দেখে আদর্শিক দেউলিয়া এবং নৈতিক অক্ষমের বিদ্বেষ ও ঈর্ষা মাত্র।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিশ্বনবী (সা.)-এর প্রতি কটূক্তি ও বিষোদ্গার করার চেষ্টা, ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশের প্রবণতাÑএ অন্যায় কাজটিকে আবার বহু বিশ্বনেতা সমর্থনও করছেন। আর এটাই হচ্ছে বিশ্বনেতৃত্বের আধ্যাত্মিক পালাবদলের বড় কার্যকারণ। প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার দৃশ্যপট পরিবর্তনের প্রধান মাধ্যম। ইতিহাসে প্রমাণ রয়েছে, বিশ্বনবী (সা.)-এর প্রতি আল্লাহর সত্যবাণী ও শান্তির দর্শনের ধারক-বাহক শক্তির সাথে বেয়াদবি যারাই করেছে তারা বিশ্বের দৃশ্যপট থেকে তিরোহিত হয়েছেন। তাদের স্বদেশভূমি চলে এসেছে উম্মতে মুহাম্মদীর হাতে। মূলত তা হয়েছে ব্যাপক হারে সেসব অঞ্চলের জনগণের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে। কেননা, আল্লাহর শেষ নবী, চূড়ান্ত ধর্মগ্রন্থ ও মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলাম ছাড়া পৃথিবীবাসীর সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ মুসলমানদের হাতে আসা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও ব্যাপক প্রতিকূলতার মাঝেও বিশ্ব মুসলিম জাতির বিপুল বিশাল উত্থান এর জ্বলন্ত প্রমাণ। পশ্চিমা সরকারগুলো ইসলামের বিপক্ষে যতই আতঙ্ক ছড়াক; ইসলামের বিজয় অবধারিত। গোটা বিশ্বের রাজনীতি একদিন মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। দিব্যজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয় না। কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করিয়াছ মহান/তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান।’ খ্রিস্টান-ইহুদি গোষ্ঠীর অপপ্রচারে মুসলমানদের বর্তমানের এই দুর্দশাই একদিন তাদের সম্মানীয় স্থানে নিয়ে যাবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।