Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ভ্যাপসা গরমে দুর্বিষহ জীবন

বৈশাখ জুড়ে চলবে অসহনীয় তাপদাহ

প্রকাশের সময় : ২৫ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : অসহনীয় গরমে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জীবনযাত্রা। গুমোট ও তপ্ত আবহাওয়ায় চলছে টানা খরার দহন। প্রত্যাশিত বৃষ্টি নেই। সর্বত্রই ভ্যাপসা গরমের যন্ত্রণা। দিনে-রাতে তাপদাহে অবিরাম ঘাম ঝরে খুব দ্রুত কাহিল এমনকি অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। চৈত্রের শেষ সপ্তাহ থেকে ক্রমশ তেঁতে উঠেছে আবহাওয়া। ফল-ফসলের আবাদ ও ফলনের উপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। খুব শিগ্গির খরতপ্ত আবহাওয়ার উন্নতির পূর্বাভাস নেই।
বৈশাখ মাসজুড়ে চলবে এহেন অসহনীয় তাপদাহ। খরার দহন আরো বাড়তে পারে। বর্তমানে সারা দেশে তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঁচুতে রয়েছে। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার সাথে রাতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও অস্বাভাবিক তেঁতে আছে। এ কারণে গরম আরো অসহনীয় হয়ে উঠেছে। গতকাল (রোববার) রাজশাহী বিভাগে যখন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সে. ছুঁইছুঁই তখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, এমনকি সৈকত শহর কক্সবাজারসহ দেশের অনেক জায়গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৮ থেকে ২৯ ডিগ্রিতে অর্থাৎ অস্বাভাবিক উঁচুতেই ছিল। আকাশে মেঘের আনাগোনা আছে। কিন্তু মেঘমালা ঘনীভূত হচ্ছে না। সিলেট বিভাগ ছাড়া দেশের আর কোথাও প্রত্যাশিত বৃষ্টি ঝরছে না। যাও হচ্ছে তা ছিঁটে-ফোটা। পুকুর, দীঘি, মাঠ-ঘাট খাল-বিল শুকিয়ে ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে। নদ-নদী ঠেকেছে তলানিতে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও অনেকটা নেমে গেছে।
গতকাল সকালে চট্টগ্রামে দমকা হাওয়াসহ অল্পক্ষণ বৃষ্টিপাতের পর ভ্যাপসা গরমের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। গত মার্চ ও চলতি এপ্রিল মাসে বঙ্গোপসাগরে একাধিক নিম্নচাপ সৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও তা এখন পর্যন্ত হয়নি। পূবালী বায়ুমালার সাথে পশ্চিমা বায়ু মিলিত হচ্ছে না। এ কারণে মেঘ-বাদলের ঘনঘটা তৈরি হয়নি। পূর্বাভাস মতে, প্রত্যাশিত বর্ষণের জন্য বৈশাখের শেষ দিকটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। চলতি এপ্রিল মাসে সারা দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হারে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত সিলেট বিভাগ ছাড়া দেশের অন্য কোথাও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়নি। গত মার্চ মাসে সারা দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে সার্বিকভাবে ৪৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে বেশি বৃষ্টি হয় ৩৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ সংলগ্ন উত্তর বঙ্গোপসাগরে এখনও লঘুচাপ-নিম্নচাপ না থাকলেও দেশের বৃহত্তর সমুদ্র উপকূলভাগে বিরাজমান টানা ভ্যাপসা গরম ও গুমোট আবহাওয়ার কারণে উপকূলবাসীর মনে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস বা সম্ভাব্য যেকোনো দুর্যোগের শঙ্কা দানা বেঁধে উঠছে।
তাপদাহের সাথে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং, বিভ্রাট আর পানির সঙ্কট যুক্ত হয়ে গরমের মাত্রা ও দহনজনিত কষ্টকে আরো অসহনীয় করে তুলেছে। সর্বত্র বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট তীব্রতর হয়ে উঠেছে। পানির উৎসগুলো অধিকাংশই শুকিয়ে গেছে। তাপদাহের কারণে কর্মজীবী দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি, সেইসাথে আয়-রোজগার কমে গেছে। খরতপ্ত আবহাওয়ায় ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পেটের পীড়া, চর্মরোগ ও বিভিন্ন মৌসুমি রোগ ব্যাধির প্রকোপ বেড়ে গেছে। বিশেষত বয়োবৃদ্ধ ও শিশুদের কষ্ট-দুর্ভোগ অবর্ণনীয়। হাসপাতাল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মৌসুমি রোগীর ভিড় বেড়েছে। খরার দহন যতই বাড়ছে শহর-বন্দর-গঞ্জের রাস্তাঘাটে বিভিন্ন ধরনের শরবত, ফল-ফলাদি, আইসক্রিম বিক্রি বেড়ে গেছে। এর বেশির ভাগই দূষিত হওয়ায় পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তীব্র গরমে চিকিৎসকরা ঘন ঘন বিশুদ্ধ পানি পানের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে রাস্তাঘাটের খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকতেও সতর্ক করেছেন।
এদিকে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সমানতালে বাংলাদেশেও ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) চট্টগ্রামের সম্প্রতি এক সেমিনারে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) অধ্যাপক ড. মো. রিয়াজ আক্তার মল্লিক তথ্য প্রকাশ করেন, বৈশ্বিক ক্রমবর্ধমান গতিতে উষ্ণায়নের ধারায় বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা গড়ে শূন্য দমমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এমনকি দেশের বিভিন্ন এলাকাভেদে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ৫০ বছর সময়কালে বৃষ্টিপাত বেড়েছে গড়ে প্রায় ২৫০ মিলিমিটার। বিগত ৫০ বছরের গড় বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে গরম ও শীত আরো তীব্র হয়ে উঠার আশংকাকেই দিক-নির্দেশ করছে।
আবহাওয়া-জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের প্রভাবে ভরা বর্ষায় স্বাভাবিক হার ও পরিমাণে বৃষ্টির দেখা মিলছে না। রুদ্র রুক্ষ হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। ক্রমেই বিদায় নিচ্ছে ঋতুর বৈচিত্র্য ও আলাদা বৈশিষ্ট্য। বৈরী আবহাওয়া-জলবায়ুর সরাসরি বিরূপ প্রভাব গিয়ে পড়ছে কৃষিখামার, জনস্বাস্থ্য, জীবনযাত্রা, উদ্ভিদ-জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ-প্রতিবেশসহ সর্বক্ষেত্রে। বরেন্দ্র জনপদসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চল তথা রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে মারাত্মক ধরনের অনাবৃষ্টির ধারাবাহিকতায় গোটা অঞ্চলটি অনেকটা মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
এদিকে, আবহাওয়া বিভাগ জানায়, পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এ মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ী দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র আকাশ অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। রাজশাহী অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। খুলনা বিভাগ, বগুড়া, ঈশ্বরদী, দিনাজপুর, ঢাকা, টাঙ্গাইল ও ফরিদপুর অঞ্চলসমূহে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এ তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় তাপপ্রবাহ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে।
চলতি সপ্তাহের (২৪ থেকে ৩০ এপ্রিল) আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানা গেছে, পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। এ সময়ে সিলেট বিভাগের অনেক স্থানে অস্থায়ী দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়াসহ মাঝারি ধরনের বৃষ্টি (১১ থেকে ২২ মি.মি.) অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসাথে সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণ ও শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এ সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে রংপুর, সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক স্থানে অস্থায়ী দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা (৪ থেকে ১০ মি.মি.) থেকে মাঝারি (১১ থেকে ২২ মি.মি.) ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। সেইসাথে কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টি হতে পারে। দেশের অন্যত্র আকাশ আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। দেশের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময়ে সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
যশোরে ৪১ ডিগ্রি সে.
সর্বশেষ গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় ঢাকায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যথাক্রমে ৩৯ ও ২৮.৪ ডিগ্রি সে., চট্টগ্রামে ৩৩.২ ও ২৯, সিলেটে ৩২.২ ও ২২.৭, রাজশাহীতে ৪০ ও ২৬.৪, রংপুরে ৩৭.৫ ও ২২.৫, খুলনায় ৩৯.৪ ও ২৭.৫, বরিশালে ৩৭.৫ ও ২৮.৭ ডিগ্রি সে.।
আবহাওয়া বিভাগ জানায়, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এ মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে।
আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং বরিশার বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ী দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সাথে বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র আকাশ অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলাসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
ফরিদপুর, রাজশাহী, মংলা, সাতক্ষীরা, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলসমূহের উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং চাঁদপুর, নোয়াখালী ও শ্রীমঙ্গল অঞ্চলসহ রংপুর ও বরিশাল বিভাগ এবং ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এ তাপপ্রবাহ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় তাপপ্রবাহ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে। বর্ধিত ৫ দিনে আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভ্যাপসা গরমে দুর্বিষহ জীবন
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ