Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

রফতানি সুবিধা অবহেলিত

নেপাল ভারত মিয়ানমার চীন ভুটানে চট্টগ্রাম হয়ে বাজার চাহিদা ব্যাপক

প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন দিকজুড়েই রয়েছে বিস্তীর্ণ বাজার সুবিধা নিয়ে সুবিশাল পশ্চাদভূমি। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামের সাথেই সম্পৃক্ত রয়েছে ব্যাপক রফতানি বাজার সম্ভাবনা। অথচ শুধুমাত্র সময়োচিত উদ্যোগের অভাবেই বছরে হাজার কোটি টাকা মূল্যের কমপক্ষে ৫০ ধরনের ভোগ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী রফতানির সুযোগ অবহেলিত রয়ে গেছে। বাজার সংকুচিত হয়ে আটকে আছে অবারিত এই পশ্চাদভূমি। নিকটতম প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকেই দীর্ঘ ঘুরপথে পণ্যসামগ্রী আমদানি ও সেখানে রফতানি করা হচ্ছে সিঙ্গাপুর সমুদ্রবন্দর দিয়েই।
অথচ দেশটির ইয়াঙ্গুন ও আকিয়াব সমুদ্রবন্দরের সাথে সরাসরি নৌ চলাচলের জন্য ‘কোস্টাল এন্ড মেরিটাইম শিপিং’ এবং ‘নন-কনভেনশনাল ভেসেল শিপিং’ চুক্তি নবায়ন ও সম্পাদন করা হলে বাংলাদেশে উৎপাদিত অনেক পণ্যসামগ্রীর বাজার সুবিধার আরও ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটবে নিশ্চিতভাবেই। অনুরূপ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, নেপাল, চীন ও ভূটানেও ব্যাপকহারে পণ্যসামগ্রী রফতানির চাহিদা প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। অতি সহজপথে নিকটতম প্রতিবেশী দেশের মানসম্পন্ন পণ্যসামগ্রী ও সেবাপণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা ভোক্তাসাধারণের জন্য অনেকটাই সহজতর হয়ে উঠবে। এতে করে বাজার সম্ভাবনা ক্রমাগত খুলে যাবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক কর্মকা-ও আরও বিস্তার লাভ করবে।
বর্তমানে দীর্ঘ ঘুরপথে পণ্যসামগ্রী আনা-নেয়া করা বাবদ অহেতুক বাড়তি খরচ ও সময়ের অপচয় ঘটছে। সময় ও অর্থ সাশ্রয় করার জন্য বাংলাদেশের পণ্য আমদানির ব্যাপারে প্রতিবেশী অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছে। বর্ডার হাট ও স্থলবন্দর দিয়ে পণ্যসামগ্রী রফতানি চাহিদা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধ ও পেটেন্ট সামগ্রী, ভেষজ দ্রব্য, শাড়ী, বস্ত্র ও তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক পণ্যসামগ্রী, সিরামিক পণ্য, প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, আসবাবপত্র, কৃত্রিম অলংকার-গহনা, তথ্য-প্রযুক্তির সামগ্রী, আসবাবপত্র, হালকা ও মাঝারি আকৃতির কার্গো কোস্টার নৌযান, হালকা যন্ত্রপাতি, কেবলস, লোহা ও স্টিলস সামগ্রী, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও বেকার্স খাদ্যদ্রব্য, খেলনা প্রভৃতি পণ্যের ব্যাপক ভোক্তা চাহিদা প্রতিবেশী দেশসমূহে রয়েছে। এ অঞ্চলে আন্তঃবাণিজ্য প্রসারে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। এরজন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের যুগোপযোগী আধুনিকায়ন, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেস-ওয়ে নির্মাণ, চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার-ঘুনধুম পর্যন্ত বিশেষায়িত রেললাইন স্থাপন, নৌ-বন্দরের সাথে পণ্যসামগ্রী পরিবহন নেটওয়ার্কের উন্নয়ন করা অপরিহার্য। এসব ক্ষেত্রে আশু কার্যকর উদ্যোগ জরুরী।
চট্টগ্রামের পোর্ট-শিপিং বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, রফতানি বাণিজ্যে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর আঞ্চলিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ‘হাব’ বা সূতিকাগার হয়ে উঠতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ডলক্ড) এই বিশাল অঞ্চলে প্রাথমিক পর্যায়ে বাণিজ্যের সম্ভাব্য আকার-আয়তন হতে পারে পর্যায়ক্রমে বার্ষিক ৫শ’ জাহাজ এবং ১ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার। যার পরিমাণ ৫০ লাখ মেট্রিক টন থেকে ক্রমেই ১ কোটি মেট্রিক টন বা তার চেয়েও দ্বিগুণ মালামাল ডেলিভারী পরিবহন। সমুদ্রবন্দর ও বন্দরভিত্তিক কাস্টমসের ২০/২৫ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক রাজস্ব আয় সম্প্রসারণের সুযোগ বর্তমানে উপেক্ষিত রয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে আয় বৃদ্ধি পেতে পারে দেড় থেকে দ্বিগুণ পর্যন্ত। শিপিং ও পরিবহন সেক্টরে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের দিগন্ত খুলে যাবে উপরোক্ত প্রতিবেশী দেশগুলোতে বাজার সম্ভাবনার অপার ক্ষেত্র কাজে লাগানো সম্ভব হলে।
পোর্ট-শিপিং সার্কেলে জানা যায়, বাংলাদেশের বন্দর সম্পদই সর্ববৃহৎ এক সম্পদ। সমুদ্র বন্দরের রয়েছে বিশাল হিন্টারল্যান্ড অর্থাৎ পশ্চাদভূমি। দেশ ও জাতির ভাগ্যেন্নয়নে বহুমাত্রিক সম্ভাবনার ধারক এবং প্রবেশদ্বার হচ্ছে এই বন্দর। বর্তমানে বন্দর সুবিধা আংশিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। এ কারণে ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে দেশ। অথচ চট্টগ্রাম জেলার সমান ছোট্ট দেশ, এককালের ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠির জেলেপলী উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গিয়ে হয়েছে আজকের সিঙ্গাপুর মহা-সমুদ্রবন্দর বা মাদার ট্রানজিশনাল পোর্ট। নিকট অতীতে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম পণ্যসামগ্রী রফতানি কাজে বন্দরের ব্যস্ততার পাশাপাশি শিপইয়ার্ডে নির্মিত জাহাজও রফতানি করে কোটি কোটি ডলার আয় করছে। সেই মহাসুযোগ বাংলাদেশেরও হাতের মুঠোয়। বন্দর-সম্পদের অমিত সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করলে দেশ ও জাতি নিশ্চিতভাবে লাভবান হতে পারবে। এতে করে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে নিশ্চিতভাবে।
চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং প্রস্তাবিত মহেশখালীর সোনাদিয়া অথবা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের আন্তঃবাণিজ্যের চাহিদা ও উপযোগিতা রয়েছে ব্যাপক। এর ব্যাপ্তি ও পরিসর অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সমুদ্র বন্দরের লাভজনক ব্যবহারের ক্ষেত্রে চাহিদা, গুরুত্ব বিবেচনা ও পরিমাপ করা হয় বন্দরের পশ্চাদভূমি বা হিন্টাল্যান্ড সুবিধা দিয়েই। ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান, অবকাঠামো সুবিধা এর জন্য প্রধান বিবেচনার বিষয়। এর প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের রয়েছে তিন দিক থেকে রয়েছে বিস্তৃত রফতানি বাজার সুবিধা। বন্দরকে কোন কোন এলাকা, দেশ কিংবা অঞ্চল কত পরিমাণ ব্যবহার করতে পারবে, ব্যবহারকারী দেশের জনসংখ্যা ও ভোক্তা চাহিদা, উন্নয়ন পরিকল্পনা, ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান প্রভৃতি বিষয়ই বন্দর হিন্টারল্যান্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।
উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘দ্য সেভেন সিস্টার’ হিসেবে পরিচিত ৭টি রাজ্য বিশেষ করে ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, মনিপুর, নাগাল্যাান্ড এবং নেপাল ও ভূটান, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশসহ পশ্চিম-দক্ষিণ মিয়ানমার, কুনমিন প্রদেশসহ দক্ষিণ চীন মিলিয়ে বিরাট একটি অঞ্চলের জন্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ‘আঞ্চলিক হাব-পোর্ট’ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে অতি সহজেই এবং খুব সহসাই। এর জন্য সড়ক ও নৌপথ সংস্কারসহ কিছু অবকাঠামো সুবিধা প্রসারিত করা অপরিহার্য। প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল নির্মিত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো সুবিধা তথা সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর ভোক্তাসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে রফতানি বাজার সম্প্রসারণের অপার সুযোগ রয়ে গেছে। অথচ বর্তমানে ভারত, মিয়ানমার, ভূটান, চীন থেকে অবৈধ পথে আনীত পণ্য তথা বেপরোয়া চোরাচালানেই দেশের বাজার সয়লাব। রফতানি হচ্ছে সম্ভাবনার বিপরীতে শুধুই নামমাত্র। বাজার সম্ভাবনা অবহেলিত থাকার কারণেই বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশসমূহে হরেক পণ্যসামগ্রী রফতানি সম্ভাবনা আটকে আছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রফতানি সুবিধা অবহেলিত

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ