পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘তেত্রিশ বছর কাটলো/ কেউ কথা রাখেনি/ --মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল/ বড় হও দাদাঠাকুর/ তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো----’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাকে একটু ঘুরিয়ে বলতে হয়; ‘কেউ মনে রাখেনি/ মাত্র ৩৩ বছর হলো/ মহাবীর কর্ণেল ওসমানী ইন্তেকাল করেছেন/ মুক্তিযুদ্ধের এই সর্বাধিনায়ককে আমরা ভুলে গেছি/ কেউ মনে রাখিনি/ নীরবে চলে গেল তাঁর জন্মশত বার্ষিকী’।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে ১৬ কোটি মানুষ কেউ মনে রাখিনি! গতকাল পহেলা সেপ্টেম্বর ছিল এই মহাবীরের জন্মশত বার্ষিকী। দিনটি নীরবে চলে গেল। রাষ্ট্রীয় পর্যায় দূরের কথা সামাজিক এবং শিল্প সাহিত্যাঙ্গণের ব্যাক্তিরাও কেউ তাঁকে স্মরণ করেনি। সিলেট ছাড়া কোথাও তাকে নিয়ে ছোট-বড় কোনো রাজনৈতিক দলকে কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি। অথচ বাংলাদেশের নাম যতদিন থাকবে ততদিন কর্ণেল ওসমানী নামটি প্রাসঙ্গিক। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা থাকবে তাঁর নাম স্বর্নাক্ষরে।
কর্ণেল ওসমানী ’৭১ এ যুদ্ধের সময় দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ কলকাতা থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভাষণে এম. এ. জি. ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন। মুক্তিযুদ্ধে নের্তৃত্বে অসামান্য প্রজ্ঞার পরিচয় দেন ওসমানী। যুদ্ধ চলাকালে প্রদর্শন করেন অভূতপূর্ব সমরকৌশল। তাঁর মেধা ও সামরিক যুদ্ধ কৌশলে পরিচালিত হয় মুজিবনগর সরকারে যুদ্ধ পরিকল্পনা। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে মুক্তিপাগল মানুষকে যুদ্ধ জয়ের স্বাদ এনে দেন। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা সদস্যদের নিয়ে গঠন করেন নিয়মিত বাহিনী। দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে কমান্ডারদের নামানুসারে নামকরণ করেন ‘এস’, ‘জেড’, এবং ‘কে’ ফোর্স ইত্যাদি। পুলিশ বাহিনী ও যুবকদের নিয়ে গঠন করেন গেরিলা বাহিনী। নেতৃত্বের ক্যারিশমায় তিনি গেরিলা বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরে রেখে ‘হিট এন্ড রান’ নীতে গ্রহণ করেন। এতে শত্রু পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশি; শত্রুরা বিপর্যন্ত হয়ে পড়তো আকস্মিক আঘাতে; অন্যদিকে আমাদের বাহিনী হতাহত হত কম। তাঁর মতো চৌকস সামরিক বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বের কারণে ৯ মাসে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়।
কর্ণেল ওসমানী শুধু একটা নাম নয়, একটা ইতিহাস। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত নের্তৃত্বে সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাস যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। ক্ষণজন্মা এই মানুষটি ১৯১৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন বৃহত্তর সিলেটে। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অবিবাহিত। প্রবল দেশপ্রেমী এই মানুষটি কঠোর নিয়মানুবর্তী, আদর্শে ছিলেন অবিচল; আজীবন গণতন্ত্রী, ধার্মিক ও খাঁটি দেশপ্রেমিক মানুষটিকে যেন আমরা ভুলতে বসেছি। তাঁর নামটি বাদ দিলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস রচনা অসম্পূর্ণই থেকে যায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন; তেমনি স্বাধীন দেশেও জাতির দুঃসময়ে কান্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন এই বঙ্গবীর। দেশের বহু ক্রান্তিলগ্নে তিনি জাতিকে নির্ঘাত সংঘাত থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন; দিয়েছেন আলোর দিশা। আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। ওসমানীকে ভুলে যাওয়া কী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! ওসমানী আমাদের দেশ দিয়েছেন; কিন্তু আমরা তাকে মনের রাখার প্রয়োজন বোধ করছি না!
সাধাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত কর্ণেল ওসমানী ছিল প্রখর মেধাবী। তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা সামরিক রণকৌশলবিদ। কর্মজীবনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। সে সময় পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) নাগরিকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করতো। সেনাবাহিনী ও সরকারি চাকরিতে বাংলাদেশের লোকজন তেমন সুযোগ পেতেন না। সেনাবাহিনীতে চাকরি নিয়ে তিনি সেনাবাহিনীর দু’টি ব্যাটালিয়ান থেকে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সংখ্যা ছয়টি করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙ্গালী সদস্যের সংখ্যা ২ থেকে ১০ এ উন্নীত করেন। বাঙালীদের জন্যে নির্দিষ্ট সংখ্যা অনুপাতে কমিশন ও অফিসার পদসহ সেনাবাহিনীর সর্বস্তরে বাঙ্গালী সিনিয়রদের জন্য পদ সংরক্ষণ করেন। সেনাবাহিনীতে যখন উর্দূর জয়জয়কার; তখন তিনি কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় বাংলা কবিতা ‘চল চল চল’কে পাকিস্তান ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘মার্চ সঙ্গীত’ হিসাবে অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া পাকিস্তান সামরিক বাদ্যযন্ত্রে সরকারী ভাবে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ ও ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ’ বাংলা গান দু’টি প্রচলন হয় তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট তারই নিরলস প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে। তারপরও তিনি বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর আচরণ ও ব্যবহারে ক্ষুব্ধ ছিলেন। সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করার পর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান মন্ত্রীসহ উচ্চ পদের আমন্ত্রন জানালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ এর নির্বাচনে তিনি শতকরা ৯৪ ভাগ ভোটে পেয়ে এমপি হন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ওই সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতির প্রতিবাদে ১৯৭৪ সালের মে মাসে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সব দল নিষিদ্ধ করে ‘একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা’ প্রবর্তন করা হলে তিনি এবং ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দুজনই সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ এবং আওয়ামী লীগের সদস্যপদও ত্যাগ করেন। ওই সময় এই সিদ্ধান্ত ছিল গণতন্ত্র পাগল মানুষের জন্য দুঃশাহস। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। ৩ নভেম্বর জেলহত্যার (আওয়ামী লীগের চার নেতা হত্যা) ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি জাতীয় জনতা পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। অসম সাহসী জননন্দিত এই মহানায়ক সারাজীবন মানুষের সেবা করে গেছেন, সংসার ধর্ম করেননি। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিসাধীন ছিলেন। চিকিৎসারত অবস্থায় ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে তিনি ইন্তেকাল করেন। মুক্তিযুদ্ধের এই মহানায়কের জন্ম বার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী আসে আবার নীরবে চলে যায়। অথচ কেউ তাকে স্মরণ করার প্রয়োজন বোধ করছি না। এমনকি জন্মশত বার্ষিকীতেও ঢাকায় কোথাও কোনো স্মরণ সভার আয়োজন চোখে পড়েনি। দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল ওসমানীকে ভুলে যাওয়া?
সিলেটে ওসমানীর জন্মশত বার্ষিকী পালন
সিলেট ব্যুরো জানায়, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বঙ্গবীর জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর শততম জন্মবার্ষিকী সিলেটে পালিত হয়েছে। শনিবারর প্রথম প্রহরে জন্মদিনের কেক কাটার মাধ্যমে শুরু হয় আয়োজন। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর শততমজন্মবার্ষিকীতে নগরীর ওসমানী জাদুঘরে আয়োজন করা হয় শততম কেক কাটার অনুষ্ঠান। রাতে জাদুঘরে এসে উপস্থিত হন সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, মুক্তিযোদ্ধারা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠেনের নেতৃবৃন্দ।
শুক্রবার দিনগত রাত পেরিয়ে ঘড়ির কাটা যখন ঠিক বারোটায় পৌঁছায়, ক্যালেন্ডারে যখন ১ সেপ্টেম্বর; তখন ইউপস্থিত সুধীজন কাটেন জন্মশতবার্ষিকীর কেক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা সেনপ্রধান লে. জেনারেল (অব) হারুন অর রশীদ বীরপ্রতীক, সচিব অ্যাডভোকেট সরওয়ার আহমদ চৌধুরী আবদাল, যুগ্ম আহ্বায়ক আজিজ আহমদ সেলিম, মারিয়ান চৌধুরী, উদযাপন কমিটির উপদেষ্ঠা মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রফিকুল হক প্রমুখ।এ ছাড়াও সকালে ওসমানীর মাজার জিয়ারত করা হয়। পাশাপাশি ওসমানী জাদুঘরের সামনে থেকে সিলেট কেন্দ্রীীয়শহীদ মিনার পর্যন্ত র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। শাহজালাল (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণে কোরআন খতম ও বাদ জোহর দরগাহ মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে ##
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।