Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সব দোষ বাঁশের কেন?

প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান
রড নেই তো কী হয়েছে! বাঁশ আছে না! ডিজিটাল দেশ এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে, কেউ রুখতে পারবে না। বিস্ময়কর প্রতিভা, অসম্ভব প্রযুক্তি আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। বলতেই হবে, আমরা এগিয়ে গেছি, এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাব। নির্মাণ ঞবপযহড়ষড়মু-তে বিশ্বে আমরাই প্রথম রডের পরিবর্তে বাঁশ আর সিমেন্টের পরিবর্তে মাটি ব্যবহারের পারদর্শিতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছি। বাঁশ দিয়ে এর আগে কেউ বহুতল ভবন নির্মাণের সাহস করেনি। আমরাই করেছি; আমরাই পারি।
এ কথা কাউকে ব্যঙ্গ, ঠাট্টা বা রসিকতা করে নয়। চক্ষু চড়ক গাছ হলেও বাস্তবে ঘটনা ঠিক। চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের ভবন নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশ, খোয়ার বদলে সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার পর গাইবান্ধায়ও অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছে। সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের মেঘডুমুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়াশ ব্লক নির্মাণে রডের বদলে ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশের কঞ্চি। এখানকার ঠিকাদাররা আরো একধাপ এগিয়ে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যবহৃত বেঞ্চ ভেঙে তার লোহার ফ্রেমটি রাতের অন্ধকারে ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহার করেছে। এ নির্মাণ কাজ তদারকির দায়িত্বে আছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। জনস্বার্থে নির্মাণাধীন ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের’ এখন স্বাস্থ্য কতটা ঠিক আছে, সে প্রশ্ন উঠেছে।
দর্শনায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের কার্যালয় ও পরীক্ষাগার (অফিস কাম ল্যাবরেটরি) ভবনের লুপ ঢালাইয়ে রড না দিয়ে কাটা বাঁশ (কাবারি বা চটা) এবং খোয়ার পরিবর্তে পরিত্যক্ত সুরকিসহ নি¤œমানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ফাইটোসেনেটারি ক্যাপাসিটি শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের পরিচালক (উইং) সৌমেন সাহার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি সরেজমিন তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর কর্মকর্তারা কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে নির্মিত ৩৬টি লুপের সবকটি ভেঙে ফেলতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কর্তব্যে অবহেলার দায়ে প্রকল্পের সাইট প্রকৌশলী সুব্রত বিশ্বাসকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আমরা এতকাল দেখে এসেছি স্কুল, কলেজ, সড়ক, বিল্ডিং, ব্রিজ, কালভার্টসহ সরকারি স্থাপনা নির্মাণে নি¤œমানের উপকরণ বা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে। কিন্তু একেবারে অন্য সরঞ্জাম ব্যবহার করা, যা নতুনই বটে। উদ্বোধনের অল্প কয়েক বছর, মাস এমনকি অল্প কয়েক বছরের মধ্যে ভেঙে পড়ার খবরের অভাব নেই। নবনির্মিত মাদরাসা, স্কুল, কলেজ ভবনের ছাদ চুয়ে পানি পড়ার খবরও নতুন নয়। পরিমাণমতো বা মানসম্মত বালু, সিমেন্ট, রড, ইট ইত্যাদি ব্যবহার না করাই এর মূল কারণ। কিন্তু রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে ভবন নির্মাণের খবরে হতবাক পুরো দেশ। আমরা যেমন পড়েছিলাম ‘উত্তম-মধ্যম দেওয়া’, ‘অর্ধ-চন্দ্র দেওয়া’ তেমনি ভাষাবিদ ও ভাষাবিজ্ঞানীদের কাছে বিনীত নিবেদনÑ ‘বাঁশ দেওয়া’ এটাও অতি শীঘ্র বাংলা ব্যাকরণে যোগ করা হোক!
বিভিন্ন রসিকজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এখানে বাঁশের কি দোষ! ইঞ্জিনিয়াররা বাঁশের সঙ্গে আবার রড দিতে গেলেন কেন? বলা হয়েছে, রডের সঙ্গে বাঁশ দেওয়ায় ভবনে ফাটল ধরা পড়েছে। বাঁশ দিয়ে তৈরি কোনো ঘরবাড়িতে ফাটল ধরেছে, ইহজনমে কোনো দিন কেউ দেখেওনি শুনেওনি। তবে ইঞ্জিনিয়ারদের দোষ আছে বৈকি! তারা কীভাবে পারলেন রডের সঙ্গে বাঁশ দিতে? তাদের উচিত ছিল পুরো ভবনটাই বাঁশ দিয়ে তৈরি করে তার ওপর ইট, বালু, সিমেন্ট দেওয়া। তাহলেই তো হয়ে যেত। কেবল বাঁশ দিয়ে ভবন তৈরি করলে এ ধরনের বিপদের কোনো আশঙ্কাই থাকত না। এ খবরটি দেশে-বিদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় যেভাবে চাউর হয়েছে তাতে আসলে ওরা বাঁশ দিয়েছে পুরো বাংলাদেশকে।
বিদেশ থেকে আসা কৃষিজাত পণ্যের মান ও রোগবালাই যাচাইয়ের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্ল্যান্ট প্রোটেকশন উইং এই ভবনটি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এরকম সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভবন নির্মাণকাজে যে ভয়ংকর নি¤œমানের উপকরণ-সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, জোচ্চুরি চলে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত ওই বাঁশের ছবি তা স্পষ্ট করে তুলেছে। এসব বিপজ্জনক বিল্ডিং বছর যেতে না যেতেই ঝুরঝুর করে ঝরতে থাকে, দরজা-জানালা খুলে যেতে থাকে। ‘সরকারি মাল দরিয়া মে ডাল’, যাকে পুকুরচুরি বললেও কম বলা হয়। শিশুবেলায় ঠোঁটস্থ করা ছড়ার ছন্দে বলতে হয়Ñ ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,/ বিল্ডিংয়ের ভেতর বাঁশ শুধু রড গেলো কই?’
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের ভবন সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জয় ইন্টারন্যাশনাল নামে ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করছে এবং ঢাকার শেওড়াপাড়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্ট লিমিটেড (ইসিএল) কাজটি তদারকি করছে। ইসিএলের ঢাকা কার্যালয়ের প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ভবনের লুপ ঢালাইয়ের কাজটি সঠিক ডিজাইন অনুযায়ী হয়নি। লুপে চিপসের পরিবর্তে সুরকি ব্যবহার ঠিক হয়নি। শীঘ্রই দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গার উপ-পরিচালক নির্মল কুমার দে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, রডের পরিবর্তে বাঁশের চটা ব্যবহারসহ অনিয়ম করা হয়েছে। এ জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারভাইজারের গাফিলতি রয়েছে।
বর্তমানে রাজনৈতিক নেতার পরিচয়ে [যারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক নয়] কিছু মানুষরুপী অমানুষ সাধারণ মানুষের জীবন ও সর্বব্যাপী রাষ্ট্রীয় প্রদত্ত অধিকারকে জিম্মি করে দিনের পর দিন চুষে চুষে খাচ্ছে। আর তাদের সেল্টার দিচ্ছে মুখোশধারী ভদ্রবেশের কতিপয় এমপি, মন্ত্রী, ইউনিয়ন নেতা, পৌরসভার মেয়র, চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ অন্যরা। এদের মধ্যে কেউ কেউ না করে ব্যবসা না করে চাকরি। আয়ের সাথে সামঞ্জস্যহীন তাদের জীবন-মান। তাদের চলাফেরা ও বাড়িঘর দেখলে মনে হবে রাজপরিবারের সন্তান।
যে দেশে শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, যুবক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, প্রভৃতি অর্থলুট করে, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থচুরিসহ হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, হরিলুট হয় এবং এসবের সঙ্গেযুক্ত রাঘববোয়ালদের নাম উঠে এলেও তাদের বিচার হয় না, সেখানে আলোচ্য ক্ষেত্রে বিচারের আশা করা বাতুলতা মাত্র। ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দেবো কোথা!’ একটি দেশের দায়ীত্বশীলরা যদি এভাবে দুর্নীতিপরায়ণ, অমানুষ ও পশুতুল্য হয়ে যায়, তা হলে সে দেশের ভবিষ্যৎ কী?
[email protected]



 

Show all comments
  • abdul quaiyum chowdhury ২২ এপ্রিল, ২০১৬, ৪:৪৬ পিএম says : 0
    লেখককে ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সব দোষ বাঁশের কেন?

২১ এপ্রিল, ২০১৬
আরও পড়ুন